South east bank ad

ঋণের পাহাড় গত এক যুগে

 প্রকাশ: ১৪ অগাস্ট ২০২৪, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   কর্পোরেট

ঋণের পাহাড় গত এক যুগে

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন দেশ ছেড়ে পালান তখন সরকারি ঋণের পাহাড় রেখে গেছেন। এই ঋণ মূলত দেশি আর বিদেশি। আর এই মোট ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ১৮ লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি। বিগত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন তখন সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের গত প্রায় ১৫ বছরের শাসনকালেই সরকারের ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ১৫ লাখ ৫৮ হাজার কোটি টাকার বেশি। যা সরকারের মোট ঋণের প্রায় ৮৫ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
কেন এত ঋণের পাহাড়?

এই প্রশ্নে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, মূলত সরকার প্রতি অর্থবছরে উচ্চাভিলাষী বাজেট ঘোষণা করে। সেই বাজেটের একটি অংশ হচ্ছে পরিচালনা ব্যয়, অপরটি হচ্ছে উন্নয়ন ব্যয়। এসব ব্যয় মেটানোর জন্য দেশি ও বিদেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, ঋণের টাকা ব্যয়ের জন্য আবার অনেক ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। আর এই সময়ে ব্যাংক খাত থেকে প্রচুর টাকা বেরিয়ে গেছে। যার ফলে আজ ব্যাংক খাতে নেমে এসেছে স্থবিরতা।

এদিকে ঋণের টাকা থেকে অনেক টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে তথ্য প্রকাশ করেছে। তথ্য অনুযায়ী দেশ থেকে টাকা পাচারের পরিমাণ ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। আর এই পাচারের সময়টি হচ্ছে গত দেড় দশকে। তবে কারও কারও মতে, এরচেয়ে বেশি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। পাচার করা অর্থ কোথায় গেছে? এই প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, বেশি টাকা পাচার হয়েছে দুইটি দেশে। একটি হচ্ছে ইউরোপ। অপরটি হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তবে এ ছাড়াও টাকা পাচার হয়েছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, লন্ডন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে।

জানা গেছে, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের পর শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সে বছর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ মাসে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানোর জন্য অনেকবার ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ করা হলেও, খেলাপি ঋণের পরিমাণ তেমন কমেনি। বরং গত কয়েক বছরে অবলোপনসহ বিভিন্ন নীতিমালার উদারীকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ আর কয়েকজনের নীরব সায় দেওয়ার কারণে ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমেছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, প্রভাবশালী বলয়ের মধ্যে পড়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের পদত্যাগ করা গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। শুধু তাই নয়, ক্ষমতাসীন নেতাদের সন্তুষ্ট করতে গিয়ে বিভিন্ন ব্যাংকের অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ দিয়েছেন। যা অন্য ব্যাংকের ক্ষেত্রে বিমাতা আচরণ করেছেন। তিনি আরও জানান, গভর্নর কোনো কোনো ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের কোনো ধরনের পাত্তাই দেননি।

এমনকি সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি ঠায় দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। আবার ক্ষমতাসীন ব্যাংকের মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের জামাই আদর করেছেন। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন কর্মকর্তার কাছে দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর এক কর্মকর্তা জানান, অনেক ক্ষমতাসীন মালিকদের ব্যাংকের যথাযথভাবে অডিট করা হয়নি। দেশের ব্যাংক খাত থেকে নেওয়া নামে-বেনামে ঋণকে অবলোপন করা হয়েছে। এই ধরনের ঋণের পরিমাণ প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকা। তবে এর মধ্যে বেশিরভাগ টাকা দেশের বাইরে চলে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া হয়েছিল ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। বাকি টাকা অর্থাৎ ১ লাখ ১৫ হাজার ৮১০ কোটি টাকা ঋণ ছিল দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া। এই সময় থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সরকারের ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক খাতে বেসিক ব্যাংক লুণ্ঠন, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বিসমিল্লাহ কেলেঙ্কারির মতো বেশ কিছু বড় ব্যাংক লুটতরাজের ঘটনা ঘটেছে।

জানা গেছে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের এই পাঁচ বছরে ব্যাংকসহ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। যার পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর শেষেও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের মোট ঋণ ছিল ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। ২০২২ সালের শেষে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ লাখ ১৭ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণ দিতে ব্যর্থ হলে গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই নতুন টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দেয়। এর ফলে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১০ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়াও সরকার দেশের ব্যাংক, আর্থিক খাত, সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিয়েছে।

সরকারের ঋণের চাহিদা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার কারণে এর সুদহার দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বেড়ে যায়। ট্রেজারি বিল বন্ডের সুদহার এখন ১২ থেকে ১৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

জানা গেছে, গত কয়েক বছরে সরকার দেশি-বিদেশি উৎস থেকে অস্বাভাবিক হারে ঋণ নিয়েছে। ২০১০ সালে বিদেশি উৎস থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ২০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসে এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫৯ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সরকার ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশি ঋণের স্থিতি ৭৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।

BBS cable ad

কর্পোরেট এর আরও খবর: