আমন কর্তন শেষ ৯৫%, উৎপাদন ১ কোটি ৬৫ লাখ টন ধান
চলতি আমন মৌসুমের ধান কাটা প্রায় শেষ পর্যায়ে। এরই মধ্যে মাড়াই হয়েছে ৯৫ শতাংশ জমির ফসল। এতে উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৬৫ লাখ টন ধান। যদিও এ মৌসুমে সরকারের মোট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ কোটি ৭৮ লাখ টন। পরপর দুটি বন্যার প্রভাবে এবার উৎপাদন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা অবশ্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তাদের দাবি, উৎপাদনের তথ্যটি সঠিক হলে বাজারে এর প্রভাব পড়ত। অথচ ভরা মৌসুমে সরবরাহ কম থাকার অজুহাতে ব্যবসায়ীরা উল্টো চালের দাম বাড়িয়েছেন। তাই সরকারি হিসাবে উৎপাদন কিছুটা বাড়িয়ে দেখানো হতে পারে বলে মনে করছেন তারা। কেউ কেউ অবশ্য জানান, লক্ষ্যের কাছাকাছি উৎপাদন হলেও চালকল মালিকদের কারসাজিতে বাজারে দাম বাড়তি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি আমন মৌসুমে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ৫৬ লাখ হেক্টর। এর মধ্যে ৫৩ লাখ হেক্টর জমির ধান কাটা হয়েছে। যদিও আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৯ লাখ হেক্টর জমি। কিন্তু বন্যার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কিছু এলাকার জমি পুনরায় আবাদ করা সম্ভব হয়নি।
দেশে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমন মৌসুমে রেকর্ড ১ কোটি ৬৬ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়েছিল। এবার সে রেকর্ড অতিক্রম করবে বলে আশা করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। কেননা বিলম্বিত আবাদের কারণে এখনো ৫ শতাংশ আবাদি জমির ফসল কাটা বাকি রয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী আমন ও বোরো মৌসুমে সরবরাহ বেশি থাকায় চালের দাম কিছুটা কমে আসে। কিন্তু এবার বন্যার প্রভাবে উৎপাদন কিছুটা কম হওয়ায় দাম না কমে উল্টো বাড়ছে। এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকারি হিসাবে এবার তিন লাখ হেক্টর জমিতে উৎপাদন কম হয়েছে। বন্যায় কিছু এলাকায় উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। কিছু এলাকায় আবাদ দেরিতে হয়েছে। এতে ফলনও কম হয়। সে হিসেবে উৎপাদন দেড় কোটি টনের বেশি হওয়ার কথা না। কিন্তু কৃষি সম্প্রসারণ থেকে সবসময় উৎপাদন বেশি দেখানো হয়। তাছাড়া উৎপাদন এত বেশি হলে বাজারে এর প্রভাব পড়ার কথা। অথচ ভরা মৌসুমে উল্টো চালের দাম কেজিতে ২-৪ টাকা বেড়েছে।’
দেশের পূর্বাঞ্চলে আগস্টের বন্যায় ২৩ জেলায় ২ লাখ ৮ হাজার ৫৭৩ হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানিয়েছিল কৃষি মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে আমনের ক্ষতি ছিল উল্লেখযোগ্য। বন্যায় রোপা আমন ১ লাখ ৪১ হাজার ৬০৯ হেক্টর ও বোনা আমনের ৭৬৪ হেক্টর আবাদি জমি এবং রোপা আমনের ১৪ হাজার ৯০৮ হেক্টর বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এছাড়া ময়মনসিংহ, শেরপুর ও নেত্রকোনার ১০ উপজেলা সপ্তাহ খানেক পানিতে ডুবে থাকায় নষ্ট হয় ৯৪ হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন, রবিশস্যসহ বিভিন্ন শাকসবজি।
বন্যায় প্রাথমিক ক্ষতি হলেও পলি মাটিতে জমির উর্বরতা বাড়ায় এবার হেক্টরপ্রতি ফলন ভালো হয়েছে বলে দাবি করছেন কৃষি সম্প্রসারণের কর্মকর্তারা। এবারের আমন মৌসুমে প্রতি হেক্টর জমিতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন টন। সেখানে ফলন পাওয়া গেছে ৩ দশমিক ১৭ টন। অর্থাৎ আমন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা থেকে পিছিয়ে থাকলেও হেক্টরপ্রতি ফলনের লক্ষ্য ছাড়িয়ে গেছে।
শেরপুর সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুসলিমা খানম নীলু বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের পাঁচটি ইউনিয়ন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে মাত্র দুটিতে বেশি ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু তার প্রভাব সামগ্রিক উৎপাদনে পড়েনি। সব মিলিয়ে ১০ শতাংশের বেশি উৎপাদন কমবে না।’
সাম্প্রতিক দুটি বন্যার প্রভাবে এবার আমন উৎপাদন গতবারের চেয়ে কমে ১ কোটি ৪০ লাখ টনে নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা ছিল মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ)। সাম্প্রতিক প্রকাশিত সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যায় আমনের প্রায় দুই লাখ হেক্টর আবাদি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। আবার অক্টোবরের শুরুর দিকে শেরপুর ও ময়মনসিংহে আকস্মিক বন্যায় প্রায় এক লাখ হেক্টর আমনের ফসলি জমি ক্ষতির শিকার হয়। সব মিলিয়ে এবার আবাদি এলাকা কমেছে প্রায় আড়াই লাখ হেক্টর। এর প্রভাবে আমন উৎপাদন গতবারের চেয়ে কমার পূর্বাভাস দিয়েছিল ইউএসডিএ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ছাইফুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বন্যায় কিছু এলাকায় আমন চাষ ব্যাহত হয়েছে। এতে উৎপাদন কিছুটা কম হলেও ফলন কিন্তু ভালো হয়েছে। তাই উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি আমরা। যদি বন্যার প্রভাব না পড়ত তাহলে ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেত এবার।’
এদিকে আমনের ভরা মৌসুমেও দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ৫-৬ টাকা বেড়ে সরু চাল সর্বোচ্চ ৮৫-৮৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি কেজিপ্রতি ৪-৫ টাকা বেড়ে মোটা চাল সর্বোচ্চ ৬০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এতে ধানের মৌসুমেও চাল কিনতে বিড়ম্বনায় পড়ছে ভোক্তারা। আমনের বাম্পার ফলন হলেও চালকল মালিকদের কারসাজিতে চালের দাম বাড়ছে বলে মনে করছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রিপন কুমার মণ্ডল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এখন ছোট ছোট হাসকিং মিল আর নেই। সে কারণে বড় বড় মিলাররা বাজারে প্রভাব রাখছে। কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত চাল আসতে বেশ কয়েকবার হাতবদল হচ্ছে। সেখানে দাম বেড়ে যাচ্ছে। আবার চাহিদা ও উৎপাদনের সঠিক হিসাব না থাকায়ও সমস্যা তৈরি হচ্ছে।’
সার্বিক বিষয়ে কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা বন্যাপ্রবণ এলাকায় নতুন করে বীজ সরবরাহ করে উৎপাদন ঠিক রাখার চেষ্টা করেছি। সারের ব্যবস্থা করেছি। তবে চেষ্টার পরও কিছু এলাকায় পুনরায় আবাদ করা যায়নি। কিন্তু বন্যার প্রভাব বাদ দিয়ে বাকি এলাকায় আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ফলন ভালো হয়েছে। তাই এবার সার্বিক উৎপাদনও ভালো হয়েছে।’