৫০০০ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে এস আলমের ১২ প্রতিষ্ঠান
এস আলম গ্রুপের ১২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৫০০০ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর মধ্যে ১০ প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ ১ হাজার ৪১৪ কোটি টাকা।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের তদন্তে এ তথ্য উঠে এসেছে। গত সপ্তাহে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়েছে।
যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ মিলেছে- এস আলম স্টিলস, চেমন ইস্পাত, এস আলম রিফাইন্ড সুগার, এস এস পাওয়ার, এস আলম পাওয়ার প্ল্যান্ট, এস আলম প্রোপার্টিজ, এস আলম কোল্ড রি-রোলিং মিলস, মাসুদ প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, এস আলম ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং মিলস, এস আলম সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ।
এছাড়া কয়েক মাসে একই ভ্যাট কমিশনারেট এস আলম ভেজিটেবল অয়েল ও এস আলম সুপার এডিবল অয়েলের সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছিল। সব মিলিয়ে এস আলম গ্রুপের ১২ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট ফাঁকির তথ্য পেয়েছেন ভ্যাট কর্মকর্তারা।
ভ্যাট বিভাগের পাশাপাশি এস আলম গ্রুপের প্রধান সাইফুল আলম ও তার স্ত্রী, সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের আয়কর ফাঁকিরও তদন্ত চলছে। এছাড়া এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আয়কর ফাঁকি দিয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিদায়ী সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় সুবিধাভোগীদের মধ্যে অন্যতম বড় শিল্পগোষ্ঠী ছিল এস আলম গ্রুপ। এস আলম ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে গত এক দশকে রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে ব্যাংক দখল, অর্থ পাচারসহ ক্ষমতার অপব্যবহারের নানা অভিযোগ রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, আয়কর বা শুল্ক ফাঁকির চেয়ে ভ্যাট ফাঁকি বেশি গুরুতর অপরাধ। কারণ, ভ্যাট আদায় হয় ভোক্তার কাছ থেকে। ভ্যাট ফাঁকি দেওয়া মানে ভোক্তার টাকা নিয়ে সরকারি কোষাগারে জমা না দেওয়া। এর ফলে দুই ধরনের অপরাধ হয়েছে। প্রথমত সরকারি কোষাগারে প্রাপ্য রাজস্ব জমা পড়েনি। আবার ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ভ্যাট ফাঁকিবাজ এসব প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। শুধু ফাঁকি দেওয়া ভ্যাট আদায় নয়; জরিমানাও হওয়া উচিত। আবার ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণার জন্য জেলসহ অন্যান্য শাস্তিও হতে পারে।
কে কত ভ্যাট ফাঁকি দিল
গত ১৯ আগস্ট থেকে এস আলম শিল্পগোষ্ঠীর ১৮টি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকির বিষয়টি তদন্ত করে চট্টগ্রামের চট্টগ্রামের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের ২০ সদস্যের তদন্ত দল। এস আলম গ্রুপের বেশির ভাগ শিল্পপ্রতিষ্ঠান এই কমিশনারেটের আওতাধীন। এসব প্রতিষ্ঠানের গত পাঁচ বছরের বেচাকেনা ও উৎপাদনের ওপর নিরীক্ষা করা হয়।
প্রাথমিক তদন্ত শেষে ১০টি প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত দলের ভ্যাট কর্মকর্তারা। সবচেয়ে বেশি ৭৫৫ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে এস আলম রিফাইন্ড সুগার লিমিটেডের। দ্বিতীয় স্থানে আছে এস আলম কোল্ড রি-রোলিং মিলস। প্রতিষ্ঠানটির ফাঁকির পরিমাণ ২১৬ কোটি টাকা। ১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র এস এস পাওয়ার ২০০ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। এছাড়া চেমন ইস্পাত ১৪৭ কোটি টাকা, এস আলম স্টিলস ৫৬ কোটি টাকা, এস আলম পাওয়ার প্ল্যান্ট সাড়ে ২১ কোটি টাকা, এস আলম সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ সাড়ে ১০ কোটি টাকা, এস আলম প্রোপার্টিজ ৬ কোটি টাকা, মাসুদ প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ২ কোটি টাকা এবং এস আলম ব্যাগ ম্যানুফ্যাকচারিং মিলস ৩১ লাখ টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে।
এসব প্রতিষ্ঠানকে গত সপ্তাহে চট্টগ্রাম ভ্যাট কমিশনারেট থেকে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তবে এখনো নোটিশের জবাব পাওয়া যায়নি। এস আলম স্টিল (ইউনিট-২), নিউ এস আলম শুজ অ্যান্ড বার্মিজ, অটোবোর্টস অটোমোবাইলস, প্লাটিনাম স্পিনিং মিলস, সাইনিং এসসেন্ট, গ্র্যান্ড স্পিনিং মিলস, ইনফিনিটি সি আর স্ট্রিপ ইন্ডাস্ট্রিজ, ওশান রিসোর্টসহ বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে তদন্ত চলমান।
কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের কমিশনার সৈয়দ মুসফিকুর রহমান বলেন, ভ্যাট ফাঁকি ধরতে চলমান স্বাভাবিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরীক্ষা করা হচ্ছে। কারো ভ্যাট ফাঁকি পাওয়া গেলে অবশ্যই তা আদায় করা হবে। প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
দুই প্রতিষ্ঠানের ফাঁকি ৩৫০০ কোটি টাকা
গত জুন মাসে এস আলম গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকির প্রমাণ পান এনবিআরের ভ্যাট কর্মকর্তারা। প্রতিষ্ঠান দুটি হলো- চট্টগ্রামের এস আলম ভেজিটেবল অয়েল ও এস আলম সুপার এডিবল অয়েল।
ভ্যাট বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে পরের তিন বছর নিজেদের বিক্রির তথ্য গোপন করে প্রতিষ্ঠান দুটি। নিজেদের রিটার্নে কম বিক্রি দেখিয়ে তারা ভ্যাট ফাঁকি দেয়। আবার ভোজ্যতেল উৎপাদনের উপকরণ কেনায়ও ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে। এর মধ্যে এস আলম ভেজিটেবল অয়েলের ভ্যাট ফাঁকির পরিমাণ ১ হাজার ৯১১ কোটি টাকা ও এস আলম সুপার এডিবল অয়েলের ১ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। এ নিয়ে আদালতে মামলা চলছে।
এস আলমের কর ফাঁকির তদন্ত চলছে
নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশের শীর্ষ ছয়টি শিল্পগোষ্ঠীর মালিকদের কর ফাঁকির তদন্ত শুরু করে এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। পাশাপাশি তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর কর ফাঁকিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে এরই মধ্যে এস আলম ও তার পরিবারের সদস্য এবং প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের তথ্যও চাওয়া হয়েছে।
দেখা গেছে, এস আলম শিল্পগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠান ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা ৬টি ব্যাংক হিসাবে জমা আছে (স্থিতি) ২৫ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা। ঐ ৬ ব্যাংকের মধ্যে ইসলামী ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক- এই ৫টি ব্যাংকই এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এমনকি এস আলমের বাড়ির গৃহকর্মী মর্জিনা আকতারের নামেও ইসলামী ব্যাংকে ১ কোটি টাকার এফডিআর পাওয়া গেছে।