বিবিএসের তথ্যে ভরসা নেই ব্যবহারকারীদের
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত তথ্যকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন না ব্যবহারকারীরা। জরিপে দেখা গেছে, এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি ব্যবহারকারী বিবিএসের তথ্যকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করছেন না। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি পরিসংখ্যান নিয়ে তাদের অবিশ্বাস সবচেয়ে বেশি। সংশয় রয়েছে বিবিএসের অন্য সব তথ্য নিয়েও।
সম্প্রতি বিবিএস পরিচালিত এক জরিপেই এ চিত্র পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রের (বিআইডিএস) সঙ্গে যৌথভাবে বিবিএসের এই জরিপটি পরিচালিত হয়। ‘ব্যবহারকারী সন্তুষ্টি জরিপ-২০২৪’ শীর্ষক এ জরিপের ফল প্রকাশ হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। এতে দেখো গেছে, বিবিএসের তথ্য ব্যবহারকারীদের বড় একটি অংশই সংস্থাটির পরিসংখ্যান বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন না। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতিসংক্রান্ত পরিসংখ্যান নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন রয়েছে তাদের মনে।
জরিপে প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী, মোট ব্যবহারকারীর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা ৩৩ দশমিক ১৬ শতাংশ বিবিএসের মূল্যস্ফীতিসংক্রান্ত পরিসংখ্যানকে নির্ভরযোগ্য মনে করেন না। ব্যবহারকারীদের ২৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ মনে করেন, এ-সংক্রান্ত তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা কম। আর একেবারেই অনির্ভরযোগ্য মনে করেন ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ।
বিবিএসের প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে গত দুই অর্থবছরজুড়েই মূল্যস্ফীতির গড় হার ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। তবে সংস্থাটির এ পরিসংখ্যান নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন রয়েছে। বাজারে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির হারের সঙ্গে সংস্থাটির দেয়া মূল্যস্ফীতির তথ্যের ব্যবধান অনেক বেশি বলে দাবি করে আসছিলেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা।
তারা মনে করেন, বিগত সরকারের শাসনামলে সরকারের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির বর্ণনা প্রচারের কাজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম বিবিএস। অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো এই প্রতিষ্ঠানটিকেও রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। সংস্থাটিকে ব্যবহার করে জনসংখ্যা, জিডিপির আকার-প্রবৃদ্ধি থেকে শুরু করে অর্থনীতির প্রতিটি খাতেই ভুল ও প্রশ্নবিদ্ধ পরিসংখ্যান তৈরি ও উপস্থাপন করা হয়েছে। তাই সরকার পরিবর্তনের পরও বিবিএস থেকে মূল্যস্ফীতির যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে সেটির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
জরিপের তথ্যমতে, বিবিএসের তথ্যকে কম নির্ভরশীল মনে করে ৩৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ মানুষ। এর পরই ২৬ শতাংশ মানুষ ন্যাশনাল অ্যাকাউন্ট পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দিহান। এর মাধ্যমে জিডিপির হিসাব-নিকাশ করা হয়। আর ২৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ মানুষ আয় ও দারিদ্র্যের হিসাব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ে সন্দেহ রয়েছে ২৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ মানুষের। ২৩ শতাংশের বেশি মানুষ শিল্প, শ্রমিক ও শিক্ষা পরিসংখ্যান নিয়ে দ্বিধায় থাকে। সর্বোপরি ৪০ শতাংশ মানুষ মনে করছে, সংস্থাটির তথ্য নির্ভরশীল। আর প্রায় ১৯ শতাংশ মানুষ বিবিএসের তথ্যকে অন্য দেশের সঙ্গে তুলনীয় মনে করছে। ৮০ শতাংশ ব্যবহারকারী বলছেন, প্রয়োজনীয় ডাটা পাওয়া গেলেও তা পর্যাপ্ত না।
জরিপে উঠে আসে, সব মিলিয়ে ৩৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ ব্যবহারকারী মনে করেন, বিবিএসের তথ্য নির্ভরযোগ্য নয়। এতে উঠে আসে, ৪২ দশমিক ৮৮ শতাংশ ব্যবহারকারী বিবিএসের তথ্য প্রকাশের ধারাবাহিকতা (ডাটা ফ্রিকোয়েন্সি) নিয়ে অসন্তুষ্ট। প্রায় ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ ব্যবহারকারী এ বিষয়ে কিছু জানেন না।
দেশের সরকারি পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন রয়েছে দীর্ঘদিন ধরেই। আগে থেকেই বিবিএসের তথ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন ছিল। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তা আরো ঘনীভূত হয়।
বিগত সরকারের আমলে ২০১৪ সালে পরিকল্পনামন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামাল দায়িত্ব নেয়ার পর পরিসংখ্যান বিভ্রাট আরো প্রকট হয়। অর্থনৈতিক বিভিন্ন সূচকের তথ্য ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর অভিযোগ ওঠে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিসংখ্যানগত পারফরম্যান্স বিবেচনায় স্কোর প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। ২৫টি সূচক বিবেচনায় এমন তালিকা তৈরি হয়। ২০১৪ সালে প্রকাশিত স্ট্যাটিস্টিক্যাল ক্যাপাসিটি ইন্ডিকেটরে বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর ছিল ১০০-এর মধ্যে ৮০ আর পদ্ধতিগত স্কোর ৭০। কিন্তু এর পর থেকে দুটি স্কোরই ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। ২০১৮ সালে সার্বিক স্কোর দ্রুত কমে ৬২-তে নেমে যায়। ২০২০ সালে নেমে আসে ৬০-এ, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার গড় স্কোর ছিল ৬৯। সে সময় মেথডোলজি বা পদ্ধতিগত সূচকে সবচেয়ে বড় পতনের মুখে পড়ে বাংলাদেশ। এ সূচকে ২০১৪ সালের ৭০ স্কোর থেকে ২০২০ সালে তা অর্ধেকের বেশি কমে ৩০-এ নেমে আসে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিবিএসে পরিসংখ্যান প্রকাশে পেশাদারত্বের অভাব রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থাটির কাজের স্বাধীনতা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। ফলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তথ্য-উপাত্তে কারচুপির অভিযোগ রয়েছে। এজন্য পদ্ধতিগত পরিবর্তন ছাড়াও পরিসংখ্যানের লোকদের মাধ্যমে বিবিএস চালানো যেতে পারে।