জুলাইয়ে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ হয় ঋণ করে
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুরো জুলাইয়ে উত্তাল ছিল সারাদেশ। আন্দোলনের জেরে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসহ বন্ধ ছিল বিভিন্ন বেসরকারি অফিস। আন্দোলন কন্ট্রোলে দেশে ইন্টারনেট বন্ধ থাকে বেশ কিছু দিন। এ বড় প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতিতে। গত জুলাইয়ে অর্থনীতির স্থবির অবস্থায় সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও ঋণের সুদ পরিশোধের ব্যয় মেটাতে সরকার ব্যাংক ঋণ নেয় ১২ হাজার ৭১১ কোটি টাকা।
এর আগে গত বছরের জুলাইয়ে ব্যাংক থেকে নেয়া সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। এ অনুযায়ী গত জুলাইয়ে সরকারের ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় পাঁচ গুণেরও বেশিতে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সাধারণত অর্থবছরের প্রথম মাস হিসেবে জুলাইয়ে সরকারি ব্যয়ের চাপ সেভাবে থাকে না। ফলে এ সময়ে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণ এত বেশি বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি অস্বাভাবিক।
চলতি অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। সে হিসেবে প্রতি মাসে গড়ে সংস্থাটিকে ৪০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করতে হবে।
যদিও এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাইয়ে সংস্থাটির রাজস্ব আহরণ হয়েছে ২০ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। আর গত বছরের একই সময় এনবিআর আহরণ করেছিল ২০ হাজার ৬০১ কোটি টাকার রাজস্ব। সর্বশেষ গত আগস্টে ২৩ হাজার ৫১৩ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের ব্যয় ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাজস্ব আহরণ হচ্ছে না। এতে সরকারের আয়-ব্যয়ের মধ্যে থেকে যাচ্ছে বড় ধরনের ঘাটতি। এ ঘাটতি পূরণে বিগত সরকারকে ঋণের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। এর রেশ এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেও বহন করতে হচ্ছে। গত জুলাইয়ে আন্দোলন চলার সময় ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে স্থবিরতা নেমে এসেছিল। এ অবস্থায় সরকার লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে রাজস্ব আহরণ করতে পারেনি। এ কারণে সরকারকে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়েই চলতে হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী গণমাধ্যমে বলেন, জুলাইয়ের বড় অংশই আন্দোলন, সংঘাত-সংঘর্ষ ও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গেছে। এ কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়েছে। সরকার কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আহরণ করতে পারেনি। এ কারণে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকেই ঋণ নিয়ে চলতে হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর এখনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরোপুরি স্থিতিশীল হয়নি। সরকার এখন পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। আশা করছি, ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এ প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকে নতুন নতুন ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি পাওয়া যাচ্ছে। এসব ঋণ দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হলে সরকারের ব্যাংক ঋণনির্ভরতা অনেকাংশেই কমবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নরও বলেছেন, সরকার যেন ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা কম ঋণ নেয়, সে বিষয়ে তিনি আলোচনা করবেন। আশা করছি, সরকার ঋণ কম নিলে বেসরকারি খাত বাড়তি ঋণ নিতে পারবে। তাতে অর্থনীতি আরো বেশি প্রাণবন্ত হওয়ার সুযোগ পাবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, সরকারের পরিচালন ব্যয়ের আকার প্রতি বছরই বেড়েছে। এর বড় অংশই ব্যয় হয় সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও ঋণের সুদ পরিশোধে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের পরিচালন খাতে ৪ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত ছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত এ খাতে ব্যয় হয়েছে ৪ লাখ ৫ হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ৮৫ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে ৮৫ হাজার ২৪২ কোটি ও সুদ পরিশোধে ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উন্নয়ন খাতে সরকারের ২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে ২ লাখ ১ হাজার ২৯৪ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ৭ লাখ ৫২ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে প্রকৃত ব্যয় হয়েছে ৬ লাখ ৬ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার ৮০ দশমিক ৬২ শতাংশ।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে পরিচালন খাতে সরকারের ৫ লাখ ৬ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এর মধ্যে সুদ পরিশোধেই ব্যয় হবে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে সরকারের পরিচালন ব্যয়ের তথ্য এখনো প্রকাশ করেনি অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে গত অর্থবছরের জুলাইয়ে এ খাতে ব্যয় হয়েছিল ২০ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা।
এর আগের দুই অর্থবছরেও জুলাইয়ে পরিচালন খাতে ১৯ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, এ বছরের জুলাইয়ে সরকারের পরিচালন ব্যয় দাঁড়াতে পারে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকায়। চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাবদ ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যয় যোগ করে গত জুলাইয়ে সরকারের পরিচালন ও উন্নয়ন খাতে মোট ব্যয় দাঁড়াতে পারে ৩০ হাজার কোটি টাকা বা এর কাছাকাছিতে।
আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় প্রতি বছরই সরকারকে ঘাটতির মধ্যে পড়তে হয়। সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও সরকারের বাজেট ঘাটতি ছিল ১ লাখ ৮৮ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা। এ ঘাটতি মেটাতে বিদেশি উৎস থেকে ৭১ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা ও ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ২৪ হাজার ১৫০ কোটি টাকার ঋণ নিতে হয়েছে সরকারকে।
দেশের অর্থনীতির বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিগত সরকারের মধ্যে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন সংকটের বিষয়টি উপেক্ষা করা কিংবা আড়ালে রাখার প্রবণতা ছিল। এতে করে নীতি-কৌশল নির্ধারণের ক্ষেত্রেও সঠিক অবস্থার প্রতিফলন দেখা যায়নি, যার প্রভাবে দেশের অর্থনীতির সংকট আরো তীব্র হয়ে উঠেছে।
অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হানের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশের অর্থনীতি গত কয়েক বছর ধরেই নানা ধরনের সংকটের মধ্যে ছিল। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার ও রিজার্ভ সংকট, বিনিময় হারের অস্থিরতা, রাজস্ব ও বাজেটে বড় ঘাটতি, খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বমুখিতাসহ বিভিন্ন ধরনের সংকটে অর্থনীতি হাবুডুবু খাচ্ছিল। তৎকালীন সরকার সংকটগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নেয়নি, যার চূড়ান্ত পরিণতি আমরা এখন দেখছি। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আয় না হওয়ায় সরকার পুরোপুরি ঋণনির্ভর হয়ে পড়েছিল। এ সংকটগুলোর ধারাবাহিকতা এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘাড়ে এসে পড়েছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের এ নির্বাহী পরিচালক বলেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীল হয়নি। তৈরি পোশাক খাত, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় অস্থিরতা চলছে। অর্থনীতি স্থিতিশীল ও প্রবৃদ্ধির জায়গায় আনতে হলে সবার আগে দেশের স্থিতিশীলতা দরকার। শেখ হাসিনা সরকার চলতি অর্থবছরের জন্য যে বাজেট দিয়ে গেছে, সেটি বাস্তবায়নের অযোগ্য। ঘোষিত এ বাজেটের একটি বাস্তবসম্মত রিভিশন দরকার। এ মুহূর্তে অগ্রাধিকারমূলক খাতগুলোকে চিহ্নিত করে সেগুলোয় জোর দিতে হবে।