শিরোনাম

South east bank ad

ভালো কাজের লোভ দেখিয়ে নারী পাচার, মাঝপথে ঘটে যৌন নির্যাতন

 প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২১, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   অটোমোবাইল

মোঃ জামাল হোসেন, (বেনাপোল) :

কাজের লোভ দেখিয়ে অবাধে চলছে নারী, কিশোরী ও তরুণী পাচার। এসব পাচার করা নারীদের প্রায়ই গণধর্ষণের শিকার হতে হচ্ছে। তাদের ভাল কাজের প্রলোভন কথা বলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ভারতে। অনেকে অবশ্য জানেই না কি কাজে লাগানো হবে বলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে। কোথায় গেলে মিলবে চাকরি? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উত্তর পাওয়া যায়- ‘অত সব জেনে কি হবে? ভরসা রাখো, ঠিক কাজ জুটে যাবে’।

এসব পাচার করা নারীরা কোথায় যাবে, কোথায় থাকবে, কে দেবে চাকরি। এসব কোনো প্রশ্নের সদুত্তর থাকে না বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েদের। যার ফলশ্রুতিতে অনেক সময়েই যৌন নির্যাতন এমনকি ধর্ষণের শিকার হতে হয় এসব মেয়েকে। অনেককেই যৌনপল্লীতে বিক্রি করে দেওয়া হয়। দালাল-ফঁড়িয়াদের হাতেও নির্যাতিত হতে হয় এদের। নারী পাচার বন্ধ না হওয়ায় কত শত মেয়েকে এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তার সঠিক সংখ্যাটি অবশ্য অজানা। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হয় এসব মেয়ের হদিস মেলে না, অথবা অনেকে আবার ভয়ে মুখ খোলে না। অনুপ্রবেশকারী হিসেবে পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ জানিয়েও সুরাহা হবে না বলে আশংকা থাকে এই মেয়েদের।

বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের নারীরা বিভিন্ন দেশেই কম-বেশি পাচার হচ্ছে। তবে পাচার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় থাকা পাচারকারী সিন্ডিকেট চাকরিসহ নানা লোভ দেখিয়ে ২০-৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে নারীদের বিক্রি করে দিচ্ছে ভারতীয় সিন্ডিকেটের কাছে। সেখানে আবার নানা হাত ঘুরে অনেকেরই ঠিকানা হচ্ছে পতিতাপল্লী। তারা শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ও রাইটস যশোর নামের দুই বেসরকারি সংস্থার তথ্য থেকে জানা যায়, ভারতে পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর ভারতের সরকারি ও বেসরকারি সেফহোমে এখনো কয়েকশ‘ বাংলাদেশী নারী রয়েছেন। তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা জারি রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে কত নারী প্রতিবছর পাচার হয় সে বিষয়ে সরকারিভাবে খুব বেশি তথ্য নেই। তবে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৮টি রুট দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার নারী, শিশু ও কিশোরী ভারতে পাচার হচ্ছে।

সীমান্ত এলাকা দিয়ে মাদক ও অস্ত্র পাচারের পর তৃতীয় বৃহত্তম ব্যবসা মানবপাচার। এর একটি বড় ঘাঁটি বেনাপোল ও শার্শা সীমান্ত। পাচারের শিকার অনেক তরুণীর সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে তাদের যন্ত্রনাদায়ক নির্যাতনের কাহিনী। পাচার হয়ে এরা হারাচ্ছেন সম্ভ্রম। গত নয় মাসে ভারতের বিভিন্ন শহরে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে ২ থেকে ৫ বছর জেল খেটে দেশে ফিরেছেন বেনাপোল চেকপোস্ট হয়ে প্রায় শতাধিক নারী, কিশোরী ও তরুণী। এর মধ্যে গত ২৫ জানুয়ারি বেনাপোল দিয়ে ফেরত আসে ২৮ কিশোরী, ১৯ মার্চ আসে ৮ নারী, ২ সেপ্টেম্বর ৭ তরুণী, ২০ সেপ্টেম্বর ১৬ কিশোরী ও নারী, ৩০ সেপ্টেম্বর, ১২ তরুণী ও সর্বশেষ ৭ অক্টোবর ফেরত আসে ১১ জন কিশোরী।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শার্শা ও বেনাপোলের পুটখালী, দৌলতপুর, সাদিপুর, রঘুনাথপুর, কায়বা, রুদ্রপুর, গোগা, অগ্রভুলোট সীমান্ত দিয়ে পাচার হয় এসব নারী, কিশোর ও তরুণীরা। ভরতের উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটার আঙরাইল, বনগাঁর কালিয়ানি পিরোজপুর, বাগদার বয়রা, রানাঘাট সীমান্ত দিয়ে চোরাপথে ঢোকানো হয় এই মেয়েদের। তারপর দালালরাই তাদের নির্দিষ্ট জায়গায় রাখার ব্যবস্থা করে। সেখান থেকে তারা যায় মুম্বাই, পুনে, দিল্লিসহ ভারতের বড় শহরগুলোতে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যৌনপল্লী ও বারে নাচের কাজ জোটে তাদের।

বাংলাদেশ থেকে যাওয়া মেয়েদের বেশির ভাগেরই পারিবারিক অবস্থা খুব খারাপ। ভালো কাজের টোপ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। তারপর ভারতে নিয়ে শুরু হয় অত্যাচার। বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের ওপর যৌন নির্যাতন চালানো হয়। ভয়ে তারা সে কথা কাউকে বলতে পারে না। দেশে ফেরার পথও বন্ধ হয়ে যায়। ভারতের বড় শহরগুলোতে নিয়ে গিয়ে ওদের যৌন ব্যবসায় লাগানো হয়। কিছু মেয়ে স্বেচ্ছায় তা মেনেও নেয়। কিন্তু ভয়ে তারা কাউকে সে কথা বলতে পারে না। যারা মানতে চায় না তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন করা হয়। ভয়-ভীতি দেখানো হয়। তারপর তারা নিজে থেকেই ওই কাজে যুক্ত হয়ে যায়।

সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে শার্শা, বেনাপোল, ভারতের বনগাঁ থেকে মুম্বাই পর্যন্ত সক্রিয় একটি চক্র। প্রথমে বাংলাদেশি দালালরা গরিব পরিবারের মেয়েদের টার্গেট করে। ভাল বেতনের কথা বলে এসব পরিবারকে বুঝিয়ে বা কিছু টাকা অগ্রিম দিয়ে তাদের সহজ সরল মেয়েদের সীমান্তে নিয়ে আসা হয়। এর পর সুযোগ বুঝে পার করা হয় ভারত সীমান্তে। সীমান্তের গ্রামগুলোতে নির্দিষ্ট ঘর রয়েছে। যেখানে এই মেয়েদের প্রথমে তোলা হয়। মুম্বাই বা অন্য কোনো শহরে পৌঁছানোর পথে বিভিন্ন স্তরেই যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তারা। বনগাঁর সীমান্ত এলাকার সর্বত্র কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার কাজ এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। রাতের অন্ধকারে এই পাচার হচ্ছে। একবার ভারতে ঢুকে পড়লে শনাক্ত করাও মুশকিল হয়ে পড়ে। প্রথমে পাচার চক্রের স্থানীয় এজেন্টেরা মূল এজেন্টদের কাছে বিক্রি করে দেয়। তারা বিক্রি করে ভারতীয় এজেন্টদের কাছে। সীমান্তপার করে ভারতীয় এজেন্টের হাতে পৌঁছাতে পারলেই এদেশের এজেন্টদের দায়িত্ব শেষ।

পাচার হওয়া অনেকে সে দেশে আটক হয়ে আদালতের মাধ্যমে বিভিন্ন এনজিও সংস্থার শেল্টার হোমে থাকে। তারপর দুই দেশের কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তাদের নাম পরিচয় যাচাই করা হয়। সেখান থেকে বিভিন্ন বেসরকারি আইনি সহায়তা দেওয়া এনজিও গুলো সরকারের মাধ্যমে ভারত থেকে বিশেষ ট্রাভেল পারমিটের মাধ্যমে ছাড়িয়ে আনে। ভারতীয় বিএসএফ ও পুলিশ তাদের বেনাপোল চেকপোষ্ট দিয়ে বেনাপোল ইমিগ্রেমন ও বিজিবির কাছে হস্তান্তর করে।

ভারত থেকে ফেরত আসা পিরোজপুর জেলার এক তরুণী জানান, ভারতে তিন বছর জেল খেটে দেশে ফিরেছি ২০ সেপ্টেম্বর। দালালদের খপ্পরে পড়ে ভালো চাকরির আশায় ভারতে মুম্বাই শহরে গিয়েছিলাম। সেখানে গেলে আমাকে একটি ঘরে আটকিয়ে পাশবিক নির্যাতন চালায়। প্রতিটি দিন কমপক্ষে ৫ থেকে ২০ বার ধর্ষণ করে পাষন্ডরা। আর এক সপ্তাহর বেশী কোথাও রাখে না। তারা জায়গা বদলায়। এই অমানবিক পাশবিক নির্যাতনে আমার সমস্ত শরীরে ঘা হয়ে যায়। এরপর আমাকে মুম্বাই থেকে পুনে নামক একটি শহরে নেওয়ার পথে আমি কৌশলে পালিয়ে যাই। এরপর সে দেশের পুলিশ আমাকে আটক করে জেলখানায় পাঠায়।

ভারত ফেরত বাগেরহাটের এক তরুণী জানান, আমাকে আটকিয়ে প্রতিদিন ১৬ বছরের ছেলে থেকে ৮০ বছরের বৃদ্ধ পর্যন্ত ধর্ষণ করেছে। ওইখানে কম বয়সী মেয়েদের চাহিদা বেশি। এমনভাবে তারা লাগাতার তাকে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন করে যে পালাবার বা প্রতিবাদ করার শক্তিটুকু পর্যন্ত হারিয়ে ফেলি। দিনে এক দুবার নয় অনেক সময় ৫ থেকে ১০ বার ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। এই ভাবে বর্ননা করেন আরো পাচারের শিকার হয়ে দেশে ফেরা তরুণীরা।

