ব্যবসায় ধীরগতি হলে খেলাপি ঋণ বাড়বে
ব্যাংক খাত ও ডিজিটাল অর্থনীতি নিয়ে বলার মতো অনেক বিষয় আছে। কিন্তু প্রথমে ভালো দিক নিয়ে বলতে চাই। আমাদের ব্যাংক খাতে লুটপাট অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে। সবচেয়ে বড় সুসংবাদ এটাই।
ব্যাংক খাত ও ডিজিটাল অর্থনীতি নিয়ে বলার মতো অনেক বিষয় আছে। কিন্তু প্রথমে ভালো দিক নিয়ে বলতে চাই। আমাদের ব্যাংক খাতে লুটপাট অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটেছে। সবচেয়ে বড় সুসংবাদ এটাই। এর অর্থ এখন যদিও ব্যাংক খাতের অবস্থা এতটা ভালো না, তবে এর চেয়ে খারাপ হওয়ার সুযোগ নেই, যে আশঙ্কা আগে ছিল। আরেকটি ভালো দিক হলো, সুদহার ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার এখন বাজারভিত্তিক।
ইকুইটি মার্কেট বা শেয়ারবাজারও অর্থ ব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) আনতে হবে। এক সময় এ দেশে প্রচুর বিদেশী বিনিয়োগকারী ছিলেন। আমাদের সিটি ব্যাংকেই ১৩ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগ ছিল। ৫ শতাংশ শেয়ার নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) সিটি ব্যাংকের সবচেয়ে বড় একক শেয়ারহোল্ডার। ব্যক্তি শেয়ারহোল্ডাররা নন-স্ট্র্যাটেজিক ও ট্রেডিং পর্যায়ে ছিল, তারা চলে যায়। আগামীতে শেয়ারবাজারের অবস্থাও উন্নত হবে।
ব্যাংক খাতের যে দুটো বিষয় আমাদের ভাবায় সেটা হলো, সুদহার ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার। যদিও এটি এখন বাজারভিত্তিক। সেজন্যই দেখা যায় যে চলতি হিসাব এখন উদ্বৃত্ত ও ইতিবাচক। যে পরিমাণ রফতানি হচ্ছে তার চেয়ে বেশি আমদানি হচ্ছে। ফলে এখানে একটা শূন্যস্থান বা ব্যবধান তৈরি হচ্ছে, যদিও রেমিট্যান্সের মাধ্যমে সে ব্যবধানটাও পূরণ হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং বিদেশী বিনিয়োগ আসা শুরু করলে, বিশেষ করে বিনিয়োগ, ঋণ বা সহায়তা আসা শুরু হলে আর্থিক হিসাব ঠিক হয়ে যাবে।
বর্তমান গভর্নর ভালো ভালো ব্যাংক নিয়ে কাজ করতে চান, যা ভালো লাগে। কিন্তু আমার একটা দুঃখ যে বাংলাদেশ একটি আজব দেশ, যে দেশে দুটো ব্যাংক খাত রয়েছে। ভালো ব্যাংক নিয়ে একটি খাত এবং খারাপ ব্যাংক নিয়ে আরেকটা খাত। কিন্তু একটি দেশে ব্যাংক খাত একটাই হতে হবে। এখন গভর্নরের কথামতো ওই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ভালো ব্যাংকগুলো বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। আমি তার এ কথাটা বুঝি। কিন্তু তিনি চাইলেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা দিতে পারতেন। আগে এটাই হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নতুন টাকা ছাপিয়ে সরাসরি মার্কেটে দিয়ে মার্কেটকে বাঁচিয়ে রাখতে হতো। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটা সম্পদ তৈরি হতো। তিনি সেটা না করে আমাদের বললেন, তোমাদের টাকা তোমরা মার্কেটে দাও। সুতরাং মার্কেটের টাকা মার্কেটেই থাকল। নতুন টাকা মার্কেটে এল না। মুদ্রাস্ফীতি ব্যবস্থাপনার জন্য এটি একটা ভালো পদ্ধতি ও বুদ্ধিমানের কাজ। এটার জন্য তাকে আমি ধন্যবাদ জানাই।
আমি বলতে চাই যে আমরা তার এ পদক্ষেপকে বিশ্বাস করেছি। আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ গ্যারান্টিকে বিশ্বাস করছি। এ কারণেই সিটি ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ১ হাজার ১৫০ কোটি টাকা দিয়েছে। টাকার অংকে এ উদ্যোগে সোনালী ব্যাংকের পরই সর্বোচ্চ। পরে যারা তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে তাদের টাকার পরিমাণ অনেক নিচে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপানোর অধিকার রাখে। তারা সরকারের চেয়েও বড়। সরকার আসবে, সরকার যাবে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধ্রুব ও স্থির। প্রথাগত মুদ্রা ব্যবস্থাপনার দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে, সেখানে বলা আছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা সরকারের চেয়ে বড়। আমরাও সেটি বিশ্বাস করি।
এখানে ভালো ব্যাংক ও দুর্বল ব্যাংকের কথা বলা হলো। এ দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একসঙ্গে নিয়ে কিছু একটা করতে হবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে নিয়ে একটা একক ব্যাংক করা যেতে পারে। দুর্বল ব্যাংকগুলোর মধ্যে তিন-চারটে বড় ব্যাংক আছে, যেগুলো শুরু থেকে ভালো ব্যাংক ছিল। মাঝে খারাপ হয়েছে। এদের সব মন্দ ঋণগুলো (এনপিএল) একত্রিত হয়ে একটা বড় রকমের বোঝা হয়ে আছে। অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির দিকে মনোযোগ দিতে গভর্নরকে অনুরোধ করছি। এ খেলাপি ঋণগুলো সরাতে হবে। এগুলোকে রাইট অফ করে অন্য কাউকে দিয়ে দিতে হবে। বহু অ্যাসেট রিকভারি কোম্পানি (এআরসি) ও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি (এএমসি) আছে তারা পুনরুদ্ধার করবে। তারপর পুরো ব্যাংক খাতে একটি নতুন যাত্রা শুরু হবে। আমি নিশ্চিত, গভর্নর এই একই চিন্তার মধ্যে আছেন।
যদিও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি ও অ্যাসেট রিকভারি কোম্পানি গড়ে তোলা এতটা সহজসাধ্য বিষয় না। এদের গঠনের ইকুইটি কে দেবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন। যা-ই হোক, এই বেইলআউট চলছে। এটি একটি ভালো পদক্ষেপ। আমরা এটাকে চালিয়ে যাব। আমি জানি, আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের গ্যারান্টি কোনো দিন ভঙ্গ করবে না। অন্তত বর্তমান গভর্নরের আমলে করবে না। আমরা তার ওপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখছি।
আর এখানে ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট নিয়ে কথা বলা দরকার। যদিও গণমাধ্যমে এ নিয়ে অনেক কথা বলা হয়। তারল্যের মৌলিক বিষয়ের কথা যদি বলি তাহলে বর্তমান তারল্য-শিল্প অনুপাত ৮০ দশমিক ২০ শতাংশ। অর্থাৎ ৭ শতাংশ বাড়তি অর্থ কিন্তু এখন ব্যাংকের হাতে আছে। তারল্য কাভারেজ অনুপাত সূচকেও ব্যাংক খাত ১৪৫ দশমিক ৪ শতাংশ নিয়ে আছে। অথচ সেখানে থাকার কথা ছিল ১০০ শতাংশ। সেখানেও উদ্বৃত্ত আছে। এসব সূচক এটাই প্রমাণ করে যে ব্যাংক খাতে একটা উদ্বৃত্ত তারল্য আছে। তারল্য সমস্যা আছে, সেটা দশটা ভালো স্থানীয় ব্যাংক, তিন-চারটে সরকারি ব্যাংক এবং তিনটি বিদেশী ব্যাংকে। সেই ঘুরে-ফিরে একই কথা আসে—সেটা হলো, এক দেশে দুটি ব্যাংক খাত। বিদেশীরাও একই কথা বলে। কিছুদিন আগেও বেইজিংয়ের একটি সেমিনারে অংশ নিয়েছিলাম। সেখানেও সবার একই কথা, আমাদের ব্যাংক খাতের এ সমস্যা কবে ঠিক হবে।
আমরা সিটি ব্যাংক ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও (সিআরআর) ও স্ট্যাচুটরি লিকুইডিটি রেশিও (এসএলআর) সংরক্ষণ করে চলেছি, সেখান থেকে তারল্যের পরিমাণ পাওয়া যাবে। আমাদের ১ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা এখনো উদ্বৃত্ত আছে। তো এগুলো জনগণ জানলে এ খাতে আস্থা ফিরবে বলে আশা করছি। ভালো কাজ হচ্ছে।
এখানে মুদ্রাস্ফীতির কথা বলব। আর্থিক খাতগুলোর উন্নতি একটু নিচের দিকে। এজন্য মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি। মুদ্রাস্ফীতি বেশি থাকলে ব্যবসা কী করে করবে? গত বছরের এ মাসে সরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩০ দশমিক ৬০ শতাংশ, সেটি এখন ১১ দশমিক ৯ শতাংশ। এ খাতে প্রাণ আনতে হবে। বাজার তদারকি (মার্কেট টাইটেনিং) এখনো আছে। আমাদের গভর্নর সাম্প্রতিক আলোচনায় বলেছেন, বাজার তদারকি আরো আসছে। তার অর্থ, ঋণ পাওয়া আরো কষ্টসাধ্য হচ্ছে। বিষয়টি পছন্দ করি বা না করি, মার্কেট টাইটানিং না করলে মুদ্রাস্ফীতির ব্যবস্থাপনা করা যাবে না। আগামী ১০-১২ মাস অর্থনীতিতে এ ধীরগতি অবধারিত। এ সময়টা আমাদের উতরাতে হবে। আমাদের অর্থনীতিবিদরা আছেন, তারাই উতরানোর পথ দেখাবেন।
নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) এ মুহূর্তে ভয়াবহ পর্যায়ে আছে। ব্যবসা যদি আরো ধীরগতির হয়ে যায় তখন কিন্তু নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) বা মন্দ ঋণ আরো বেশি হবে। আসলে এটি একটি আন্তঃসম্পর্কীয় বিষয়। ব্যবসায় ধীরগতি হলে খেলাপি ঋণ বাড়বে, কারণ ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ করতে পারবে না।
অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি বা অ্যাসেট রিকভারি কোম্পানি গঠন করে খেলাপি ঋণগুলোকে সরিয়ে একটা স্বচ্ছ (ক্লিন) ব্যালান্সশিট শিল্পের যাত্রা শুরু করতে পারে। খেলাপি ঋণগুলো এখন একটা বোঝা। এগুলো ব্যবসায়িক খরচ বাড়িয়ে দেবে আর বাড়তি এ ব্যবসায়িক খরচ পরবর্তী সময়ে তারল্য সংকট তৈরি করবে। আমার একটা ভয় থাকে। আমি আসলে এগুলো নিয়ে খুব চিন্তিত।
আমার দ্বিতীয় বিষয়টি বলেই শেষ করছি। সেটা ডিজিটাল অর্থনীতি। যেহেতু গভর্নর এখানে উপস্থিত আছেন সেহেতু ডিজিটাল অর্থনীতি নিয়ে কথা বলার সুযোগ নিচ্ছি। সবাই জানেন যে বাংলাদেশ মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের (এমএফএস) বিপ্লবের দেশ। এখানে ‘বিকাশ’ ও ‘নগদ’ তৈরি হয়েছে। নগদের কিছু বেঠিক ছিল, যেগুলো এখন ঠিক করা হচ্ছে। সব ব্যাংককে ডিজিটাল অর্থনীতিতে আসার কথা ছিল। এখন সব স্থবির হয়ে আছে। আমাদের কিন্তু কেউ বাধা দিচ্ছে না। সিটি ব্যাংকের ‘সিটি টাচ’ ও ব্র্যাক ব্যাংকের ‘আস্থা’ আছে। সিটি টাচের লেনদেন এ বছর ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা হবে। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকেরও বিশাল ডিজিটাল অ্যাপ আছে। সব মিলিয়ে একটি বিপ্লব চলছে। মানুষ এখন ক্যাশ-ইন ও ক্যাশ-আউটের বাইরেও ডিজিটাল সেবা চাচ্ছে। সেখানে সিটি ব্যাংক প্রথম ‘সিটি ব্যাংক বিকাশ ডিজিটাল ন্যানো ঋণ’ নামে ডিজিটাল ঋণের কার্যক্রম শুরু করে। আমি কিন্তু ডিজিটাল ঋণের একটি গ্রাহককেও চিনি না। এ পর্যন্ত সিটি ব্যাংক ১ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা ঋণ প্রদান করেছে। এরা সবাই বিকাশ গ্রাহক। কিন্তু পুরো টাকাসহ ঋণের ঝুঁকি সিটি ব্যাংকের। এখানে ৪ লাখ ২ হাজার ৮৭৬ জন মানুষকে ডিজিটাল ন্যানো ঋণ দেয়া হয়েছে। তারা প্রত্যেকে গড়ে ৪ দশমিক ৯ বার করে এ ঋণ নিয়েছে। এর অর্থ, ২০ লাখ মানুষের জীবন ছুঁয়েছে এ ডিজিটাল ন্যানো ঋণসেবা। এ ঋণ-সম্পর্কিত আমাদের যত দুঃখ ও দুর্বলতা আছে সেগুলো বর্তমান গভর্নর দূর না করলে কে করবেন? ডিজিটাল ন্যানো ঋণ পুরো অর্থনীতিতে একটা মোড় নিয়েছে।
আইএফসি আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে তাঞ্জানিয়ায় গিয়েছিল। সেখানে দেখা গেল, একটি বড় ব্যাংকের ৩০ শতাংশ ঋণই ডিজিটাল ন্যানো ঋণ। ব্যাংক এভাবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির টেক্সট বুকের বাইরেও সত্য হয়ে দাঁড়াতে পারে, যদি আমরা এগুলোকে বিশ্বাস করা শুরু করি। আমাদের এ ব্যাপারে বসে আলোচনা করা উচিত বলে মনে করি। সিটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ শতাংশের নিচে। যেখানে অন্যান্য ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ কোথাও ১০ শতাংশ, কোথাও ২০ শতাংশ আবার কোথাও ৩০ শতাংশ। ভোলা বা লালমনিরহাটসহ দূরের মানুষগুলো অর্থাৎ গরিব ও ছোট ছোট ব্যবসায়ী ব্যাংকের টাকা নিয়ে ব্যবসা করে ফেরত দেননি তা কিন্তু নয়। এমন হলে ব্র্যাক ব্যাংক কখনো এত সফল ব্যাংক হতে পারত না। আর সিটি ব্যাংকও মাইক্রো ফাইন্যান্সে এভাবে এগোত না। ডিজিটাল অর্থনীতির বিষয়ে শেষ একটি কথাই বলব, ব্যাংকগুলোকে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ে আনতে ও ইন্টারেনেটের গতি নিয়ে কাজ করতে হবে। সাবমেরিন কেবলগুলো দ্রুত আসতে হবে। একটি দেশ ছয় টিবিপিএস ইন্টারনেটে চলে যেখানে ন্যূনতম ইন্টারনেটের চাহিদা ৩০ টিবিপিএস। এ বিষয়গুলোয় আমাদের কাজ করতে হবে। এ বিষয়ে গভর্নরের বিরাট ভূমিকা থাকবে বলে আশা করছি।
মাসরুর আরেফিন: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সিটি ব্যাংক