দুদকের মামলায় আসামি হচ্ছেন বেসিক ব্যাংকের সাবেক পরিচালকরাও

বেসিক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক পরিচালকরাও দুদকের মামলার আসামি হচ্ছেন। অধিকতর তদন্তকালে তাদের আসামি করা হচ্ছে বলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে। জানা গেছে, তদন্তকারী চার কর্মকর্তাকে গত মার্চে ডেকেছিলেন আদালত। ঋণ অনুমোদনকারী পরিচালনা পর্ষদের পরিচালকরা কেন আসামির তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন, সেই বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। আদালতকে দুদক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাষ্ট্র ও দুদকের তৎকালীন ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপে তদন্তকারী কর্মকর্তারা পরিচালকদের আসামি করতে পারেননি।
সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে না পারায় ৫৯টি মামলা অধিকতর তদন্ত করার নির্দেশ দেন আদালত। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কমকর্তা বণিক বার্তাকে জানান, অধিকতর তদন্তে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক পরিচালকদেরও আসামি করা হবে। মামলাগুলোর তদন্তকারী পরিচালক মোহাম্মদ ইবরাহিম ও মোনায়েম হোসেন এরই মধ্যে অবসরে চলে গেছেন। বাকি দুজন হলেন পরিচালক (ব্যাংক, বীমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান) মোহাম্মদ মোরশেদ আলম ও উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান।
২০২৩ সালের ১২ জুন বেসিক ব্যাংকের আলোচিত সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুসহ ১৪৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট অনুমোদন দেয় দুদক। সংস্থাটির দায়ের করা মোট ৫৯ মামলার মধ্যে ৫৮টি মামলার তদন্তে নতুন আসামি হিসেবে আবদুল হাই বাচ্চু ও কোম্পানি সচিব শাহ আলম ভূঁইয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অথচ ২০১৫ সালে দায়ের করা কোনো মামলাতেই বাচ্চুকে আসামি করা হয়নি। যে কারণে দুদককে বারবার বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। মামলার দীর্ঘ আট বছর পর চার্জশিটে আবদুল হাই বাচ্চুকে আসামি করা হয়। তবে আবদুল হাই বাচ্চুর দুই মেয়াদের পর্ষদে যারা পরিচালক ছিলেন তাদের কাউকেই আসামি করেনি দুদক।
বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনায় যখন মামলা করা হয়, তখন দুদক চেয়ারম্যান ছিলেন মো. বদিউজ্জামান। তার সময়ে মামলার তদন্ত শেষ হয়নি। তারপর ২০১৬ সালে দুদক চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দিয়ে ইকবাল মাহমুদ পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করলেও তদন্ত শেষ হয়নি তখনো। মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ ২০২১ সালে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর বেসিক ব্যাংকের মামলাগুলোর তদন্ত শেষ হয়।
আবদুল হাইকে চেয়ারম্যান করে ২০০৯ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বেসিক ব্যাংকের যে নতুন পর্ষদ গঠন করে সরকার, সেই পর্ষদই ব্যাংকটির পতনের জন্য দায়ী বলে ধরা হয়। ওইদিন বেসিক ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দুই মহাপরিচালক (ডিজি) শুভাশীষ বসু ও নীলুফার আহমেদ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রাজিয়া বেগম, বিসিক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বিজয় ভট্টাচার্য। এছাড়া বেসরকারি খাত থেকে পরিচালক হন চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি জাহাঙ্গীর আখন্দ সেলিম, সাবেক শুল্ক কমিশনার শাখাওয়াত হোসেন, কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান কাজী আখতার হোসেন এবং এআরএস ল্যুভ বাংলাদেশ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের এমডি আনোয়ারুল ইসলাম।
শেখ আবদুল হাইয়ের পাঁচ বছরের মেয়াদে পরিচালক হিসেবে আরো ছিলেন আওয়ামী লীগের মুখপাত্র মাসিক উত্তরণ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক আনিস আহমেদ, সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ কামরুল ইসলাম এবং সাবেক অতিরিক্ত সচিব একেএম রেজাউর রহমান। আবদুল হাইয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে রেজাউর রহমান চিঠি পাঠালে তিনি এবং কামরুল ইসলাম বেসিক ব্যাংকে আর যেতেই পারেননি।
বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির ঘটনায় ৫৯টি মামলার চার্জশিটে আসামিদের বিরুদ্ধে মোট ২ হাজার ২৬৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। আসামিদের মধ্যে ব্যাংকের ৪৬ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ১০১ গ্রাহকসহ বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তি রয়েছেন। ব্যাংকের সাবেক এমডি কাজী ফখরুল ইসলামকে আসামি করা হয়েছে ৪৮টি মামলায়। আর ডিএমডি ফজলুস সোবহানকে ৪৭টিতে, কনক কুমার পুরকায়স্থকে ২৩টিতে, মো. সেলিমকে আটটিতে ও বরখাস্ত হওয়া ডিএমডি এ মোনায়েম খানকে ৩৫টিতে আসামি করা হয়েছে।
চার্জশিটে আসামির তালিকার অন্য উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন—ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মো. সেলিম, এমদাদুল হক, ফজলুল সোবহান, মহাব্যবস্থাপক মো. মনিরুজ্জামান ও শাহজাহান মোল্লা, ডিজিএম খান ইকবাল হাসান, জিম মোহাম্মদ আলী চৌধুরী, সহকারী মহাব্যবস্থাপক মো. আশরাফুজ্জামান, ব্যাংকের শান্তিনগর শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক মো. জালাল উদ্দিন, এজিএম এসএম আনিসুর রহমান চৌধুরী, সাবেক ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আলী, গুলশান শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক শীপার আহমেদ, একই শাখার ক্রেডিট ইনচার্জ এসএম জাহিদ হাসানসহ দিলকুশা শাখা ও স্থানীয় কার্যালয়ের আরো কয়েকজন কর্মকর্তা।
ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবতে বসা বেসিক ব্যাংকের ২০২১ সালের আর্থিক প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর দায়িত্বকালটা ‘অস্বস্তির’ ছিল।