শিরোনাম

South east bank ad

খুনি, চাঁদাবাজদের দখলে আইপিটিভি

 প্রকাশ: ১৩ অগাস্ট ২০২১, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   অটোমোবাইল

  • নেই সরকারি অনুমোদন, নজরদারি
  • মূল ধারার সাংবাদিকতার জন্য হুমকি

নিজস্ব প্রতিবেদক

‘জনতার টিভি’ নামে একটি ইন্টারনেট প্রটোকল টেলিভিশন (আইপি টিভি) খুলেছেন আতাউল্লাহ খান। তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্নস্বীকৃত ঘাতক ফারুক রহমানের ফ্রিডম পার্টি করতেন বলে অভিযোগ আছে। এছাড়াও তার বিরূদ্ধে আছে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ। আতাউল্লাহর মতো বিতর্কিত আরও অনেকে খুলে বসেছেন আইপি টিভি। তাদের অনেকে চাঁদাবাজিতে অভিযুক্ত। আবার কেউ কেউ খুনের মামলার আসামী, অস্ত্র-গোলাবারুদসহ একাধিকবার আটক হওয়া ব্যক্তি।

আইপি টিভিগুলোর মালিকদের অনেকে আবার নিজদের ক্ষমতাসীন দলের নেতা বলে পরিচয় দেন। কেউ কেউ নিজেদের ১৪ দলীয় শরিক জোটের বড় নেতা হিসেবে পরিচয়। অথচ দলে তাদের কোনো পদ-পদবি থাকার তথ্য পাওয়া যায় না। আইপি টিভির নামে ইউটিউবে চ্যানেল চালান। অথচ তারা নিজেকে পরিচয় দেন পুরোদস্তর টেলিভিশনের মালিক হিসেবে।

এ দেশে নামে-বেনামে কত আইপি টিভি চলছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই কারও কাছেই। তবে একটি আইপি টিভিরও সরকারি অনুমোদন নেই। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (টিভি-২) রুজিনা সুলতানা আইপি টিভি প্রসঙ্গে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত একটি আইপি টিভিরও অনুমোদন তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়নি। অনেকে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। অনলাইন গণমাধ্যম নীতিমালার আলোকেই তাদের নিবন্ধনের কার্যক্রম চলছে।’

সাম্প্রতিক সময়ে যেসব আইপি টিভির কথা জানা যাচ্ছে তার বড় অংশই চালাচ্ছে বিতর্কিত রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা। মূলধারার গণমাধ্যমে ঠাঁই না পেয়ে ওই জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা নামে বেনামে স্থান করে নিয়েছে আইপি টিভিতে। তারা আইপি টিভি ব্যবহার করে কী ধরনের প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে সে ব্যাপারেও নজরদারি নেই। এমন পরিস্থিতিতে অনেক ক্ষেত্রে আইপি টিভির কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে দেশের মূলধারার টিভিগুলো। আইপি টিভির নামে দেশে কথিত যে সব টিভি চলছে সেগুলোর বিরূদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নিতে না পারলে সমাজে গণমাধ্যম সম্পর্কে ভুল বার্তা যাবে—এমনটিই বলেছেন মূলধারার টিভির নীতিনির্ধারকরা।

অস্ত্রসহ একাধিক মামলার আসামি টিনুর ‘সিটিজি ক্রাইম’ : চার ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে নুর মোস্তফা টিনু দ্বিতীয়। টিনুর বড় ভাই মোহাম্মদ সেলিম জামায়াতে ইসলামীর রুকন পর্যায়ের একজন নেতা। টিনুর ছোট ভাই নুর মুহাম্মদ শিপু চট্টগ্রামের চকবাজার থানা ছাত্রদলের সভাপতি।

চট্টগ্রামের গোল পাহাড় মোড় থেকে ২০০৩ সালে একটি অত্যাধুনিক চায়নিজ একে-২২ রাইফেল, একটি ম্যাগাজিনসহ টিনুকে গ্রেপ্তার করেছিল নগর গোয়েন্দা পুলিশ। আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর টিনু নিজেকে যুবলীগের নেতা হিসেবে পরিচয় দেওয়া শুরু করেন। ২০১২ সালে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানায় টিনুর বিরুদ্ধে আবারও অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনে মামলা হয়। এরপর ২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর তাকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি শটগান ও ৬৭ রাউন্ড গুলিসহ আটক করে র‌্যাব।

টিনুর বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসীন কলেজে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে একাধিক মামলা রয়েছে। এছাড়া নগরীর পাঁচলাইশ, চান্দগাঁওসহ বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, জমি দখলের মামলা ও অভিযোগ রয়েছে। ২০১৮ সালে নগর পুলিশের তৈরি করা কিশোর গ্যাংয়ের ‘গডফাদার’ তালিকায় টিনুর নাম ছিল ওপরের দিকে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের একাধিক মামলায় অভিযুক্ত টিনুর রয়েছে ‘সিটিজি ক্রাইম’ নামে একটি আইপি টিভি।

শিবির ক্যাডার হাছানের ‘চট্টলা ২৪’ : শিবির ক্যাডার একসময়ের টেম্পোচালক মোহাম্মদ হাছানের নিয়ন্ত্রণে এখন চলছে ‘চট্টলা ২৪’ নামের একটি আইপি টিভি। চট্টগ্রামের রাউজানের উত্তর সর্ত্তা গ্রামে রয়েছে তিনতলা বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি। এছাড়া চট্টগ্রাম নগরীতে প্রেস ক্লাবের পেছনে আম্বিয়া সেরিন নামে একটি ভবনে রয়েছে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। রয়েছে একটি ল্যান্ড ক্রুজার ও একটি হুন্দাই জিপ এবং একটি টয়োটা প্রিমিও কার। বাড়ি-গাড়িতেই শেষ নয়, দুটি বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রেরও মালিক হাছান। নিজের ফেইসবুক পেজ সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের ছবি দিয়ে সাজিয়ে রেখেছেন। দেখলে মনে হবে হাছানের মতো আওয়ামী লীগ করা মানুষ দেশে কমই আছেন।

অথচ চট্টগ্রামের বড় অংশের মানুষই তাকে চেনেন অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীর অন্যতম হত্যাকারী হিসেবে। চট্টগ্রামের নাজিরহাট কলেজের অধ্যক্ষ বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা গোপাল কৃষ্ণ মুহুরী তার কলেজে ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। আর এ কারণেই ২০০১ সালের ১৬ নভেম্বর তাকে নগরীর জামালখানের বাসায় কুপিয়ে নৃশংসভাবে খুন করে শিবির ক্যাডাররা। গোপাল কৃষ্ণ হত্যা মামলায় সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে ২০০২ সালের ২০ আগস্ট নগর গোয়েন্দা পুলিশ হাটহাজারী উত্তর মাদ্রাসা থেকে গ্রেপ্তার করে হাছানকে। তবে পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে তিনি ওই মামলায় ছাড়া পান।

হাছানের সন্ত্রাসী কর্মের আরও অতীত ইতিহাস রয়েছে। ১৯৯৯ সালের ১১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের সদরঘাটের ডিলাইট রেস্তোরাঁ থেকে কাটা রাইফেল ও গুলিসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

ফ্রিডম পার্টি ও সাবেক শিবির ‘নেতা’র জনতার টিভি : মুহাম্মদ আতাউল্লাহ খানের ভিজিটিং কার্ডে উলেস্নখিত পরিচয় অনুযায়ী তিনি বাংলাদেশ গণআজাদী লীগের মহাসচিব। দলটি ১৪ দলীয় জোটের শরিক। জনতার টিভি নামে একটি আইপি টিভির মালিক এই আতাউলস্নাহ খান আইপি টিভি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। তার বিরুদ্ধে ছাত্রশিবিরের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি ‘কর্নেল’ ফারুকের দল ফ্রিডম পার্টি করতেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব কারণে ২০২০ সালে গণআজাদী লীগের মহাসচিব পদ থেকে আতাউল্লাহ খানকে বহিষ্কারও করা হয়।

আতাউল্লাহ খানের বাড়ি কক্সবাজারের টেকনাফে। তার ভাই শফিকউলস্নাহ খান ১৯৯৬ সালে মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনে ফ্রিডম পার্টির সংসদ সদস্য প্রার্থী ছিলেন। ভাইয়ের হয়ে আতাউল্লাহ খান ফ্রিডম পার্টির কুড়াল মার্কার প্রচারণা চালিয়েছেন। এছাড়া ১৯৯৬-৯৭ শিক্ষাবর্ষে তিনি চট্টগ্রাম আইন কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের প্যানেল থেকে সহসভাপতি প্রার্থী হয়েছিলেন বলে একাধিক ব্যক্তি জানিয়েছেন।

আতাউল্লাহ খান সম্পর্কে জানতে চাইলে মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ বলেন, ‘তাদের পরিবারটি আওয়ামী ঘরোনার নয়। জামায়াত-শিবিরের সাংস্কৃতিক সংগঠন পাঞ্জেরী শিল্পগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় পরিচালক ছিলেন আতাউল্লাহ খান। তাদের পরিবারটি বিতর্কিত। বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজর ডালিমের সঙ্গে তাদের পরিবারের সখ্য ছিল।’

অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে আতাউল্লাহ খান বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র হয়েছে। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছি, এটাই আমার অপরাধ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেই শিবির হবে এমন তো কথা নেই। আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারত সফর করেছি। ডিজিএফআই, এনএসআই আমার বিষয়ে তদন্ত করেছে। এরকম হলে আমার নামে মামলা থাকত।’ তিনি আরও বলেন, ‘গণআজাদী লীগের এখন দুই গ্রুপ। আমরা ওদের বহিষ্কার করেছি। গণআজাদী লীগের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগিশের ছেলে সৈয়দ সামসুল আলম হাসু তর্কবাগিশ আমাদের কমিটির সভাপতি। আমরাই মূল ধারার গণআজাদী লীগ।’

আরিয়ান লেনিনের ‘সি ভিশন’ : আরেক আইপি টিভির মালিক চট্টগ্রামের আরিয়ান লেনিন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি চট্টগ্রামের বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে হুমকি দিয়ে টাকা নিয়ে থাকেন। গত বছরের ২০ এপ্রিল শেঠ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ সোলায়মান আলম শেঠ চট্টগ্রামের চকবাজার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন সি ভিশনের মালিক আরিয়ান লেনিনের বিরুদ্ধে। জিডিতে তার বিরুদ্ধে সাংবাদিক পরিচয়ে অনৈতিক সুবিধা আদায় ও কাল্পনিক সংবাদ প্রকাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ করা হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ সোলায়মান আলম শেঠ বলেন, ‘গত বছর এরকম অভিযোগে একটা জিডি করেছিলাম।’ এর বেশি কিছু তিনি বলতে চাননি।

গত বছর ৫ সেপ্টেম্বর রাতে সাভারের হেমায়েতপুরের মোল্লা মার্কেটের তৃতীয় তলায় নিউজ টিভি বাংলা নামে একটি আইপি টিভির অফিসে অভিযান চালায় র্যাব-৪। সাংবাদিক নিয়োগের নামে টাকা হাতিয়ে নেওয়া ও প্রতারণার অভিযোগে আইপি টিভিটির প্রতিনিধি দিদারুল ইসলাম দিদারসহ সাংবাদিক পরিচয়দানকারী আসমা রিতু, ওয়াশিম হোসেন ও মাহাবুবা বেগমকে আটক করে র্যাব। অফিসটিতে তল্লাশি চালিয়ে প্রতারণার ৯০ হাজার টাকা, ইয়াবা, বিদেশি মদও উদ্ধার হয়।

বর্তমানে জামিনে আছেন দিদারুল ইসলাম। র্যাবের অভিযানের সত্যতা স্বীকার করে দিদারুল ইসলাম বলেন, ‘র্যাবের অভিযান চালানোর বিষয়টি সঠিক। মামলাটি থানা পুলিশের কাছে এখনো চলমান আছে।’

এভাবেই অনুমোদনহীন আইপি টিভি সারা দেশে ছেয়ে গেছে। মূলধারার টিভিগুলো এসব আইপি টিভির কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে অনেক ক্ষেত্রে। এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক নেতা প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ও ডিবিসি নিউজ চ্যানেলের চেয়ারম্যান ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, ‘দেশে অনলাইনের নামে, আইপি টিভির নামে যা হচ্ছে, বিশেষ করে জয়যাত্রা ধরা পড়ার পর, সেটা সাংবাদিকতার মানদণ্ডে ভালো কিছু হচ্ছে না। আইপি টিভির লাইসেন্স দেওয়ার আগে এর প্রয়োজনীয়তা, যৌক্তিকতা এবং নীতি নৈতিকতা কতটুকু তারা মেনে পরিচালনা করবে সেটা দেখার বিষয় আছে। না হলে দেখা যাবে, এরা মূল ধারার সাংবাদিকতা, ইলেকট্রনিক সাংবাদিকতার জন্য একটি বড় ধরনের হুমকির সৃষ্টি করবে।’

BBS cable ad

অটোমোবাইল এর আরও খবর: