South east bank ad

মরব কি বাঁচব ভাবতাম না

 প্রকাশ: ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   অটোমোবাইল

বিডিএফএন টোয়েন্টিফোর.কম

আমার বাড়ি বড়বালা ইউনিয়নে। বাবা একজন কৃষক। একমাত্র সন্তান ছিলাম আমি। যুদ্ধের সময় আমি ইন্টারে পড়ি। পরীক্ষা সামনে, তখন দেশে গণ্ডগোল। আন্দোলন-মিছিল। বঙ্গবন্ধু তখন আন্দোলনের ডাক দিলেন, তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো। তখন আমাদের গ্রামের লোকজন বলতে থাকল, তোমরা ছাত্র মানুষ, খানসেনারা তোমাদের ধরবে। আড়ালে-আত্মগোপনে চলে যাও। তখন গ্রামের কয়েক যুবক বন্ধুদের নিয়ে আলোচনা করি। ২৬ মার্চ ভারতে চলে যাই হিলি হয়ে। রেললাইন পার হয়ে পাকা সড়কে উঠি। একটি গাড়ি এসে থেমে বলল, কোথায় যাবেন? বললাম, বালুরঘাটে। আমরা বালুরঘাটে গিয়ে পৌঁছে দেখি সেখানে অনেক মানুষ। সেখানে হালকা নাশতা করে নিলাম। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভাই, মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং কোথায় নেব। তারা একটি ঘর দেখিয়ে বলল, ওখানে যান, এমপি ও আওয়ামী লীগের লোকজন আছে। আমরা তাদের গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেব। তারা বলল, আগামীকাল আমাদের ট্রেনিং নিতে পাঠিয়ে দেবে। সে রাতে বালুরঘাটে ছিলাম। পরদিন আমাদের পাঠানো হলো গঙ্গারামপুরে। সেখানে এক মাস ট্রেনিং করলাম। এরপর আমাদের পাঠানো হলো পথিরামপুরে। সেখানে ১৫ দিন ছিলাম। উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য পানিঘাটা শিলিগুড়ি পাঠানো হলো আমাদের। সেখানে সামরিক বাহিনীর অধীন প্রশিক্ষণ নিই। ট্রেনিংয়ে কেটে গেল ২৯ দিন। আমার ভারতীয় বডি নম্বর ছিল ৫০৭৩। ট্রেনিং শেষে একদিন রাতে আমাদের একটি মগবাটি, কাপড় ও থালা দিয়ে সামরিক বাহিনীর ট্রাকে করে পথিরামপুরে নিয়ে আসা হলো। সেখানে গ্রুপ করে আমখাওয়া সীমান্ত এলাকায় পাঠানো হলো। আমাদের ১০ থেকে ১২টি গ্রুপ ছিল। আমরা তিনটি গ্রুপ আমখাওয়া বর্ডার হয়ে ফুলবাড়ির দক্ষিণ দিকের নির্জন এলাকা দিয়ে দেশে ঢুকি। রেললাইন পার হয়ে এলাম শালবনে। জঙ্গলের ভেতরে কাটে দিনটা। ভোর হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিই কোনদিকে যুদ্ধ করতে যাব। তিনটি গ্রুপের একটি গ্রুপ সৈয়দপুরের দিকে, অন্য গ্রুপ পাবর্তীপুরে এবং আমার গ্রুপটির সদস্যরা বদরগঞ্জের শালবনে রয়ে গেলাম। আমরা গেরিলা যুদ্ধ করতাম। গেরিলা যুদ্ধ হতো রাতে। দিনের বেলায় আমরা ঝাড়-জঙ্গল কিংবা আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকতাম। আমার সঙ্গে সহযোদ্ধা ছিল সাত্তার, আবুল, করিম, নুরুজ্জামান, সাঈদ, জালালসহ অনেকে। প্রথম গেরিলা যুদ্ধ করি পীরগাছা হয়ে বোনারপাড়ায়। আমাদের একটি গ্রুপ ছিল, যারা রেকি করত। তারা রেকি করে আমাদের জানাত। আমরা সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিয়ে শত্রুদের ওপর গেরিলা হামলা চালাতাম।

এক রাতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বলল, মিঠাপুকুর শুকুরের হাটে খানসেনা-রাজাকাররা অবস্থান করছে। আমরা রাতে হামলার জন্য যাই। শত্রুপক্ষ আমাদের উপস্থিতি টের পায়। গুলিবিনিময় চলে কিছুক্ষণ। তারা পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করলেও আমরা একজনকে ধরে ফেলি। এরপর আমরা বালুয়ার দিকে ভোর রাতে অপারেশনে যাই। আমাদের আসার খবর টের পেয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। তারা বন্দুক তাক করে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। যখন বালুয়া বন্দরে উপস্থিত হই, তখন পাকিস্তানি সেনা গুলি করতে শুরু করে। একটি গুলি এসে আমার ডান পায়ে লাগলে আমি পড়ে যাই। গুলি একদিক দিয়ে ঢুকে আরেক দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। তখন সাবেক এমপি আবুল কালাম আজাদ আমার সঙ্গে ছিল। তিনি গামছা দিয়ে পা বেঁধে দিয়ে আমাকে উদ্ধার করে জঙ্গলে নিয়ে যায়। সেখানে প্রথম দিন চিকিৎসক আমার পা ওয়াশ করে ব্যান্ডেজ করে দেয়। এর এক মাস পর আমি সুস্থ হয়ে আবার যুদ্ধে যাই।

একদিন রেকি টিম দল খবর দেয় নাগেরহাটে খান সেনাদের ১০-১২ জন রয়েছে। আমরা বদরগঞ্জ উপজেলার দিকে যাই নদী পার হয়ে। সেখানে গিয়ে ওপেন যুদ্ধ শুরু করি। আমরা মেশিনগান দিয়ে গুলি করলে তারাও পাল্টা গুলি করে। তখন অগ্রহায়ণ মাস। মানুষ জমি থেকে ধান তুলছিল। নিরীহ মানুষের কথা চিন্তা করে আমরা পেছনে চলে যাই।

বদরগঞ্জ, মিঠাপুকুরের পাশাপাশি আমরা গেরিলা যুদ্ধ করি পীরগঞ্জেও। আমাদের দেখে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা পালিয়ে যায়। আমরা তাদের গোলাবারুদ দখল করে নিয়ে পীরগঞ্জ সিও অফিসে ক্যাম্প করি। পীরগঞ্জে একটিই দোতলা ভবন ছিল। আমি ও আমার সঙ্গীরা দীর্ঘদিন থাকি সেখানে। যুদ্ধ করে অস্ত্রগুলো কালেকশন করে সেখানে রাখি।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির মধ্যে বদরগঞ্জ থানার মালতোলার স্মৃতি আমার আজও মনে পড়ে। রাজাকারের একটি ক্যাম্প ছিল সেখানে। আমরা নদীর ওপারে জঙ্গলে থাকি। রাজাকার ও খানসেনারা এপারে। একদিন সকালে অপারেশন করি। তখন মধ্য নভেম্বর। নদীর ওপারে গিয়ে সকালের দিকে গুলি করতে থাকি আমরা। পালিয়ে যায় খানসেনারা। এরপর রাজাকারের লিডার আব্দুলের বাড়িতে আমরা হানা দিই। আমাদের আসার খবরে পালিয়ে যায় আব্দুল।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি হৃদয়বিদারক স্মৃতিও রয়েছে। গেরিলা যুদ্ধ করি বলে জঙ্গলে গোপনে থাকতে হয়। শালবনের জঙ্গলে সহসাই কেউ প্রবেশ করতে পারত না। আমরা পশ্চিম দিক থেকে ধীরে ধীরে হানাদার মুক্ত করে আসছি। জঙ্গলের পাশ থেকে বদরগঞ্জের নদীর ওপারটা স্বাধীন হয় না। রেকি দলকে পাঠিয়ে দিলাম নদীর ওপারে। ওসমানপুর বদরগঞ্জের আশপাশে সবাই রাজাকার-স্বাধীনতাবিরোধী। দিনের বেলায় রেকির দলের সদস্য পুলিন ও তবরেজ রেকি করতে যায়। পুলিনের ছড়ান এলাকা। রেকির দল ওসমানপুরে রেকি করতে গেলে রাজাকাররা পুলিন ও তবরেজকে ধরে ফেলে। ধরার পর তাদের ওপর নির্যাতন চালায়। আমাদের তথ্য জানতে চায়। কিন্তু তারা মুখে খোলেনি। তখন আখ জ্বাল দেওয়ার জন্য বড় কড়াই ছিল গ্রামে। ওই কড়াইয়ে পানি গরম করে দু'জনকে ফেলে মেরে ফেলা হয়। এ কথা শোনার পর আমরা পরদিনই ওসমানপুরে অপারেশনে যাই। তারাও পাল্টা গুলি ছুড়তে থাকে। আমাদের মর্টারের গুলিতে ওসমানপুর এলাকায় বৃষ্টি ঝরে। খানসেনারা পালিয়ে সৈয়দপুর চলে যায়। আমরা ওসমানপুর স্বাধীন করি।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা।

BBS cable ad

অটোমোবাইল এর আরও খবর: