তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় রফতানি খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশের পোশাক রফতানি ৪৭.৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।
তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানিকারক হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প (আরএমজি), যা বর্তমানে গুরুতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এই শিল্পটি দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ঘাটতি এ শিল্পকে বারবার বাধাগ্রস্ত করছে।
সেই চ্যালেঞ্জগুলো কী-
বিশ্ববাজার ও রফতানিতে মন্দা- ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক পোশাক আমদানি ২০২৪ সালের জানুয়ারি-এপ্রিলের মধ্যে ৬ শতাংশ কমেছে। ২০২৩ এর জুলাই থেকে ২০২৪ এর মে পর্যন্ত বাংলাদেশের আরএমজি রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ২.৮৬ শতাংশ।
উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি- গত ৫ বছরে উৎপাদন খরচ ৫০ শতাংশ বেড়েছে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮৬ শতাংশ, বিদ্যুতের ৩৪ শতাংশ ও ডিজেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে ৬৪ শতাংশ। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে ৫৬ শতাংশ।
বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট- দেশে বর্তমানে গ্যাস সংকট তীব্র পর্যায়ে চলে গেছে, ফলে সরবরাহ চেইন ব্যাহত হচ্ছে ও খরচ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে, ক্রেতারা জ্বালানি নিরাপত্তা ও সিকিউরিটি নিয়েও উদ্বিগ্ন।
অগ্রাধিকার
- নগদ অর্থ সহায়তা হিসেবে এক মাসের জন্য সফট ঋণ।
- ঋণ খেলাপিদের জন্য ৩-৬ কিস্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রবিধান পুনঃস্থাপন, যাতে করে এই কিস্তির মধ্যেই খেলাপিরা ঋণ পরিশোধ করতে পারেন তা নিশ্চিত করা।
- ঋণ খেলাপিদের জন্য অন্তত ৩ মাসের জন্য ইউটিলিটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করা।
- এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যবসা-বান্ধব করার জন্য প্রয়োজনীয় নীতি সংশোধনের জন্য টাস্ক ফোর্স।
- পাওয়ার সিকিউরিটি এবং পাওয়ার প্রাইসিং।
- টেক্সটাইল বর্জ্য (ঝুট) নিষ্পত্তিতে বাহ্যিক প্রভাবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।
দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলো-
স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অনেক দেশে তার রফতানির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার উপভোগ করেছে, বিশেষ করে আরএমজি রফতানিতে দ্রুত বৃদ্ধিতে অবদান রেখেছে (যা এখন পর্যন্ত বার্ষিক প্রায় ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে)। ফলে যখন স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হবে, তখন বাংলাদেশ অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার হারাতে পারে।
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তীর্ণ হলে প্রধান যে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে- গ্লোবাল এফটিএ (মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি) ও আরটিএতে অগ্রাধিকার হারাবে। প্রকৃতপক্ষে, গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষর করা এখনও বাংলাদেশের জন্য একটি দূরবর্তী সম্ভাবনা, কারণ অনেক দেশই এই ধরনের চুক্তিতে যেতে আগ্রহী নয়।
এদিকে, ডিকার্বনাইজেশন সহ ইএসজি ও এইচআরডিডির উপর অগ্রাধিকার দেওয়া দেশের পোশাক শিল্পের জন্য বড় এক চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে ২১.৮ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে।
নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে পরিবেশগত, সামাজিক এবং শাসন- ইএসজির ওপর অগ্রাধিকার আরোপ করতে হবে। যেহেতু বাংলাদেশ বিশ্বের সঙ্গে আরো বেশি সংযুক্ত হচ্ছে এবং দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও দিন দিন বাড়ছে, তাই ব্যবসায়ের জন্য ইএসজি কমপ্লায়েন্স বাধ্যতামূলক হয়ে উঠছে।
অন্যদিকে, এইচআরডিডির ক্ষেত্রে মানবাধিকার এবং পরিবেশগত যথাযথ অধ্যবসায়ের প্রক্রিয়া হিসেবে বোঝানো হয় যার মাধ্যমে কোম্পানিগুলো দক্ষতার সাথে তাদের কার্যকলাপ বা তাদের সহায়ক, উপ-কন্ট্রাক্টর এবং সরবরাহকারীদের নেতিবাচক প্রভাবগুলি সনাক্ত করতে, প্রতিরোধ করতে, প্রশমিত করতে হিসেব রাখতে পারে। তাই, পোশাক শিল্পে উন্নয়নের মানদন্ড রক্ষা করতে ডিকার্বনাইজেশন সহ ইএসজি ও এইচআরডিডির উপর অগ্রাধিকার দিতেই হবে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পণ্য ও রফতানি ঘনত্বের উপর জোর দিতে হবে। ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ইউএনসিটিএডি) এর পণ্য বাণিজ্য পরিসংখ্যানে প্রকাশিত রফতানি ঘনত্ব সূচকের তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের রফতানি ঘনত্বের অনুপাত ছিল ০.৪০, যা স্বল্পোন্নত দেশের ০.১৮ এর তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি এবং উন্নয়নশীল দেশের গড় (০.০৯) থেকে চার গুণ বেশি।
আধুনিক উৎপাদনশীল বিশ্বে টেক্সটাইল ও পোশাক শিল্প যে বিষয়গুলো নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় তার মধ্যে রয়েছে দক্ষতা, টেকসই ও ক্লায়েন্টের চাহিদা অনু্যায়ী দ্রুততার সঙ্গে সাড়া দেওয়া। কারণ প্রযুক্তিনির্ভর গ্রাহকরা পরিবেশ সচেতন এবং পরিবেশবান্ধব পণ্যের জন্য অর্থ খরচ করতে বেশি আগ্রহী। যার ফলে টেক্সটাইল ও পোষাক শিল্পকে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ত্রিমুখী পদ্ধতির ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে খুবই কৌশলের সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে। টেক্সটাইল ও পোশাক কারখানাগুলোর পক্ষে কেবল সেরা পণ্য এবং সময়মতো সরবরাহ করা নয়, দীর্ঘমেয়াদী স্থায়িত্ব বজায় রাখাও কঠিন হয়ে পড়েছে।
স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে রুপান্তর হতে বাংলাদেশের সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ-
শুল্ক-মুক্ত কোটা-মুক্ত (ডিএফকিউএফ) বাজারে প্রবেশাধিকার হারানো
এলডিসি থেকে মধ্যম আয়ের স্বীকৃতি অর্জনের পরও বাংলাদেশকে আগামী ২০২৭ সাল পর্যন্ত শুল্ক ও কোটা মুক্ত বাজার সুবিধা অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছিল যুক্তরাজ্য। দুই ধাপে তিন বছর করে বাংলাদেশের পণ্য যুক্তরাজ্যে রফতানিতে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা বা জিএসপি পাবে। কিন্তু যুক্তরাজ্যে জিএসপির প্রবেশাধিকার হারিয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অন্যতম বৃহত্তম বাজার যুক্তরাজ্যেও কমেছে পোশাক রফতানি। চলতি বছরের জানুয়ারি-অক্টোবর মেয়াদে বাংলাদেশ থেকে এই বাজারে পোশাক রফতানি প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে ডলার ভ্যালুতে-৮.৯৮ শতাংশ। আর পরিমাণের ভিত্তিতে পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি কমেছে ৮.৮৩ শতাংশ।
ইউরোস্ট্যাটের তথ্যে জানা যায়, গত তিন বছরের মধ্যে ২০২৪ সালেই যুক্তরাজ্যের বাজারে পোশাক রফতানি সবচেয়ে বেশি কমেছে বাংলাদেশ থেকে। এর আগে ২০২১ সালে ৭.৭৪ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে ৩৫.৬৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও এবার নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮.৯৮ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানি ধারাবাহিকভাবে কমছে। গত বছর রফতানি কমেছিল ২৫ শতাংশ। গত ফেব্রুয়ারি শেষে রফতানি কমার হার দাঁড়ায় ১৯ শতাংশ। বাংলাদেশ নেতিবাচক ধারা থেকে বেরোতে না পারার কারণে অপর দুই প্রতিযোগী চীন ও ভিয়েতনাম এই বাজারে পোশাক রফতানিতে ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে।
প্রণোদনা তুলে নেয়ায় শঙ্কায় দেশের গার্মেন্টস শিল্প-
গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায়, তৈরি পোশাকসহ রফতানি পণ্যের ওপর সরকারি নগদ প্রণোদনা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হবে। বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্যের খাত, তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকরা বলছেন, এমন সিদ্ধান্তের ব্যাপক প্রভাব পড়তে পারে এই খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ওপর। হারিয়ে যেতে পারে বিকল্প বাজার তৈরির সম্ভাবনা।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যেহেতু বেশ সময় নিয়ে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হচ্ছে, তাই এটি খুব বেশি একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারবে না। বরং ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা-নির্ভর এই কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা-নির্ভর বাজারের দিকে ঝুঁকতে হবে।
তৈরি পোশাক শিল্পে সম্ভাবনা
একটি সংকটাপন্ন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তৈরি পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বলে মনে করছে ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি কমে আসা, বৈশ্বিক খুচরা পর্যায়ের দোকানগুলো বিভিন্ন উৎসবে তাদের শীতকালীন পোশাকের মজুত বিক্রি করে ফেলায় সামনে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ বাড়তে পারে বলে মনে করছেন তারা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক সমস্যা কাটিয়ে উঠে চলতি বছরেই পোশাক খাতের ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মতো রফতানি গন্তব্যের প্রধান দেশগুলোর খুচরা পর্যায়ের দোকানগুলো ব্ল্যাক ফ্রাইডে, সাইবার মানডে, ক্রিসমাস ডে ও বক্সিং ডের মতো বিভিন্ন উৎসবের কল্যাণে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে প্রচুর পণ্য বিক্রি করতে পেরেছে বলে জানান পোশাক খাত সংশ্লিষ্ট এবং বৈশ্বিক ক্রেতাদের প্রতিনিধিরা।
২০২৩ সালের ডব্লিউটিওর তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববাজারের ৭.৪ শতাংশ শেয়ারের অধিকারী বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। বৈশ্বিক বাজারে আরও প্রবেশের সুযোগ রয়েছে, যার জন্য একটি ভিন্ন কৌশলগত পদ্ধতির প্রয়োজন।
২০২২-২৩ অর্থ বছরে বাংলাদেশের রফতানি পণ্য থেকে আয়-
ট্রাউজার্স - ১৪.৯৫ বিলিয়ন ডলার
টি-শার্ট এবং বোনা শার্ট - ১০.৮৬ বিলিয়ন ডলার
সোয়েটার - ৫.৯৪ বিলিয়ন ডলার
শার্ট এবং ব্লাউজ - ৩.৬৫ বিলিয়ন ডলার
আন্ডারওয়্যার - ২.৩৭ বিলিয়ন ডলার
২০২২-২৩ অর্থ বছরে বাংলাদেশের মোট আরএমজি রফতানি আয়ের মধ্যে ৫টি পণ্য থেকে শেয়ারের পরিমাণ ৮০.৪০ ভাগ। (সূত্র: রফতানি ব্যুরো)
উত্তরণের উপায়-
১. বাজারে বিকল্প পথ খুঁজতে হবে।
২. পণ্য ও ফাইবারে বৈচিত্র্যকরণ আনতে হবে।
৩. দক্ষতা বৃদ্ধি।
৪. ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজকে শক্তিশালী করা।
৫. সার্কুলার অর্থনীতি এবং ডিকার্বনাইজেশন।
৬. রিস্কিলিং এবং আপস্কিলিং