গতি ফেরেনি পুঁজিবাজারে, সংস্কার নিয়ে অংশীজনদের হতাশা

গত বছরের আগস্টে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে পর দায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে পুঁজিবাজার পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে প্রত্যাশা করেছিলেন বিনিয়োগকারীরা। এ প্রত্যাশার কারণে বর্তমান সরকারের শুরুর কয়েক দিন পুঁজিবাজারে বেশ গতি ফিরে এসেছিল। যদিও বাজারের এ গতি ফিকে হয়ে যেতে বেশিদিন লাগেনি। কাঙ্ক্ষিত সংস্কার বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণে অংশীজনদের মধ্যেও হতাশা কাজ করছে। সেই সঙ্গে পুঁজিবাজারের সূচক ও লেনদেনে গতি ফিরে আসেনি। বরং পুঁজিবাজারে এক প্রকার স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের কারণে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান, পতন ঘটে আওয়ামী সরকারের। এর তিনদিন পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এ সরকার দায়িত্ব নেয়ার সময় দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সার্বিক সূচক ডিএসইএক্সের অবস্থান ছিল ৫ হাজার ৯২৫ পয়েন্টে। সেদিন এক্সচেঞ্জটিতে লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা। এর পর থেকে পুঁজিবাজারের সূচক ও লেনদেন ক্রমেই নিম্নমুখী। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ডিএসইএক্স সূচক ৫ হাজার ১৭৯ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ে সূচকটি ৭৪৬ পয়েন্ট হারিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৪৩০ কোটি টাকা। এক্সচেঞ্জটিতে সর্বশেষ ৫০০ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছিল গত বছরের ৩ ডিসেম্বর। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত লেনদেনের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা স্পর্শ করেনি।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সার্বিকভাবে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো নেই। এ ধরনের পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজার ভালো থাকার কোনো কারণ নেই। অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হলে পুঁজিবাজারেও এর প্রভাব পড়বে। সব পুঁজিবাজারেই কিছু জাঙ্ক শেয়ার থাকে, যেগুলোর দাম দ্রুত বাড়তে দেখা যায়। তবে আমাদের পুঁজিবাজারে এ ধরনের শেয়ারের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। খোলা চোখেই দেখা যাচ্ছে যে এসব শেয়ার নিয়ে কারসাজি হচ্ছে, কিন্তু আমরা সেটি বন্ধ করতে পারছি না। অনিয়মের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে জরিমানা করা হলে এটি নিশ্চিত করতে হবে যাতে প্রকৃত অপরাধীরা শাস্তি পায়। বেনামি বিও হিসাবের মাধ্যমে কেউ শেয়ার কারসাজি করলে সেক্ষেত্রে তাকে বড় অংকের জরিমানা করলেও কোনো লাভ নেই। কারণ এ অর্থ কখনো আদায় করা সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে প্রকৃত সুবিধাভোগীকে খুঁজে বের করে জরিমানা করতে হবে। কিন্তু আমাদের এখানে এ ধরনের উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। বিএসইসির বর্তমান কমিশনের অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকলেও আগের তুলনায় তাদের বিশ্বাসযোগ্যতার দিকটিতে উন্নতি হয়েছে। তারা চেষ্টা করছে, কিন্তু অতীতের ক্ষত নিরাময়ের পাশাপাশি বাজারবান্ধব নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে এখন পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে। তাদের এটি করতে হবে।’
বাজার অংশীজনরা দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পুঁজিবাজারে বড় ধরনের সংস্কারের প্রত্যাশা করেছিলেন। বিশেষ করে পুঁজিবাজারে কোম্পানির তালিকাভুক্তি ও শেয়ারদর কারসাজির প্রতিরোধে কাঠামোগত সংস্কারের প্রত্যাশা ছিল সবার। যদিও এসব বিষয়ে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। পুঁজিবাজারের সংস্কারে বিএসইসির পক্ষ থেকে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত এ টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন জমা পড়েনি। প্রতিবেদন জমার পর এতে যেসব সুপারিশ উঠে আসবে সেগুলোর বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়ার ক্ষেত্রেও বেশ সময় চলে যাবে। এ অবস্থায় বাজার পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা কাজ করছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) প্রেসিডেন্ট সাইফুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বর্তমান সরকারের সময়ে পুঁজিবাজার নিয়ে অংশীজনদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। আইপিও, মিউচুয়াল ফান্ড, মার্জিন ঋণ, বাজে শেয়ারের আধিক্য, বাজার নজরদারি ব্যবস্থায় দুর্বলতার মতো বিষয়গুলোয় সংস্কার হবে আমাদের এমন প্রত্যাশা ছিল। যদিও এক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো সংস্কার হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার একটি নিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক সরকার। তাদের ওপর কোনো বাহ্যিক চাপ থাকার কথা নয়। ফলে আমাদের সবারই প্রত্যাশা ছিল সরকার পুঁজিবাজারের জন্য কাঙ্ক্ষিত সংস্কার বাস্তবায়ন করবে, যদিও সেটি হয়নি। তবে আমরা সামনের দিকে তাকাতে চাই, দেখি কী হয়?’
দেশের পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ারের বেশ ঘাটতি রয়েছে। এ অবস্থায় পুঁজিবাজারের উন্নয়েন সবসময়ই ভালো কোম্পানির তালিকাভুক্তি বাড়ানোর বিষয়টি গুরুত্ব পায়। গত ১৬ বছরে দেশের পুঁজিবাজারে কোম্পানি তালিকাভুক্তির নামে অসংখ্য অনিয়ম হয়েছে। এ সময়ে যেসব কোম্পানি পুঁজিবাজারে এসেছে তার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক এরই মধ্যে দুর্বল কোম্পানিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর গত ছয় মাসে ভালো ও বড় কোনো কোম্পানি তালিকাভুক্তির উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি। বরং এ সময়ে আগের মতোই দুর্বল ও উৎপাদন বন্ধ থাকা কোম্পানির শেয়ারদর কোনো কারণ ছাড়াই বাড়তে দেখা গেছে। এক্ষেত্রে বাজার কারসাজি প্রতিরোধে কমিশনের উদ্যোগ যথেষ্ট দুর্বল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আবার বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর এখন পর্যন্ত অনিয়ম ও কারসাজির দায়ে ৭০০ কোটি টাকার বেশি জরিমানা করা হয়েছে, যার মধ্যে এখন পর্যন্ত এক টাকাও আদায় করা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পুঁজিবাজারের বিদ্যমান আইন ও বিধি-বিধানের মধ্যে সামান্য কিছু পরিবর্তনের মাধ্যমে যেসব সংস্কার করা প্রয়োজন সেগুলো এরই মধ্যে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পুঁজিবাজার সংস্কারসংক্রান্ত টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জমা হবে। প্রতিবেদনে সংস্কারের যেসব সুপারিশ উঠে আসবে তার মধ্যে স্বল্প মেয়াদেরগুলো দ্রুতই বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হবে। মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে। এসব সংস্কার বাস্তবায়ন হলে পুঁজিবাজারেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। পাশাপাশি দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হলে সেটি পুঁজিবাজারের জন্যও সহায়ক হবে। সরকারি, বেসরকারি ও বহুজাতিক ভালো কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করার জন্য বিএসইসি স্টক এক্সচেঞ্জকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছে। এ ধরনের কিছু কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে সেটিও পুঁজিবাজারে গতি ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে। সব মিলিয়ে আগামীতে দেশের পুঁজিবাজার ভালো অবস্থানে যাবে বলে আমরা মনে করি। তবে এজন্য বিনিয়োগকারীদের কিছুটা সময় ধৈর্য ধরতে হবে।’
জাঙ্ক শেয়ার নিয়ে কারসাজির বিষয়ে মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘এটি শতভাগ বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে আগের তুলনায় এর হার অনেক কমে এসেছে। কারসাজির বিষয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কারসাজির ঘটনায় প্রকৃত সুবিধাভোগীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে কমিশন সচেষ্ট।’