South east bank ad

নির্ভীক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ মানিক মিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী আজ

 প্রকাশ: ০১ জুন ২০২২, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   মৃত্যুবার্ষিকী

নির্ভীক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ মানিক মিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী আজ

গণমুখী সাংবাদিকতার পথিকৃত্ ব্যক্তিত্ব তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ৫৩তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, প্রবাদপ্রতিম এই ব্যক্তিত্ব দেশের সাংবাদিকতাকে বদলে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন নির্ভীক সাংবাদিকতার কিংবদন্তি পুরুষ, আধুনিক সংবাদপত্রের রূপকার ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা।

‘রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি’, ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ আর ‘রঙ্গমঞ্চ’শিরোনামে কলাম লিখে বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতাকামী করে তোলেন মানিক মিয়া। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের কথা সহজ ভাষায় তিনি মানুষের সামনে তুলে ধরেন। নীতির প্রশ্নে, বাংলার মানুষের অধিকারের বিষয়ে তিনি কখনো আপস করেননি। দৈনিক ইত্তেফাক ছিল তার সেই সংগ্রামী জীবনের প্রধান হাতিয়ার।

মানুষের প্রত্যাশা, বেদনাকে জোরালোভাবে তুলে ধরবার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তার। দৈনিক ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাংবাদিকতাকে অবলম্বন করে জীবনব্যাপী তিনি এ দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৬৯ সালের এই দিনে মাত্র ৫৮ বছর বয়সে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ক্ষণজন্মা এই সাংবাদিক।

ভাগ্যবিড়ম্বিত বাঙালি জাতির জীবনসংগ্রাম, অস্তিত্ব-আত্মমর্যাদা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রেরণা প্রদানকারী শক্তির উত্স হয়ে উঠেছিলেন তিনি এবং তার প্রকাশিত সংবাদপত্র ‘দৈনিক ইত্তেফাক’। ইত্তেফাক সব সময় মনে করেছে, সাংবাদিকতার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে মানুষের কথা বলা, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা। ইত্তেফাক পূর্ব পাকিস্তানে যে ভূমিকা পালন করেছিল তা ছিল সময়ের দাবি। দৈনিক ইত্তেফাক ও মানিক মিয়ার অবস্থান এবং আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান ছিল এক ও অভিন্ন। ইত্তেফাক মানুষের মুক্তির পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়েছে জাতির প্রতিটি ক্রান্তিকালে। মানিক মিয়া ছিলেন তার কান্ডারি।

তিনি ছিলেন উদার গণতন্ত্রের ধারক। একজন রাজনীতিমনস্ক সাংবাদিক হয়েও তার রাজনৈতিক কোনো উচ্চাভিলাষ ছিল না, ছিল না ব্যক্তিগত কোনো লোভ। এ কারণেই সৎ ও নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সত্য কথা বলার সাহস দেখাতে পারতেন। জেল-জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়ন এবং সরকারের অসহযোগিতাকে মোকাবিলা করে, নীতির প্রশ্নে অবিচল থেকে তাকে মানুষের অধিকারের কথা বলতে হয়েছে। তিনি যেমন বাংলা সাংবাদিকতা জগতে পথপ্রদর্শক, তেমন রাজনীতিতেও। রাজনৈতিক জগতে তিনি ছিলেন হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য। ঘনিষ্ঠ ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল মানিক মিয়ার।

বঙ্গবন্ধু ‘আমার মানিক ভাই’ শিরোনামে এক লেখায় উল্লেখ করেছিলেন, ‘...আমার ব্যক্তিগত জীবনে মানিক ভাইর প্রভাব যে কত গভীর, তা ভাষায় ব্যক্ত করার মত নয়। ১৯৪৩ সাল থেকে তার সাথে আমার পরিচয়। সে পরিচয়ের পর থেকে সারাটা জীবন আমরা দু’ভাই একসাথে জনগণের অধিকার অর্জনের সংগ্রাম করেছি।...একটা বিষয়ে আমরা উভয়ই একমত ছিলাম এবং তা হল, বাংলার স্বাধীনতা। স্বাধীনতা ভিন্ন বাঙ্গালীর মুক্তি নেই, এ বিষয়ে আমাদের মাঝে কোন দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশ ছিল না। আর ছিল না বলেই নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও দু’জন দু’ফ্রন্টে থেকে কাজ করেছি। আমি কাজ করেছি মাঠে-ময়দানে আর মানিক ভাই তার ক্ষুরধার লেখনীর সাহাঘ্যে।’

সম্প্রতি প্রয়াত আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এক লেখায় বলেছেন, ‘আজ যে স্বাধীনতার সোনালি ফসল আমরা ঘরে তুলছি সেজন্য ইত্তেফাক এবং মানিক মিয়ার একক অবদান অসাধারণ।...মানিক মিয়া শুধু সংবাদপত্রের মালিক ছিলেন না, ছিলেন জনজীবনভিত্তিক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ।’

  • এ দেশে সাংবাদিকতার জগতে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া একটি অবিস্মরণীয় নাম। ‘মোসাফির’ শিরোনামে তার ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ কলামে নির্ভীক সত্য ভাষণ, অনন্য রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা এবং গণমানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণেই বাংলার মানুষের হৃদয়ে তিনি অবিনশ্বর হয়ে রয়েছেন। তার আপসহীন মনোভাবের কারণে প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানি শাসকরা বারবার তার কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে চেয়েছে। দৈনিক ইত্তেফাকের ওপর বারবার নেমে এসেছে চরম বিপর্যয়। একসময় তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের সামরিক শাসক দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। সে সময় সরকারের সঙ্গে আপস করলে তিনি ইত্তেফাক প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে পারতেন। কিন্তু তিনি এবং তার চেতনায় উদ্বুদ্ধ সাংবাদিকবৃন্দ জনমানুষের সংবাদপত্রের প্রতি যে বিশ্বাস তার সঙ্গে আপস করেননি। তিন বছর পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ রেখেছিলেন। সামরিক জান্তা ও স্বৈরাচারী শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নির্ভীক সাংবাদিকতার যে উদাহরণ তিনি সৃষ্টি করে গেছেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত।

মানিক মিয়ার সংক্ষিপ্ত জীবনী

তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার জন্ম ১৯১১ সালে পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়ায়। তার বাবার নাম মুসলেম উদ্দিন মিয়া। শৈশবেই মানিক মিয়ার মা মারা যান। গ্রামের পূর্ব ভাণ্ডারিয়া মডেল প্রাইমারি স্কুলে মানিক মিয়ার শিক্ষাজীবনের শুরু। পিরোজপুর জেলা সরকারি হাই স্কুল থেকে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৩৫ সালে মানিক মিয়া ডিস্টিংশনসহ বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। পড়াশোনা শেষ করে তিনি পিরোজপুর জেলা সিভিল কোর্টে চাকরি শুরু করেন। পিরোজপুর জেলা সিভিল কোর্টে কর্মরত থাকাবস্হায় ১৯৩৭ সালে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার অন্তর্গত গোয়ালদি গ্রামের অভিজাত পরিবারের খোন্দকার আবুল হাসান সাহেবের কন্যা মাজেদা বেগমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি।

এ সময় তিনি তত্কালীন মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পান। সোহরাওয়ার্দী সাহেবের আহ্বানে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি যোগ দেন তদানীন্তন বাংলা সরকারের জনসংযোগ বিভাগে বরিশাল জেলার সংযোগ অফিসার হিসেবে। কিছুদিন পর সেই চাকরি ছেড়ে তিনি কলকাতার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অফিস সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন। এ সময় ১৯৪৬ সালে আবুল মনসুর আহমেদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’-এর পরিচালনা পরিষদের সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন। এ পত্রিকার সঙ্গে মানিক মিয়া মাত্র দেড় বছর যুক্ত ছিলেন। ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের বিরোধী সংগঠন হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয়। সে বছরই নবগঠিত সংগঠনের মুখপত্ররূপে ‘সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন পত্রিকার আনুষ্ঠানিক সম্পাদক। কলকাতা-প্রত্যাগত তফাজ্জল হোসেন সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন এবং ১৯৫১ সালের ১৪ আগস্ট থেকে এই পত্রিকার পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর ইত্তেফাককে দৈনিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশ করেন। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। পরবর্তীকালে দৈনিক ইত্তেফাক আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সামরিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ১৯৫৯ সালে তিনি এক বছর জেল খাটেন। ১৯৬৬ সালে তিনি আবার গ্রেফতার হন। এ সময় দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশনা নিষিদ্ধ এবং নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়। এর ফলে তার প্রতিষ্ঠিত অন্য দুটি পত্রিকা ঢাকা টাইমস ও পূর্বাণী বন্ধ হয়ে যায়। গণ-আন্দোলনের মুখে সরকার ইত্তেফাকের ওপর বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ফলে ১৯৬৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পত্রিকাটি আবার প্রকাশিত হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি আমৃত্যু নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।

মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে দিনব্যাপী কর্মসূচি

তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে দৈনিক ইত্তেফাকের পক্ষ থেকে আজ বুধবার সকাল ৭টা থেকে আজিমপুর কবরস্থানে মরহুমের মাজারে কোরআনখানি এবং ১০টায় মোনাজাতের আয়োজন করা হয়েছে। তার কনিষ্ঠ পুত্র আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর পক্ষ থেকে কোরআনখানি ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। মানিক মিয়ার জ্যেষ্ঠ কন্যা মরহুমা আখতারুন্নাহার বেবীর বাসভবনে বাদ এশা কোরআনখানি ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। এছাড়া রাজধানীর ১, আর কে মিশন রোডে মানিক মিয়া ফাউন্ডেশনের আয়োজনে বেলা সাড়ে ৩টায় মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।

জাতীয় পার্টি-জেপির কর্মসূচি

তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে জাতীয় পার্টি-জেপির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী শেখ শহীদুল ইসলাম বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের এই স্বপ্নদ্রষ্টা আমৃত্যু তার শক্তিশালী কলম চালিয়েছিলেন। আজীবন আপসহীন সংগ্রামী এই মানুষটি ছিলেন বাঙালি বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের এক উজ্জ্বল তারকা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এবং মরহুম তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া কলমে যুদ্ধ চালিয়েছিলেন একই লক্ষ্যে। যতদিন আবহমান বাংলাদেশ থাকবে, ততদিন কৃতজ্ঞ জাতি এই মহান ব্যক্তিত্বকে স্মরণ করবে গভীর কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসায়।

এদিকে আজ বুধবার দলটির উদ্যোগে সকাল সাড়ে ৯টায় আজিমপুর কবরস্থানে মরহুমের মাজার জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ ও পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং বেলা সাড়ে ৩টায় জাতীয় প্রেসক্লাবে জহুর হোসেন চৌধুরী হলে আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করবেন জেপির সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী শেখ শহীদুল ইসলাম। প্রধান অতিথি থাকবেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এমপি। সম্মানিত অতিথি থাকবেন বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি, বিশিষ্ট সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী ও মনজুরুল আহসান বুলবুল।

অন্যান্য কর্মসূচি

মানিক মিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ‘মানিক মিয়া পরিষদ’ আজ সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর ১৮/১, তোপখানা রোডে এবং ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার সাংবাদিক সংস্থা’ বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবে আলোচনাসভার আয়োজন করেছে।

BBS cable ad

মৃত্যুবার্ষিকী এর আরও খবর: