কেটেছে অস্থিরতা, বেড়েছে পোশাক রফতানি
রফতানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প। টানা আন্দোলন-সংগ্রাম কাটিয়ে আন্তর্জাতিক পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরের তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রতি মাসে পোশাক রফতানি বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ের শুরু থেকে প্রতি মাসে ধারাবাহিকায় বাড়তে থাকা পোশাক রফতানি গত সেপ্টেম্বর মাসে কমলেও অক্টোবরে এসে বেড়ে যায়।
আগস্ট মাসের তুলনায় সেপ্টেম্বরে পোশাক রফতানি কমে যায় ৩১ কোটি ৫৮ লাখ ইউএস ডলার বা ৯.৫০ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে পোশাক রফতানি কমার পেছনে আশুলিয়া-সাভার কেন্দ্রিক সৃষ্ট শ্রমিক অসন্তোষে আনন্দোলন, ভাঙচুর ও কারখানা বন্ধে সময় মতো অর্ডার রেডি করেতে পারেননি অনেক রফতানিকারক। এতে সেপ্টেম্বরে পোশাক রফতানি কমে যায়। তবে সেপ্টেম্বরের শেষদিকে দাবি পূরণে শ্রমিক আনন্দোলন থেমে গেলে কারখানাগুলো আবারও সচল হয়। ফলে সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে পোশাক রফতানি বেড়েছে ২৮ কোটি ৬৩ লাখ ইউএস ডলার বা ৯.৫১ শতাংশ। নিটওয়্যার ও ওভেন পোশাক রফতানি বেড়ে যাওয়ায় গত অক্টোবরে দেশের পোশাক রফতানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬১ কোটি ১৯ লাখ ইউএস ডলার বা ২২.৮০ শতাংশ।
এদিকে, অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ বুধবার বলেছেন, আগের তুলনায় নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি ফিরছে। ধীরে ধীরে জিনিসপত্রের দাম আরো কমবে। ১০ লাখ পোশাক শ্রমিককে ভর্তুকি মূল্যে টিসিবির পণ্য দেওয়া হবে। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, পণ্যের আমদানির দাম ও বিক্রয় মূল্যের মধ্যে ব্যবধান কমছে। এটা বাজারের জন্য ইতিবাচক। তেল, চিনি, সারসহ অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে পণ্যের দামে প্রভাব পড়ছে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাইয়ে ৩১৭ কোটি ৮৪ লাখ ইউএস ডলার, আগস্টে ৩৩২ কোটি ৫৯ লাখ ইউএস ডলার, সেপ্টেম্বরে ৩০১ কোটি ১ লাখ ইউএস ডলার এবং অক্টোবরে ৩২৯ কোটি ৬৪ লাখ ইউএস ডলারের পোশাক রফতানি হয়। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের চার মাসে ১ হাজার ২৮১ কোটি ১০ লাখ ইউএস ডলার পোশাক পোশাক রফতানি হয়, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১২৩ কোটি ৮৫ লাখ ইউএস ডলারের বেশি। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় অক্টোবরে পোশাক রফতানি বেড়েছে ৬১ কোটি ১৯ লাখ ইউএস ডলারের বেশি।
পোশাক শিল্পে নিটওয়্যার ও ওভেন পোশাক রফতানি হয়ে থাকে। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, ওভেন পোশাক গত বছরের তুলনায় জুলাইয়ে ৩.৯৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১৪৪ কোটি ৯৪ লাখ ডলারে, আগস্টে ৩.১১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১৪৩ কোটি ৪৮ লাখ ডলারে, সেপ্টেম্বরে ১৭.২২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১২৮ কোটি ৬ লাখ ডলারে এবং অক্টোবরে ২০.৫৪ শতাংশ বেড়ে ১৪৩ কোটি ৮৭ লাখ ডলার রপ্তানি হয়েছে।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, নিটওয়্যার পোশাক গত বছরের তুলনায় জুলাইয়ে ২.০৪ শতাংশ বেড়ে ১৭২ কোটি ৯০ লাখ ডলারে দাঁড়ায়, আগস্টে ১০.৫৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ১৮৯ কোটি ১১ লাখ ডলার, সেপ্টেম্বরে ১২.৭৪ শতাংশ বেড়ে ১৭২ কোটি ৯৫ লাখ ডলার এবং অক্টোবরে ২৪.৬০ শতাংশ বেড়ে ১৮৫ কোটি ৭৬ লাখ ডলার রফতানি হয়েছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর ‘পোশাক খাতে সাম্প্রতিক মজুরি বিতর্ক: কী শিখলাম’ শীর্ষক সংলাপে নিজেদের পর্যবেক্ষণেও সিপিডি দাবি করে, তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের সাম্প্রতিক অসন্তোষের প্রধান কারণ মজুরি কাঠামো নির্ধারণে ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়া। এতে আরও বলা হয়, নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণার আগে ও পরের বিভিন্ন ধাপের কাজে যে ত্রুটিপূর্ণ প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়েছিল তার ফলে শ্রমিকদের মধ্যে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে যথার্থ প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয়নি। মজুরি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গ্রেডভিত্তিক তারতম্য সৃষ্টি হওয়ায় শ্রমিকদের মধ্যে অঞ্চল ও গ্রেডভেদে মিশ্র উপলব্ধিও জন্ম হয়। অন্যদিকে একেক কারখানায় পৃথকভাবে মজুরি বাস্তবায়ন ঘটেছে। অনেক কারখানা নতুন কাঠামো অনুসরণ করে মজুরি বাড়ায়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেতন না দিয়ে পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের মালিক এখন বিদেশে পালিয়ে রয়েছেন। মালিক দেশে নেই— এমন যুক্তি দেখিয়ে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হচ্ছে না। এর ফলে শ্রমিকরা আন্দোলনের সুযোগ পাচ্ছেন। বিশেষ করে অক্টোবর মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে দেশের পোশাক খাতে শ্রমিক অসন্তোষ তীব্র আকার ধারণ করে। বেতন না পেয়ে সাভার, আশুলিয়া, টঙ্গী, গাজীপুর ও মিরপুরে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা রাস্তায় বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, শ্রমিক অসন্তোষের কারণে দেশের পোশাক খাতের উৎপাদন ক্ষতি প্রায় ৪০ কোটি ডলার। দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে পোশাক শ্রমিকরা নানা দাবিতে বিক্ষোভ করেন। কোথাও কোথাও সড়ক অবরোধের পাশাপাশি সহিংসতার ঘটনাও ঘটে। এতে মালিকরা কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হন।
বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান এই খাতে বাঁচাতে গত ২৪ সেপ্টেম্বর পোশাক শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার ও মালিকপক্ষ। দাবিগুলো হলো- ১. হাজিরা বোনাস, টিফিন ও নাইট বিল। ২.নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়ন। ৩. রেশনিং ব্যবস্থা। ৪. বকেয়া মজুরি প্রদান। ৫. বিজিএমইএ থেকে বায়োমেট্রিক ব্ল্যাকলিস্টিং করা। ৬. ঝুট ব্যবসা নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাব, চাঁদাবাজি বন্ধ। ৭. শ্রমিকদের বিরুদ্ধে সব ধরনের হয়রানিমূলক এবং রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার। ৮. বৈষম্যহীন নিয়োগ। ৯. জুলাই বিপ্লবে শহিদ এবং আহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ ও চিকিৎসা প্রদান। ১০. রানা প্লাজা এবং তাজরীন ফ্যাশন দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতিকার। ১১. ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন। ১২. অন্যায্যভাবে শ্রমিক ছাঁটাই করা যাবে না। ১৩. নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি। ১৪. ন্যূনতম মজুরি পুনর্মূল্যায়ন। ১৫. শ্রম আইন সংশোধন। ১৬. সার্ভিস বেনিফিট প্রদান। ১৭. প্রভিডেন্ড ফান্ড ও ১৮. বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট প্রদান।
শ্রমিকদের এসব দাবি মেনে নেয়ায় বন্ধ হওয়া কারকানা খুলে দেওয়া হয়। অস্থিরতা কাটিয়ে সাভার আশুলিয়াসহ দেশের শিল্পাঞ্চলের বেশিরভাগ শিল্প-কারখানাতেই বর্তমানে স্বাভাবিক কার্যক্রম চলতে শুরু করেছে। এখন তেমন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে না, যে কারণে চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে নিটওয়্যার ও ওভেন পোশাক রফতানি বেড়েছে।