বাংলাদেশে সুশাসন ও আর্থিক স্থিতিশীলতায় বিশ্বব্যাংকের ৫০০ মিলিয়ন ডলারের ঋণ অনুমোদন

বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত এবং আর্থিক খাতে করপোরেট সুশাসন ও স্থিতিশীলতা জোরদারে সহায়তা করতে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের অর্থায়ন অনুমোদন করেছে বিশ্বব্যাংক। গতকাল শুক্রবার (২০ জুন) এ ঋণ সহায়তা অনুমোদন করা হয়েছে।
‘স্ট্রেংদেনিং গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল রেজিলিয়েন্স ডেভেলপমেন্ট পলিসি ক্রেডিট’ নামে এই কর্মসূচিটি বাংলাদেশের সরকারি ও আর্থিক খাতের সংস্কারকে সহায়তা করবে, যা দেশের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে, এই সংস্কারের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোর জন্য উন্নত সেবা প্রদানের ভিত্তিও তৈরি হবে।
বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের অন্তর্বর্তী কান্ট্রি ডিরেক্টর গেইল মার্টিন বলেন, ‘সরকারি অর্থ ব্যয়ের পদ্ধতিতে উন্নয়ন ঘটানো বাংলাদেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার তার প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো উন্মুক্ত ও জবাবদিহিমূলক করতে যে পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা দেশের জনগণের কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এই অর্থায়ন সরকারের নীতিমালা ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো শক্তিশালী করার প্রচেষ্টাকে সহায়তা করবে, যাতে সবাই উপকৃত হয়। গত সপ্তাহে অনুমোদিত অপর একটি প্রকল্পের মাধ্যমেও আমরা এই সংস্কার বাস্তবায়নে সরকারের পাশে আছি।‘
বর্তমানে মধ্যম আয়ের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত তুলনামূলকভাবে খুবই কম। এতে সীমিত হয়েছে সরকারের জনসেবা নিশ্চিত করার সামর্থ্য। এই কর্মসূচি অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণে সংস্কার আনার লক্ষ্যে সহায়তা করবে। এতে করে করনীতি ও কর প্রশাসন আরও স্বচ্ছ, দক্ষ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী পরিচালিত হবে।
এছাড়া, কর অব্যাহতির ব্যবস্থাপনায় কৌশলগত, কাঠামোগত ও স্বচ্ছ পদ্ধতির দিকে এগিয়ে যাওয়া হবে। এই সংস্কারের আওতায় কর অব্যাহতি দিতে হলে সংসদের অনুমোদন লাগবে—যা বর্তমান পদ্ধতির তুলনায় একটি বড় অগ্রগতি।
এই অর্থায়নের মাধ্যমে করপোরেট সুশাসন ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কাঠামোও শক্তিশালী হবে। আর্থিক প্রতিবেদনের মান আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হবে এবং স্বচ্ছতা বাড়ানো হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতা চিহ্নিত ও সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংককে পূর্ণাঙ্গ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেয়া হবে, যা আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে।
প্রকল্পের তৃতীয় দিকটি হলো পুরো সরকারি খাত জুড়ে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দক্ষতা বাড়ানো। ২০২৭ সালের মধ্যে সব সরকারি প্রকল্প মূল্যায়ন নথি প্রকাশযোগ্য করতে হবে। ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট প্রোকিওরমেন্ট ব্যবস্থার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হবে, উপকারভোগীর মালিকানা প্রকাশ করতে হবে এবং প্রতিযোগিতা বাড়াতে দরদামের সর্বোচ্চ সীমা তুলে দেয়া হবে। দুর্নীতির ঝুঁকি হ্রাসে ভূমিকা রাখবে এসব পদক্ষেপ।
সরকারি খাতে আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের নিরীক্ষা সক্ষমতা জোরদার করা হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্বাধীনতা বাড়ানো হবে, যা তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে এবং নাগরিক সেবার মান উন্নত হবে। এছাড়া, দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য নগদ সহায়তা কার্যক্রম আরো কার্যকর করতে একটি ‘ডায়নামিক সোশ্যাল রেজিস্ট্রি’ চালু করা হবে।
বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ও প্রকল্পের টাস্ক টিম লিডার ধ্রুব শর্মা বলেন, ‘এই অর্থায়ন জনগণের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এটি বাংলাদেশের উচ্চাকাঙ্ক্ষী সংস্কার এজেন্ডা—অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ, আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা, সুশাসন ও সরকারি খাতের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।‘
তিনি আরো বলেন, ‘তথ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং উপকারভোগী নির্ধারণের পদ্ধতিকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে সরকারের সম্পদ যেন প্রকৃতপক্ষে দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে—বিশেষত অর্থনৈতিক সংকট বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়—তা নিশ্চিত করা যাবে।‘
এই অর্থায়নের মাধ্যমে ২০২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের মোট নতুন প্রতিশ্রুত অর্থের পরিমাণ দাঁড়াল ৩ দশমিক ০৭ বিলিয়ন ডলার। স্বাধীনতার পর থেকে বিশ্বব্যাংক এ পর্যন্ত বাংলাদেশকে ৪৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি অনুদান এবং সুদমুক্ত ও স্বল্পসুদে ঋণ দিয়েছে।