South east bank ad

তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উন্নয়নের রোল মডেল

 প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   অটোমোবাইল

বিডিএফএন টোয়েন্টিফোর.কম

ধর্মের ভিত্তিতে উপমহাদেশে দুটি দেশের জন্ম হলো। ভারত আর পাকিস্তান; এর মাঝে 'অদ্ভুত' এই রাষ্ট্রটির আবার দুটি ভাগ। এক অংশ থেকে আরেক অংশের দূরত্ব ১৩০০ মাইল। কিন্তু দূরত্বটা যে কেবল ভৌগোলিক ছিল, তা নয়। দূরত্ব ছিল সর্বক্ষেত্রেই। সেটা যেমন প্রশাসনিক, তেমন অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১- এই ২৪ বছর পশ্চিম পাকিস্তানের চাপিয়ে দেওয়া বৈষম্যমূলক আচরণের ভারে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ে। সামাজিক-প্রশাসনিক তো রয়েছেই, তবে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে পর্বতসম অর্থনৈতিক বৈষম্য বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে বিরাট প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।

বঞ্চিত হতে হতে মানুষ ঘুরে দাঁড়ায়। অধিকার নিয়ে সজাগ হতে থাকে। এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতার বীজ বপনের। আর সেই কাজটি করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি মানুষকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। এভাবেই মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় অধিকার আদায়ের স্পৃহা। জেগে ওঠে বাঙালি। হাতে অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের বয়স এখন ৫০। চলতি বছর বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি আমরা। বিবিএস ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ২৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। জিডিপির আকার ছিল ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। আর মাথাপিছু আয় মাত্র ১২৯ ডলার। দারিদ্র্যের হার ৭০ শতাংশ। কিন্তু বিজয় অর্জনের পর পঞ্চাশ বছর বয়সী বাংলাদেশের রপ্তানি আয় বহুগুণে বেড়ে মিলিয়ন ডলার থেকে এসেছে বিলিয়ন ডলারের ঘরে। ২০২০ সালের হিসাবে ৩৯.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বজুড়ে করোনা পরিস্থিতি বিরাজ সত্ত্বেও ২০২১ সালে তা আরও বেড়েছে। জিডিপির আকার ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরের তুলনায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসে বেড়েছে ৩৬৯ গুণ। পরিমাণে যা প্রায় ২৭ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৬ গুণের বেশি। অর্থাৎ ২ হাজার ৫৫৪ ডলার। দারিদ্র্যের হার কমে দাঁড়িয়েছে ২০.৫ শতাংশ।

একসময় ভঙ্গুর অর্থনীতির এই দেশটিকে 'তলাবিহীন ঝুড়ি' হিসেবে আখ্যা দিলেও এখন বলা হচ্ছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে সেই দেশটি হতে যাচ্ছে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। এরই মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে জায়গা করে নিয়েছে। বেড়েছে শিক্ষার হার, গড়ে উঠেছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান। অধিকাংশ অবকাঠামো যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধেরও ব্যাপক পরিবর্তন সাধন হয়েছে। বাস্তবায়িত হয়েছে 'ডিজিটাল বাংলাদেশ'। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের পরিকল্পনায় বাস্তবায়ন হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার 'ডিজিটাল বাংলাদেশ'। যার সুফল ভোগ করছে দেশর আপামর মানুষ।

একটি শোষণবিহীন ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য। ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই জাতির পিতা দেশে ফিরে শাসন ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ নেন। সংবিধানে চারটি মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা অন্তর্ভুক্ত হয়। যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের দর্শন স্বীকৃতি পায়। এ ছাড়া বাঙালি জাতীয়তাবাদের উল্লেখ করায় আমাদের জাতিগত ঐক্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, শোষণবিহীন কল্যাণ রাষ্ট্র বিনির্মাণই ছিল আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধানতম উদ্দেশ্য। জাতির পিতা সে লক্ষ্যেই নতুন দেশের যাত্রা শুরু করেছিলেন। জাতির পিতা মাত্র সাড়ে তিন বছর দেশ গড়ার সুযোগ পান। এই সময়ের মধ্যেই এমন কোনো খাত নেই, তিনি এর ভিত্তি গড়ে দিয়ে যাননি। এর মাঝেই জাতির জীবনে নেমে আসে ১৫ আগস্টের কালো অধ্যায়। বাঙালির জীবনে নেমে আসে আরেক অমানিশা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয় দেশ। পঁচাত্তরের পর রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সহাবস্থানের পরিবেশ বিনষ্ট হয়। বহুধাবিভক্ত রাজনৈতিক পরিমণ্ডল সহিংস সংঘাতের উৎসে পরিণত হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জাতিগত ঐক্যের ওপর আসে নানামুখী আক্রমণ। জাতীয় সংগ্রাম ও ইতিহাসকে দলীয় মোড়কে উপস্থাপনেরও চেষ্টা করা হয়। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে সার্বভৌমত্বের ওপর চাপ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নানামুখী চাপের মুখে থাকার কারণে ব্যাহত হয় সুশাসন। দখলদারি আর স্বৈরাচারের শাসনে চারদিকে নেমে আসে অরাজকতা। স্বাধীনতাবিরোধী ও পঁচাত্তরের কুশীলবরা সবসময়ই বাংলাদেশের উন্নয়ন কিংবা এগিয়ে যাওয়া সহজভাবে নিতে পারেনি। যার ফলে বারবারই হোঁচট খেয়েছে লক্ষপ্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ। এই গোষ্ঠী বাদে বাংলাদেশে সবসময়ই জাতীয় ঐক্য বিরাজ করেছে। জাতীয় ঐক্যের ফলই হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম।

'৯০-এর দশকে একনায়কতন্ত্রের পতন ঘটে। বাংলাদেশ হাঁটে গণতন্ত্রায়নের পথে। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুকন্যা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এখন অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে লাল-সবুজের বাংলাদেশ। উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ মানুষের অধিকার আদায়ে হয়ে ওঠে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে। গণতান্ত্রিক পরিবেশের পক্ষে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার পক্ষে কার্যক্রম চালায়। মানুষও তা গ্রহণ করে। দেশে বিরাজ করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। যার ফলে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। বিনিয়োগের উৎকৃষ্ট গন্তব্য। বিজয়ের ৫০ বছর পর সম্ভব হয়েছে জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, যা সম্মুখে থেকে জনগণকে প্রেরণা জোগায়।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হচ্ছে, সেই জায়গা থেকে এখনও বাংলাদেশ কিছুটা দূরে। বহুদলীয় গণতন্ত্র নির্মাণের জন্য রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে যে পুনর্গঠনের দরকার ছিল, তা সেভাবে আমরা লক্ষ্য করি না। ফলে এখনও এই দেশে স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী দম্ভভরে ঘুরে বেড়ায়। তাদের অপচেষ্টা রুখে দিতে বিপুল তরুণ জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে অংশগ্রহণমূলক কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে। আমাদের উত্তর প্রজন্মের ঐক্য, শ্রদ্ধা ও জ্ঞান সন্দেহাতীতভাবে অপ্রতুল। তাদের এই স্পৃহাকে কাজে লাগাতে হবে। তবেই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে আমরা বিচ্যুত হবো না। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু সেদিকে বাংলাদেশের সন্তোষজনক গতি সঞ্চারিত হয়নি। এত উন্নয়নের মাঝেও আয় বৈষম্য দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। উন্নয়নের সুফল ভোগ করছে মুষ্টিমেয় একটি গোষ্ঠী। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ আজও গুণগত শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান ও সুশাসন থেকে বঞ্চিত। শিক্ষার হার বাড়লেও গুণগতভাবে তার প্রভাব কম। গত বছর ইউএনডিপি কর্তৃক প্রকাশিত 'গ্লোবাল নলেজ ইনডেপ ২০২০'-এ বাংলাদেশ ১৩৮টি দেশের মধ্যে ১১২-এ অবস্থান করছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে পিছিয়ে। তবে আমার কথা প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নে উদ্যোগ নিয়েছেন। গড়ে তুলেছেন নতুন নতুন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তথা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার রোডম্যাপ তৈরি করে দিয়েছেন। তার রোডম্যাপ অনুযায়ী কাজ করে যেতে হবে আমাদের। নিজেদের জায়গা থেকে ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভিন্নমতকে স্বীকার করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ সম্ভব হয়েছিল জাতীয় ত্যাগের ফলেই। যুদ্ধের দিনগুলোর সকল অর্জন যেমন জাতীয় অর্জন ও সকল ত্যাগ জাতীয় ত্যাগ। এই দেশটা আমাদের সবার। সবার নিজ নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতি পালনের অধিকার রয়েছে। ইসলামের মূল চেতনাও তা-ই। সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। এ কথাটি ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণেও উল্লেখ করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি বলেছিলেন, 'মনে রাখবেন! শত্রু বাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটপাট করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আমাদের ওপর। আমাদের যেন বদনাম না হয়।'

বিজয়ের ৫০ বছরেও যেন বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের এই উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিক। একটি ভাষণকে অবলম্বন করে স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ বাঙালি জীবন উৎসর্গ ও কয়েক লাখ মা-বোন সল্ফ্ভ্রম বিসর্জন দেন। বিনিময়ে আমরা পাই লাল-সবুজের বাংলাদেশ।

লেখক: সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ।
/জেটএন/

BBS cable ad

অটোমোবাইল এর আরও খবর: