পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে তৎপরতা শুরু হলেও সাফল্য অজানা
বাংলাদেশ থেকে গত দেড় দশকে মোট কত অর্থ পাচার হয়েছে, সে বিষয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান তৈরি করা সম্ভব হয়নি। জিএফআইয়ের হিসাবে, ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৯ হাজার কোটি বা ৯০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে ৬৪০ কোটি ডলার। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এ গড় বেড়ে ৮২৭ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৯ সালের পর দেশ থেকে অর্থ পাচার আরো বেড়ে যায়।
তিউনিসিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে নিন্দিত স্বৈরশাসক জাইন এল আবিদিন বেন আলি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন গণ-অভ্যুত্থানে। প্রায় দুই যুগ দেশটির ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার পর ২০১১ সালে ‘জেসমিন বিপ্লবের’ মধ্য দিয়ে পতন ঘটে তার সরকারের। বেন আলি এবং তার পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনদের বিরুদ্ধে তিউনিসিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের অভিযোগ ছিল। পাচারকৃত এ অর্থ ফেরাতে উদ্যোগী হয় তিউনিসিয়ার বেন আলি-পরবর্তী সরকার। তবে অনেক পরিশ্রম ও বিপুল অর্থ ব্যয়ের পর এতে সাফল্য মিলেছে প্রত্যাশার তুলনায় সামান্য।
সুইস ব্যাংকগুলোয় বেন আলির পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে মামলা করেছিল তিউনিসিয়া। বেন আলির পাশাপাশি তার পরিবার, জামাতা ও অন্য সহযোগীদের নামেও মামলা হয়েছিল। সুইজারল্যান্ডের আদালতে দায়েরকৃত মামলায় তিউনিসিয়ার পক্ষভুক্ত হওয়ার আবেদনের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে ২০১২ সালে সেটি খারিজ হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে তিউনিসিয়া সরকার সুইজারল্যান্ডে সে সময় চলমান মামলা ও ব্যাংকের নথি পর্যালোচনার সুযোগ পায়। একই সঙ্গে দেশটির পক্ষে সুইস ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক লেনদেনগুলো শনাক্ত করারও সুযোগ তৈরি হয়। এসব সুবিধা ও দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার পরও ২০২১ সালে এসে তিউনিসিয়ার
দায়ের করা বেশ কয়েকটি মামলা খারিজ হয়ে যায়। দাবীকৃত অর্থের বিপরীতে খুব সামান্যই ফেরত আনতে সক্ষম হয় দেশটি।
বেন আলির মতোই ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার টানা দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটিসহ (জিএফআই) বিভিন্ন সংস্থার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশ থেকে অন্তত ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৪৯ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত ১৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা (বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী প্রতি ডলারে ১২০ টাকা ধরে)। বিদেশে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে জোর তৎপরতা শুরু করেছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।
পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে আন্তর্জাতিক আইনি প্রতিষ্ঠান নিযুক্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতিনিধি ছাড়াও বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠকের প্রক্রিয়া চলছে। আর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা চাচ্ছেন।
আর্থিক খাতের নীতিনির্ধারকরা বিভিন্ন সময়েই পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে সরকারের জোর তৎপরতা শুরুর কথা জানিয়েছেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসে গত ২৮ অক্টোবর প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘শুধু ব্যাংক দখলের মাধ্যমেই বাংলাদেশ থেকে আনুমানিক ২ লাখ কোটি টাকা (১৬ দশমিক ৭০ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৬৭০ কোটি ডলার) পাচার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে নতুন শেয়ারধারীদের ঋণ দেয়া ও আমদানির অতিরিক্ত খরচ দেখানোর মতো পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। লোপাট হওয়া ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডাররা দেশ থেকে যে অর্থ দুবাই, সিঙ্গাপুর বা অন্যান্য স্থানে পাচার করে নিজেদের আয়ত্তে রেখেছেন, তা উদ্ধারের চেষ্টায় আন্তর্জাতিক আইন প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হবে। শেখ হাসিনার সময়ে দখলকৃত প্রায় ১২টি ব্যাংকের অবস্থা নিরীক্ষা করার পর বাংলাদেশ চুরি হওয়া অর্থ উদ্ধারের পদক্ষেপ নেবে। আমরা এ নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেশে ও দেশের বাইরের আদালতে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করতে চাই।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়াটি বেশ কঠিন ও দুঃসাধ্য। গত ২ নভেম্বর এক সেমিনারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকিং চ্যানেল ছাড়াও চালান জালিয়াতি, দেশে কর্মরত বিদেশী কর্মীদের পাঠানো অর্থ, ভিসা ও অভিবাসন বাবদ, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) এবং হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়েছে। পাচার হওয়া এ অর্থ ফেরত আনা সম্ভব। তবে এটি অত্যন্ত কঠিন এবং প্রায় অসম্ভবের কাছাকাছি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত একটি দৃষ্টান্ত আছে, সেটি হলো সিঙ্গাপুর থেকে। দেশটি থেকে ২০০৭ সালে পাচার হওয়া অর্থ ফেরতের উদ্যোগ নেয়া হয় এবং পারস্পরিক আইনি সহায়তার মাধ্যমে ২০১৩ সালে ৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ৯৩০ কোটি ডলার ফেরত আনা সম্ভব হয়েছিল।’
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাও বলছে, বিশ্বের যেকোনো দেশ থেকে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ উদ্ধার প্রক্রিয়াটি খুবই জটিল ও সময়সাপেক্ষ বিষয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার আরো বেশি কঠিন। অর্থ পাচারের নথিপত্র সংগ্রহ, পাচারের গতিপথ নির্ধারণ, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও পাচার হওয়া দেশের আইনগত প্রক্রিয়া শেষ করতে সর্বনিম্ন পাঁচ বছর সময় লাগবে। আর বিষয়বস্তু ও প্রক্রিয়া জটিল হলে কোনো কোনো মামলা শেষ হতে ১৫-২০ বছরও সময় লাগতে পারে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান বলেন, ‘অর্থ পাচার বিষয়ে তদন্ত, মামলা, বিচার প্রক্রিয়া, আপিল-রিভিশনসহ অন্য সব প্রক্রিয়া শেষ করতেই সর্বনিম্ন তিন থেকে অগণিত বছর লাগতে পারে। দেশের প্রক্রিয়া শেষ করে তবেই শুরু হবে বিদেশ থেকে অর্থ ফেরত আনার কার্যক্রম। সে ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট দেশের আইনগত প্রক্রিয়া মানতে হবে। তবে সরকার চাইলে অধ্যাদেশ জারি করে মামলা ছাড়াই বিএফআইইউ কিংবা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার সুযোগ দিতে পারে। আবার পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে পৃথক আইনও প্রণয়ন করতে পারে। এটি হলে দেশের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া শেষ করতে সময় কম লাগবে।’
এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চুরির মামলাকে উদাহরণ হিসেবে সামনে আনছেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হয়। বিশ্বের সর্ববৃহৎ এ সাইভার হ্যাকিংয়ের ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ও ফিলিপাইনের আদালতে মামলা দায়ের করে। কিন্তু সে মামলার বিচার প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয়নি। আবার রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংক বাদী হয়ে মতিঝিল থানায়ও মামলা দায়ের করেছিল। মামলার আট বছর পেরোলেও এখনো তদন্ত প্রতিবেদনও জমা পড়েনি।
বাংলাদেশে অর্থ পাচারের মতো আর্থিক অপরাধ প্রতিরোধ ও তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা হলো বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত অর্থ পাচার ঠেকাতে খুব একটা সাফল্য পায়নি সংস্থাটি। বরং সংস্থাটির কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে গত দেড় দশকে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হলেও এখন পর্যন্ত পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার নজির মাত্র একটি। সিঙ্গাপুরের আদালতের নির্দেশে ২০১২ ও ২০১৩ সালে ফেয়ারহিল নামের একটি পরামর্শক সংস্থার নামে ব্যাংকে গচ্ছিত থাকা প্রায় ১ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরের আদালতের নির্দেশনার পরও মামলাটি নিষ্পত্তি হতে সময় লেগেছে প্রায় তিন বছর।
বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার রুখতে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হিসেবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে ২৯টি অপরাধ। এর মধ্যে চতুর্দশ অবস্থানে রয়েছে দেশী ও বিদেশী মুদ্রা পাচার। মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধগুলোর অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে পারে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), পরিবেশ অধিদপ্তর, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। আর সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের দায়িত্ব বিএফআইইউর।
পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত পক্ষগুলো বলছে, দেশ থেকে কোনো অর্থ পাচার হয়েছে কিনা, সেটি খুঁজে বের করার প্রাথমিক দায়িত্ব বিএফআইইউর। আর্থিক এ গোয়েন্দা সংস্থাটির পক্ষ থেকে পাচারকৃত অর্থের গতিপথসংক্রান্ত নথিপত্র চূড়ান্ত হতে হবে। এরপর সে নথিপত্রের ভিত্তিতে তদন্ত করবে দুদক, এনবিআর বা সিআইডি। তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ হলে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হবে। মামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষে আদালতের রায় পাওয়ার পরই বিদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার সুযোগ তৈরি হয়।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের লিগ্যাল অ্যান্ড প্রসিকিউশন উইংয়ের সাবেক মহাপরিচালক মঈদুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘হাইকোর্টের আদেশে দুদক সব ধরনের মানি লন্ডারিং অপরাধ তদন্ত করতে পারে। পাচার হওয়া সম্পদ ফেরত আনার জন্য আদালতের আদেশ লাগবে। নগদ অর্থ হলে ফ্রিজ ও সম্পদের ক্ষেত্রে ক্রোক আদেশ দেবেন আদালত। ফ্রিজ ও ক্রোক আদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশে পাঠাতে হবে। আদালতের আদেশ ওই দেশ কার্যকর করবে। বিচার শেষে আদালতের পক্ষ থেকে নগদ অর্থ ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করবে। বাজেয়াপ্ত আদেশও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশে পাঠাতে হবে। তারপর টাকা ও সম্পদের মূল্য ফেরত পাঠাবে ওই দেশ। আদালতের আদেশ ছাড়া সংশ্লিষ্ট দেশ আমলে নেয় না। তবে সরকারের সঙ্গে সরকারের (জিটুজি) বোঝাপড়া থাকলে আদালতের আদেশ ছাড়াও অর্থ ফেরত আনা যায়।’
পাচারকৃত অর্থ ফেরাতে গত দেড় দশকে বিএফআইইউ কিংবা দুদককে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। এ ব্যর্থতার কারণ জানতে চাইলে দুদকের মানি লন্ডারিং অনুবিভাগের সাবেক মহাপরিচালক মো. মাহমুদুল হোসাইন খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ইউএনওডিসির সদস্য হিসেবে যে ধরনের সহযোগিতা পাওয়ার কথা ছিল, অন্য দেশগুলো থেকে সে সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। এ কারণে প্রত্যাশিত ফলও আসেনি।’
আগে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের জনপ্রিয় গন্তব্যগুলোর মধ্যে ছিল সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ করস্বর্গ খ্যাত কিছু দ্বীপরাষ্ট্র। তবে গত কয়েক বছরে অর্থ পাচারের গন্তব্যে পরিবর্তন আসে। বাংলাদেশী পাচারকারীরা সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বা পূর্ব ইউরোপের মতো দেশগুলোকে অর্থের নিরাপদ গন্তব্য হিসেবে বেছে নেন। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা, পুলিশসহ সরকারি চাকরিজীবী, ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান-পরিচালক, ঊর্ধ্বতন ও মাঝারি স্তরের কর্মকর্তাও দেশ থেকে অর্থ পাচার করেছেন।
বাংলাদেশ থেকে গত দেড় দশকে মোট কত অর্থ পাচার হয়েছে, সে বিষয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যানও এখনো তৈরি করা সম্ভব হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান জিএফআইয়ের হিসাবে, ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৯ হাজার কোটি বা ৯০ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে ৬৪০ কোটি ডলার। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে এ গড় বেড়ে ৮২৭ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৯ সালের পর দেশ থেকে অর্থ পাচার আরো বেড়ে যায়। তবে ২০১৪-২০১৮ সময়ের গড়কে বিবেচনা করা হলে ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে অন্তত ৪ হাজার ১৩৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। সে হিসাবে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় কমপক্ষে ১৪ হাজার ৯২০ কোটি বা ১৪৯ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশী মুদ্রায় পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় অন্তত ১৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা।
বিএফআইইউর পক্ষ থেকে গত বছর অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে আদালতে ৪৯ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হওয়া দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্ক, জাপান, হংকং, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, ভারত, শ্রীলংকা, কুয়েত, বেলজিয়াম ও তাঞ্জানিয়া।
পাচারকৃত অর্থ বিদেশের কোনো ব্যাংকে গচ্ছিত না রেখে স্থাবর সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করা হলে তা ফেরত আনা আরো কঠিন হয়ে পড়ে বলে জানালেন বিএফআইইউর সাবেক প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে বিদেশে পাচারকৃত কোনো অর্থ ফেরত আনতে হলে সর্বনিম্ন পাঁচ বছর সময় লাগবে। পাচারকৃত অর্থ যদি বিদেশের কোনো ব্যাংকে গচ্ছিত থাকে তাহলে সেটি জব্দ করা বা ফেরত আনা কিছুটা সহজ। কিন্তু পাচারকৃত অর্থে যদি বাড়ি-গাড়ি তথা স্থাবর সম্পত্তিতে বিনিয়োগ করা হয়, তাহলে সেটি ফেরত আনা আরো বেশি দুরূহ। এক্ষেত্রে কত বছর সময় লাগবে, সেটি বলাও কঠিন।’
তিনি বলেন, ‘অর্থ পাচার প্রতিরোধে এখন বৈশ্বিক বিভিন্ন আইন ও সংস্থা রয়েছে। বিএফআইইউ সেসব সংস্থা থেকে পাচারকৃত অর্থের তথ্য পেলেও সেগুলো আদালত বা অন্য কোথায়ও উপস্থাপনে বিধিনিষেধ আছে। কোনো দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার কার্যক্রম শুরু করতেই দেশের আদালতের রায় লাগবে। সরকার যদি সব পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে সম্মিলিত উদ্যোগ নেয়, তবেই পাচারকৃত অর্থের কিছু হলেও ফেরত আনা সম্ভব হবে।’
দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে সুইজারল্যান্ড থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার সফল নজির তৈরি করতে পেরেছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু। তবে এর আগে দেশটিকে প্রমাণ করতে হয়েছে এ অর্থ পাচারকৃত এবং তা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত। ক্যান্টন অব জুরিখের এক্সামিনিং ম্যাজিস্ট্রেটস অফিস ফোরের এক অনুসন্ধানে উঠে আসে, পেরুভিয়ান গোয়েন্দা সংস্থার সাবেক প্রধান ভ্লাদিমিরো মন্তেসিনো সামরিক কেনাকাটায় অনৈতিক সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে পাওয়া ঘুসের ৪ কোটি ৯৫ লাখ ডলার সুইজারল্যান্ডে পাচার করেছেন। দুর্নীতি ও পাচার প্রমাণ হওয়ায় ২০০২ সালের জুনে সুইজারল্যান্ডের এক আদালত ওই অর্থ পেরুতে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেন।