শিরোনাম

South east bank ad

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার চোখে অদম্য বাংলাদেশ

 প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   আন্তর্জাতিক

বিডিএফএন টোয়েন্টিফোর.কম

বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে বাংলাদেশ। অদম্য গতিতে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ কীভাবে প্রতিবেশী ভারত এবং একাত্তরে হেরে যাওয়া পাকিস্তানকে সামাজিক-অর্থনৈতিক বেশিরভাগ সূচকে পেছনে ফেলছে সেই গল্প এক নিবন্ধে লিখেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও নীতিবিষয়ক উপদেষ্টা ইশরাত হুসাইন। মুক্তিযুদ্ধের আগে বাংলাদেশের পটুয়াখালী, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় কর্মরত ছিলেন তিনি।

পাকিস্তানি দৈনিক ডনে ‘বাংলাদেশের গল্প’ শিরোনামে লেখা নিবন্ধে তিনি বলেছেন, একদা হেনরি কিসিঞ্জারের চোখে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র সেই বাংলাদেশকে এখন উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের জাতীয় আয় ৫০ গুণ, মাথাপিছু আয় ২৫ গুণ (ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি) এবং খাদ্য উৎপাদন চার গুণ বেড়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ২.৫ গুণের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। ফলে মাথাপিছু খাদ্যপ্রাপ্তি বেড়েছে। ১৯৯০ সালের তুলনায় রফতানি ১০০ গুণ বেড়েছে। দরিদ্রতা ৬০ শতাংশ (১৯৯০ সাল) থেকে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রত্যাশিত গড় আয়ু বেড়ে ৭২ বছর হয়েছে। একমাত্র শ্রীলঙ্কা ছাড়া এই অঞ্চলের প্রায় সব দেশের চেয়ে বেশিরভাগ সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। মানব উন্নয়ন সূচকের মান ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

মাত্র গত ৩০ বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের এই উন্নয়ন হয়েছে। তার আগের প্রথম দুই দশকে কঙ্কালসার বাংলাদেশ নানামুখী সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখোমুখি হয়েছে। ১৯৯০ সালে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের তুলনায় দ্বিগুণ ছিল, কিন্তু আজ তা কমে মাত্র সাত-দশমাংশে নেমে এসেছে। করোনাভাইরাস মহামারির আগে ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মাঝে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি গড়ে ৭ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে ছিল- যা ঐ সময়ে পাকিস্তানের জিডিপির তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

বাংলাদেশের গল্প বেশ আকর্ষণীয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ একটি দেশ কীভাবে তার দৈত্যাকার প্রতিবেশী ভারত এবং পাকিস্তানকে বেশিরভাগ আর্থ-সামাজিক সূচকে ছাড়িয়ে গেল?

দেশটিতে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সামরিক শাসন ছিল। এরপর দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা পায়।

১৯৯১ সাল থেকে পালাবদল করে ক্ষমতায় আছে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এবং খালেদা জিয়ার বিএনপি। ২০০৭ সালে সাময়িক বিঘ্ন ঘটে; এই সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছরের জন্য দেশ শাসন করে। ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে এবং টানা তৃতীয়বারের মতো নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। দুই নেত্রীর লড়াই এবং তিক্ততা তীব্রই রয়ে গেছে। খালেদা জিয়া নির্বাচন বর্জন করেছেন এবং দলের জ্যেষ্ঠ অনেক নেতার মতো তিনিও কারান্তরীণ আছেন।

এ ধরনের ভয়ানক রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং অস্থিতিশীলতাকে সঙ্গী করে কীভাবে দেশটি যথেষ্ট অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি বজায় রাখছে তা খুবই বিস্ময়কর।

তিক্ত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। এটা কীভাবে হলো?

প্রথমত, ভারত ও পাকিস্তানের বিপরীতে বাংলাদেশের মানুষ একই ভাষা, জাতিসত্তা ও ইতিহাসের সঙ্গে সাংস্কৃতিকভাবে সমজাতীয় এবং কার্যত কোনো ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক, উপজাতি ও সামন্ত বিভাজন নেই। গ্রামীণ-শহুরে বিভাজন থাকলেও দ্রুত উন্নয়ন নিশ্চিতের ফলে সাধারণ মানুষের অসন্তোষ নেই। আরো ভালো করার ইচ্ছা-অভিপ্রায় শক্তিশালী সামাজিক নীতি হয়ে উঠেছে। বাইরের কোনো গুরুতর হুমকির সম্মুখীন নয় বাংলাদেশ।

দ্বিতীয়ত, রাজ্য বা প্রদেশের হস্তক্ষেপকারী কোনো কাঠামো নেই। এর ফলে একক কেন্দ্রীয় সরকার প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, আইনি ও আর্থিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ করছে। যে কারণে বহু-স্তরের সরকার ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব নেই। দুর্বল বিরোধীদল এবং প্রশাসনের শীর্ষে দলীয় অনুগতদের নেতৃত্ব (কখনো কখনো আধা-কর্তৃত্ববাদী হিসেবে সমালোচিত) যে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার ক্ষমতাকে শক্তিশালী এবং আমলাদের দায়বদ্ধ করে তোলে।

তৃতীয়ত, ১৯৭১ সালের আগেও নারীর ক্ষমতায়ন প্রবল ছিল। কিন্তু পরিবার পরিকল্পনা, নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং ক্ষুদ্রঋণের জন্য বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর (এনজিও) সক্রিয় সম্পৃক্ততার ফলে পরবর্তী সব সরকার সকল স্তরে জোরেশোরে প্রচারণা অব্যাহত রেখেছিল।

নিজেদের দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন সরকার সুশীল সমাজের সংস্থা ও এনজিওগুলোকে পূর্ণ সমর্থন এবং স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। শিক্ষিত ও সুস্থ নারীদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ রয়েছে। এর ফলে নারী শ্রমের হার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং লিঙ্গ বৈষম্য হ্রাসে ভূমিকা রাখছেন এই নারীরা। ছেলেদের তুলনায় প্রাথমিক স্কুলে মেয়েদের ভর্তির অনুপাত ১০৫ শতাংশ।

চতুর্থত, তিক্ত রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরও অর্থনৈতিক নীতি, প্রকল্প এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নে ধারাবাহিকতা রয়েছে। দলগুলো মূল পাটাতন- সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, রাজস্ব আহরণ, মুক্ত বাণিজ্য, বেসরকারি খাতকে উৎসাহ দান এবং সামাজিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি থেকে বিচ্যুত হয়নি। সরকার বদল হলেও নীতিমালার কারণে উন্নয়ন কিংবা বিনিয়োগকারী এবং বাজার পরিস্থিতিতে তার কোনো প্রভাব পড়ে না। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বিনিয়োগকারীরা নির্বিঘ্ন পরিকল্পনা নিতে পারেন।

পঞ্চমত, বাংলাদেশের বাণিজ্য উদারীকরণ, উন্মুক্ত অর্থনীতি, বিদেশি প্রযুক্তিগত জ্ঞান ভাগাভাগি এবং রফতানিকারকদের উদার ও নগদ প্রণোদনা দেওয়ার প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয়েছে। দর্শনীয় এই কর্মযজ্ঞের ফলে তৈরি পোশাক রফতানিতে চীনের পরই রয়েছে বাংলাদেশ। এর সুফলও ভোগ করছে দেশটি। বেশিরভাগ বিদেশি ব্র্যান্ড তাদের পোশাক তৈরির জন্য বাংলাদেশকে বেছে নিচ্ছে। এই শিল্পে নারীর কর্মসংস্থান তাদের সামাজিক মর্যাদা এবং পরিবারের মধ্যে ক্ষমতার সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছে। দেশের উদ্যমী তরুণদের মাঝে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। উচ্চ শিক্ষা এবং দক্ষতার চাহিদা তুমুল বৃদ্ধি পেয়েছে।

ষষ্ঠত, দেশীয় সঞ্চয় এবং বিনিয়োগের হার ১৫ শতাংশ থেকে দ্বিগুণ বেড়ে ৩০ শতাংশ হওয়ায় উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। উৎপাদন খাতে বেসরকারি বিনিয়োগের বিশাল আধিপত্য এবং অবকাঠামো খাতে সরকারি ব্যয়ের কারণে এসবের সুফল ব্যাপকভিত্তিক হয়েছে। ক্রমবর্ধমান সামগ্রিক চাহিদা উচ্চ-আমদানির ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু রফতানি এবং রেমিট্যান্স সম্প্রসারণের মাধ্যমে আমদানিতে অর্থায়ন করা হয়েছিল। যে কারণে চলমান ঘাটতি স্বাভাবিকভাবেই মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে।

বাংলাদেশের কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। দেশটির প্রধান দুই দলের নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছিল যে, শুধু ছোট একটি অভিজাত শ্রেণির ক্ষমতা সীমাবদ্ধ রাখার পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদে জনগণকেও সম্পৃক্ত করতে হবে। এতেই বরং রাজনৈতিক লাভ বেশি হবে। দুটি দলই নির্বাচনে একজন প্রার্থীর ব্যক্তিগত অবস্থানের চেয়ে তার কার্যক্রম, জনপ্রিয়তা এবং দলীয় রেকর্ডের ভিত্তিতে মনোনয়ন দিয়েছে, এর ফলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছে। বেসরকারি খাত, রাজনীতিবিদ এবং আমলাদের মধ্যে ঐক্যের সম্পর্ক স্থিতিশীল ভারসাম্য নিয়ে এসেছে। রাজনীতিবিদরা তাদের নির্বাচনী প্রচারণার জন্য ব্যবসার কাছ থেকে অর্থ পেতেন, আমলারা তাদের স্বল্প বেতনকে উপহার এবং পারিশ্রমিক দিয়ে পরিপূরণ করতেন এবং ব্যবসায়ীরা শ্রম ও পরিবেশের খরচে তাদের ব্যবসার প্রসার ঘটান। কিন্তু তারা টাকা বিদেশে নিয়ে যাননি।

ট্যাক্স-জিডিপির অনুপাত ৮ থেকে ৯ শতাংশ রয়েছে। এর পেছনের দর্শনটি সম্ভবত, ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীদের হাতে একটি প্রান্তিক ডলারের প্রভাব সরকারি খাতের চেয়ে বহুগুণ বেশি হয়। ফলে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সরকারকে বিচক্ষণতা অবলম্বন করতে হয়। ঘাটতি ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে এবং এভাবে প্রাথমিক আর্থিক উদ্বৃত্তের কারণে সরকারি ঋণের অনুপাত হ্রাস পেয়েছে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, নীতিমালার ধারাবাহিকতা, রফতানি বৃদ্ধি, মানবসম্পদে বিনিয়োগ (বিশেষ করে নারীদের জন্য) এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতে একত্রে কাজ করাই বাংলাদেশের এই সফলতার গল্পের মূল রসদ।

BBS cable ad

আন্তর্জাতিক এর আরও খবর: