অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষত সৃষ্টি করবে বিদ্যুতের ভর্তুকি
বিগত সরকারের মতোই অন্তর্বর্তী সরকার বন্ডের মাধ্যমে বিদ্যুতের ভর্তুকি বাবদ বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ নিয়েছে। বন্ডও একপ্রকার ঋণ। অর্থাৎ এক ঋণ পরিশোধে অন্য ঋণের দ্বারস্থ হচ্ছে সরকার।
বিগত সরকারের মতোই অন্তর্বর্তী সরকার বন্ডের মাধ্যমে বিদ্যুতের ভর্তুকি বাবদ বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ নিয়েছে। বন্ডও একপ্রকার ঋণ। অর্থাৎ এক ঋণ পরিশোধে অন্য ঋণের দ্বারস্থ হচ্ছে সরকার। এটি যদি নিয়মিত চর্চা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তা উদ্বেগের কারণ। ভবিষ্যতে এ ঋণের বোঝা আরো বাড়বে। বন্ডের মাধ্যমে বিদ্যুতের ভর্তুকি বাবদ বকেয়া পরিশোধ করা কোনো টেকসই সমাধান নয়। এমনিতেই দেশের ঋণের বোঝা ক্রমাগত বাড়ছে। এভাবে ঋণ বাড়তে বাড়তে ঋণের ভার এমন পর্যায়ে চলে যাবে, তখন সেটি পরিশোধ করার ক্ষমতা থাকবে না। এ বিষয়ে সরকারের সতর্ক হওয়া উচিত। ভবিষ্যৎ ঋণের ঝুঁকি এড়াতে বন্ডের মাধ্যমে ঋণ বা বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ পরিহার করাই উত্তম। রাজস্ব আয় বাড়িয়ে নিজস্ব অর্থায়নের মাধ্যমে বকেয়া বা ঋণ পরিশোধের মতো টেকসই সমাধানের দিকে এগোতে হবে সরকারকে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) রাজস্ব আহরণ বাড়িয়ে নিজস্ব অর্থায়নের মাধ্যমে ঋণ বা বকেয়া পরিশোধের পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু এ পরামর্শ বাস্তবায়নে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সক্ষমতা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন উঠছে। কারণ প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বছর রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে তা কোনো বছরই পূরণ করতে পারে না। এর অন্যতম কারণ প্রত্যক্ষ করের চেয়ে পরোক্ষ করের ওপর বেশি নির্ভরশীলতা। সরকারের রাজস্বের ৭০ শতাংশই আসে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও শুল্কের মতো পরোক্ষ খাত থেকে। প্রত্যক্ষ কর থেকে আসে বাকি ৩০ শতাংশ। আবার প্রত্যক্ষ করের ৮৫ শতাংশই আসে উৎসে কর কর্তন ও অগ্রিম কর থেকে। মূলত কর প্রদানে সক্ষম দেশের মানুষের বড় একটা অংশ করজালের বাইরে থাকায় তাদের কাছ থেকে রিটার্নের ভিত্তিতে আয়কর আহরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া আয়কর আহরণ ও আদায় পদ্ধতি অনেকটা ঝামেলাপূর্ণ হওয়ায় করদাতারাও আয়কর প্রদানে খুব একটা আগ্রহ দেখান না। ফলে ব্যয় মেটাতে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভর করতে হয় সরকারকে। বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত এখনো ১০ শতাংশের ঘরে, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। এনবিআরের রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে প্রত্যক্ষ করের আওতা বাড়ানোসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া আবশ্যক। আর কর-জিডিপি অনুপাত কম থাকার কারণে সরকার নাগরিকদের পেছনে বেশি অর্থ ব্যয় করতে পারে না। ফলে বিভিন্ন উৎস থেকে সরকারকে ঋণ করতে হয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে রাজস্ব আহরণ হতাশাজনক। কর-জিডিপি অনুপাতের ক্ষেত্রে একেবারে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। কর-জিডিপির অনুপাত বাড়াতে দেশের অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বরাবরই পরামর্শ দিচ্ছেন। নীতিনির্ধারকরা এ নিয়ে সবসময়ই আশাবাদী থাকেন। অথচ বাস্তবতা তার বিপরীত। গত এক দশকে কর-জিডিপি অনুপাত না বেড়ে বরং কমে এসেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কর-জিডিপির অনুপাত ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সত্ত্বেও রাজস্ব আহরণে দুর্বলতা ঘোচেনি। কর-জিডিপির অনুপাত বাড়াতে হলে প্রত্যক্ষ কর আহরণে বেশি গুরুত্ব দেয়া দরকার। কর কর্মকর্তাদের অসীম ক্ষমতা দেয়া হলেও কর ব্যবস্থার দক্ষতা বাড়েনি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে এক কোটির বেশি মানুষ করদাতা শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন)। টিআইএনধারীর সংখ্যা বাড়লেও সেভাবে কর আহরণ বাড়েনি। সে অর্থবছরে টিআইএনধারী প্রায় ৫৯ শতাংশই আয়কর রিটার্ন দাখিল করেনি। অর্থাৎ নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়লেও রিটার্ন জমা দেয়া ব্যক্তির সংখ্যা সেই তুলনায় কম। এনবিআরের হিসাবে গত অর্থবছর শেষে দেশে টিআইএন ছিল ১ কোটি ৪ লাখ। আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন মাত্র ৪৩ লাখ। এটি আগের বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ বেশি। কমসংখ্যক রিটার্ন জমা দেয়ার জন্য অপর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণ ও আইনের প্রয়োগ, স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়মিত করদাতা জরিপের অনুপস্থিতি এবং কর প্রশাসনের অটোমেশনের ধীর গতিই দায়ী। সামগ্রিকভাবে দেশে কর আদায় ব্যবস্থা যথাযথভাবে সম্প্রসারিত না হওয়ায় কর প্রদানে মানুষের আগ্রহ কম।
কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে রাজস্ব আহরণে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করবে কে? এ খাতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির অন্ত নেই। করদাতাকে হয়রানি করে। তাদের বিরুদ্ধে সামান্য অর্থের বিনিময়ে বড় বড় কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির সুযোগ করে দেয়ার অভিযোগ অনেক পুরনো। কর ফাঁকি দিতে রাজস্ব বিভাগের এক শ্রেণীর কর্মকর্তার সঙ্গে এক ধরনের বন্দোবস্ত করে ফেলেন এসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। এতে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয় দেশ। কর ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তন আনার পাশাপাশি কর প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। কর আহরণে অটোমেশন পদ্ধতি চালুর পাশাপাশি দুর্নীতি কমিয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
কর-জিডিপির অনুপাতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) একটি নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। যেসব দেশে কর-জিডিপির অনুপাত বেশি সেসব দেশে বিনিয়োগের পরিমাণও বেশি। ভিয়েতনামে কর-জিডিপির অনুপাত সাড়ে ১১ শতাংশ। ফলে আমাদের দেশের তুলনায় সেই দেশে বিপুল পরিমাণে এফডিআই বা প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ আসে। কর-জিডিপির অনুপাত বেশি হলে বিনিয়োগকারীরা আশ্বস্ত হন।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে জিডিপি অনুপাতে কর ২ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়লে গড়ে অতিরিক্ত ৬৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা রাজস্ব আয় বাড়বে। এ বাড়তি রাজস্ব বিভিন্ন খাতে সরকার বিনিয়োগ করলে তা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বাড়বে। দেশের মোট সম্পদের ৩০ শতাংশই ১০ শতাংশ ধনীর হাতে। তাদের কাছ থেকে ঠিকঠাকভাবে কর আদায় করা গেলে এর চেয়ে বেশি রাজস্ব আহরণ হবে। আয়বৈষম্যও কমে আসবে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গিনি-কোইফিশিয়েন্ট হিসেবে ১৯৯০ সালে দেশে বৈষম্য ছিল শূন্য দশমিক ৩৫, তা এখন শূন্য দশমিক ৪৯-এ এসে দাঁড়িয়েছে। আয়বৈষম্য বেড়েছে। ঠিকঠাকভাবে রাজস্ব আহরণ নিশ্চিত করা গেলে এ আয়বৈষম্য অনেকাংশেই কমিয়ে আনা যাবে। কিন্তু এর জন্য দরকার সঠিক পরিকল্পনা ও নীতি এবং তার বাস্তবায়ন। কিন্তু বিদ্যমান যেসব আইনকানুন রয়েছে সেগুলোই ঠিকমতো বাস্তবায়ন হতে দেখা যায় না। ফলে অর্থনীতির গতির সঙ্গে সমন্বয় করে রাজস্ব আদায় বাড়ছে না।
বন্ডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি বাবদ বকেয়া পরিশোধের সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি। যে পরিমাণ অর্থ বন্ড হিসেবে ইস্যু করা হবে সেটি অন্য খাতে বিনিয়োগ করা হলে কর্মসংস্থান তৈরি ও অর্থনীতি আরো গতিশীল হতো। কিন্তু বন্ডের মাধ্যমে ঋণ পরিশোধ করায় সরকারের ঋণ না কমে আরো বোঝা বাড়ছে। বন্ড মাধ্যমে বকেয়া পরিশোধের উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে সমস্যা সৃষ্টি করবে। তাই সরকারের উচিত রাজস্ব আহরণ বাড়িয়ে নিজস্ব অর্থায়নে ঋণ পরিশোধে উদ্যোগী হওয়া।