সালমা খাতুন (ছদ্দনাম) বলেন, সাতক্ষীরার জনৈক পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে ২০১৯ সালে মার্চ মাসে স্বামী স্ত্রী মিলে ভারতে মুম্বাই শহরে যায়। কাপড়ের দোকানে মোটা বেতনে চাকুরীর প্রলোভন দেখিয়ে তাদেরকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। কোলকাতার এক দালাল ট্রেনে করে তাদেরকে মুম্বাই নেয়ার ৩ দিন পর বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে ভারতে আসার অপরাধ দেখিয়ে স্বামীকে পুলিশে ধরিয়ে দেয় দালালরা। পরের দিন রাতে সংঘবদ্ধ দালাল চক্র তাকে পুনের বুধওয়ার পেথ নামক একটি নিষিদ্ধ পল্লীতে মোটা অংকের টাকায় বিক্রি করে দেয়। নিষিদ্ধ পল্লীতে অবস্থানকালে তাকে দেহ ব্যবসা করার জন্য মারধর করলে রাতের আধারে পালিয়ে নিকটস্থ থানায় আশ্রয় নেন তিনি। পুলিশ আদালতে পাঠালে তাকে দোষী করে আড়াই বছরের সাজা দেয়। সাজাভোগ শেষে দেশে ফেরার কাগজ তৈরী করতে সময় লাগে প্রায় ৮০ দিন। তারপর স্বামীকে নিয়ে দেশে ফিরি।

স্থানীয় সংবাদকর্মী এম এ মুন্নাফ বলেন, সীমান্ত দিয়ে কিছু অসাধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সহযোগিতায় নারী ও শিশু পাচার চক্রের সদস্যরা যোগসাজসে এসব পাচারকার্য হয়ে থাকে।

এনজিও সংস্থা জাস্টিস এন্ড কেয়ারের যশোরের সিনিয়ার প্রোগ্রামার অফিসার এবিএম মুহিত হোসেন জানান, বাংলাদেশ থেকে নারী পাচারের ইতিহাস অনেক দিনের হলেও এটি বন্ধের জন্য খুব বেশি যে সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তা নয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে একমাত্র উদ্যোগ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা। কিন্তু এটি যে শুধুমাত্র আইন দিয়েই বন্ধ হবে, তা কিন্তু নয়। এই বিষয়ে আমাদের দুর্বলতাগুলো আগে চিহ্নিত করতে হবে। কীভাবে এই পাচারগুলো ঘটছে এবং সেই হিসেবেই প্রতিরোধের উপায়গুলোও হাজির করতে হবে। পাচারকারীরা কিন্তু প্রতিনিয়তই নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে পাচার অব্যাহত রাখছে। পাচার প্রতিরোধে আইনের পাশাপাশি সেই কৌশলগুলোর বিপরীতে কৌশল ঠিক করেই আমাদের নিশ্চিত করতে হবে প্রতিরোধের উপায়গুলো।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক বেগম সালমা আলী জানায়, বিগত ১০ বছরে ভারতে পাচার হওয়া ২ হাজার নারীকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ফিরে আসা নারীদের খুব কমই তাদের অভিজ্ঞতা অন্যদের জানায়। অনেকের হয়তো বলার মতো মানসিক অবস্থাও থাকে না। এর পিছনে কাজ করে সমাজ, পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনের কাছে হেয় হবার ভয়। কারণ, অনেক নারী ফিরে এসে সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে আবারো হেনস্থার শিকার হয়েছেন। অনেকেই ভোগেন অনিরাপত্তায়। পারিবারিকভাবে সমর্থন না পাওয়ায় অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আবার হতাশ হয়ে পড়ছেন।

নারী ও শিশু পাচার ও তাদের ফিরিয়ে আনার কাজ করে চলেছেন যশোরের মানবাধিকার সংস্থা রাইটস যশোর। ওই সংস্থার নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক জানান, ভারতের বিভিন্ন হোমে বাংলাদেশি অনেক নারী ও তরুণী দেশে ফেরার অপেক্ষায় আছে। আমরা দু‘দেশের উচ্চ পর্যায়ে বিষয়টি জানিয়েছি। আটকে থাকা নারী ও তরুণীর নাম ঠিকানা পরীক্ষা করা হচ্ছে। খুব দ্রুত বিষয়টি সমাধান করে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার কাজ চলছে।

এ ব্যপারে বেনাপোল পোর্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুন খান জানান, পাচারকারীরা যখন ফেরত আসে তখনই জানা যায় এরা পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে ভারতে গিয়েছিল। কিন্তু মামলা করার কথা বললে কেউ এগিয়ে আসে না। আমরা মানব পাচার রোধে বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় লোকজন নিয়ে সভা করেছি। তারপরও তা রোধ করা যাচ্ছে না। কাউকে না জানিয়ে রাতের আধারে এসব নারীরা ভারতে পাড়ি জমাচ্ছে দালালের হাত ধরে।

BBS cable ad

অটোমোবাইল এর আরও খবর: