তৈরি পোশাক শিল্পে কমেছে নারীর অংশগ্রহণ
দেশের তৈরি পোশাক খাত গত এক দশকে অনেক বেশি পুঁজিঘন হয়েছে। একই সঙ্গে শিল্পটিতে প্রযুক্তির আপগ্রেডেশন হচ্ছে। ফলে শ্রমিকপ্রতি কমেছে যন্ত্রের সংখ্যা। আর এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে মেশিন অপারেটর ও হেলপারদের ওপর, যার বেশির ভাগই নারী। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত চার দিনব্যাপী গবেষণা সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন গতকাল প্রথম অধিবেশনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। রাজধানীর গুলশানে একটি হোটেলে এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে।
‘টেকনোলজি আপগ্রেডেশন অব দ্য আরএমজি ইন্ডাস্ট্রিজ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক উপস্থাপনায় বিআইডিএসের গবেষক কাজী ইকবাল জানান, দেশের তৈরি পোশাক খাতে নারীর অংশগ্রহণ কমছে। ২০১৪ সালে দেশের এ খাতের শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৫৬ শতাংশ, ২০২৩ সালে যা ৫৩ শতাংশে নেমে আসে। দেখা যাচ্ছে, গত ১০ বছরে তৈরি পোশাক খাতের বেশির ভাগ উপখাতে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে। এ খাতের আটটি উপখাতের মধ্যে ছয়টিতে নারীর অংশগ্রহণ কমেছে; বেড়েছে কেবল দুটিতে।
কাজী ইকবাল বলেন, ‘তৈরি পোশাকের উপখাতগুলোর মধ্যে কেবল হোম টেক্সটাইল ও ওভেন খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। বাকি ছয়টি খাত অর্থাৎ নিট লিনজারি, ডেনিম ট্রাউজার, সোয়েটার, টি-শার্ট, জ্যাকেট, ওভেন ট্রাউজার ও ওভেন শার্টে কমে গেছে নারী শ্রমিকের অংশগ্রহণ। সবচেয়ে বেশি কমেছে জ্যাকেটে। এ উপখাতে ২০১৪ সালে নারী শ্রমিক ছিল ৬৩ দশমিক ১৩ শতাংশ, ২০২৩ সালে যা কমে দাঁড়ায় ৩৯ দশমিক ২২ শতাংশে।’
উপস্থাপনায় বলা হয়, উৎপাদন খাতে গত ১০ বছরে প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট কর্মসংস্থান বেড়েছে। বিএসসি, ডিপ্লোমা টেক্সটাইল প্রকৌশলী, বিএসসি শিল্প প্রকৌশলী ও ডিপ্লোমা শিল্প প্রকৌশলীর সংখ্যা বেড়েছে। তবে টেক্সটাইল প্রকৌশলে নারীর সংখ্যা খুবই নগণ্য। ডিপ্লোমা শিল্প প্রকৌশলীর পেশা তুলনামূলকভাবে নতুন। তবে এ খাতে সম্প্রতি কয়েক বছরে নারীরা এসেছেন। এ খাত গত ১০ বছরে অনেক বড় হয়েছে বলে নন-টেকনিক্যাল মানুষের সংখ্যাও দ্বিগুণ হয়েছে।
বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক কাজী ইকবাল বলেন, ‘নারীরা কোথায় কোথায় প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কারণে সমস্যার মুখে পড়ছেন, তা চিহ্নিত করে তাদের নতুন দক্ষতা শেখানো দরকার। তাহলে নারীদের ঝরে পড়ার হার রোধ করা সম্ভব।’
বিআইডিএসের গবেষক মঞ্জুর আহমেদ বলেন, ‘চীনে প্রযুক্তির কারণে ৩ শতাংশ ছাঁটাই হলেও ২ শতাংশ নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে। এ প্রক্রিয়া সবখানেই থাকবে। ফলে দরকার হচ্ছে নারীদের দক্ষতা বাড়ানো বা তাদের নতুন দক্ষতা শেখানো এবং প্রয়োজনবোধে নতুন জায়গায় নিয়ে যাওয়া।’
বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেন, ‘প্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ কমে যাচ্ছে, এর সামাজিক প্রভাব আছে। বিষয়টি কি একেবারে বাজারের হাতে দেয়া হবে, নাকি এখানে নারীর অংশগ্রহণের হার বজায় রাখতে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
আরেক প্রবন্ধ উপস্থাপনে বিআইডিএসের গবেষণা সহযোগী ফারহিন ইসলাম বলেন, ‘প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে উৎপাদনশীলতা বাড়লে বাংলাদেশের উৎপাদন খাতে ১৮ লাখ কর্মীর কাজ চলে যেতে পারে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে। এ খাতে ১০ লাখ মানুষের কাজ চলে যেতে পারে। এ খাতের ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি সত্ত্বেও নতুন যত কর্মসংস্থান হবে, তা ছাঁটাইয়ের চেয়ে বেশি। ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে উৎপাদন খাতে ২০ লাখ কর্মসংস্থান হবে। যেসব খাতে প্রযুক্তি ব্যবহার হবে মানবশ্রমের সহায়ক শক্তি হিসেবে, সেসব খাতে ছাঁটাই হবে কম। আর যেখানে মানবশ্রমের বিকল্প হিসেবে প্রযুক্তির ব্যবহার হবে, সেখানে ছাঁটাই হবে বেশি।’
এলডিসি-পরবর্তী পরিবেশে বাংলাদেশের আরএমজি সেক্টরে দক্ষ, সাশ্রয়ী সাপ্লাই চেইনের জন্য বাধা ও সমাধান চিহ্নিত করতে ৬৩টি মাঝারি ও বড় পোশাক কারখানার ওপর এ জরিপ পরিচালনা করে বিআইডিএস। ‘সাপ্লাই চেইন ডিনামিকস ফর সাসটেইনেবল আরএমজি গ্রোথ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই গবেষণায় বলা হয়, স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের পর বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের সামগ্রিক রফতানি ৬ শতাংশ কমতে পারে। বাণিজ্যের নেতিবাচক ভারসাম্য জিডিপিকে প্রভাবিত করতে পারে। গ্র্যাজুয়েশনের পর যদি উন্নত দেশগুলো বাংলাদেশী পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া) তাহলে প্রকৃত জিডিপি প্রায় দশমিক ৩৮ শতাংশ কমে যেতে পারে। সমীক্ষার ফল অনুসারে, বাংলাদেশের মোট রফতানি প্রায় ৬ শতাংশ ও পোশাক খাতে প্রায় ১৪ শতাংশ কমতে পারে।
ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক সাজ্জাদ জহিরের সঞ্চালনায় দ্বিতীয় দিনের এ অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহতাব উদ্দিন, বিআইডিএসের গবেষণা সহযোগী জায়েদ বিন সাত্তার, মাহির এ. রহমান প্রমুখ।