কোম্পানি পরিচালক ও স্বার্থ সংশ্লিষ্টদের শ্রেণীকৃত ঋণের তথ্য দৃশ্যমান রাখতে হবে
কোম্পানির অডিট প্রতিবেদনে পরিচালক ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্টদের শ্রেণীকৃত ঋণের প্রকৃত তথ্য প্রকাশের সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ওয়েবসাইটে তাদের আর্থিক বিবরণী প্রকাশের ব্যবস্থা ও ব্যক্তিমালিকানাধীন এবং অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অডিট বাধ্যতামূলক করতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে উৎসে কর কর্তন (টিডিএস) ও উৎসে ভ্যাট কর্তনের (ভিডিএস) সঠিকতা যাচাইয়ের দায়িত্ব সিএফওদের হওয়ায় তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছে।
‘অডিট রিপোর্টের যথার্থতা ও মানোন্নয়ন’ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতামত জানতে চেয়ে গত ১২ নভেম্বর এক চিঠি দিয়েছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের (ডিভিশন-২) পরিচালক মো. আলাউদ্দিন স্বাক্ষরিত এক পত্রে এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে বেশকিছু সুপারিশ পাঠানো হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টিতে অডিট ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন-১-এর দ্বিতীয় সচিব নাজমা পারভিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
অডিট প্রতিবেদন তৈরির সময় ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেমে (ডিভিএস) সাধারণত প্রতিষ্ঠানের মোট দায়, কর-পূর্ববর্তী মুনাফা, ক্রমপুঞ্জিত আয়, রাজস্ব, মোট সম্পদ ইত্যাদি বিষয়ের তথ্য সংযুক্ত করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারিশে নিরীক্ষক কর্তৃক অডিট সময়ে প্রতিষ্ঠান গৃহীত ঋণের মধ্যে শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ ও হার অডিট রিপোর্টে উল্লেখ করতে হবে এবং তা ডিভিএসে দৃশ্যমান রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়।
অডিট রিপোর্টে প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্টদের শ্রেণীকৃত ঋণের প্রকৃত তথ্য প্রকাশের সুপারিশকে সাধুবাদ জানিয়েছেন এনবিআর ও ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্যমতে, এটি সঠিকভাবে পরিপালন করা গেলে তা ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের প্রবণতা কমিয়ে আনায় সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চিঠিতে পরিচালক বোঝাতে কোম্পানি নাকি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের কথা বোঝানো হয়েছে জানতে চাইলে এনবিআর সদস্য (কর নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত) মো. আলমগীর হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এখানে কোম্পানির পরিচালকদের কথা বোঝানো হয়েছে।’
সুপারিশগুলো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল (এফআরসি), দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি), দি ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি) ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে থেকে অডিট-সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিয়ে আরো সুপারিশ এসেছে। আমরা এগুলো একত্র করে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার কাছে পাঠিয়ে দেব।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারিশে অডিট রিপোর্টের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে অডিটরদের ন্যায্য পারিশ্রমিক, তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে আধুনিক হিসাব ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার সঙ্গে মানিয়ে চলার জন্য দক্ষ করে তোলার ওপর জোর দেয়া হয়। একই সঙ্গে অডিটররা কোনো বিধিবিধানের ব্যত্যয় ঘটালে এর জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণেরও কথা বলা হয়েছে।
সুপারিশে বলা হয়েছে, কোনো চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি ফার্মের বিরুদ্ধে অনিয়ম শনাক্ত হলে শুনানির জন্য এফআরসি বা আইসিএবি গঠিত তদন্ত কমিটিতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ইচ্ছাকৃত ভুল, ত্রুটি, বিচ্যুতি উদ্ঘাটন হলে অডিটরদের শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। সব মূলধনি ব্যয়ের চেক বা নোট সিএফও ও চেয়ারম্যান বা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের যৌথ স্বাক্ষরে অনুমোদন হওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
এনবিআরের আয়কর বিভাগের সংশ্লিষ্টরা দাবি করেন, এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে অডিট রিপোর্টে স্বচ্ছতা আসবে। বর্তমানে ব্যক্তির জন্য অডিট বাধ্যতামূলক নয় আর ফার্মের ক্ষেত্রে টার্নওভার ৫ কোটির ওপরে হলে বাধ্যতামূলক। উৎসে কর কর্তন ও উৎসে ভ্যাট কর্তনের সঠিকতা যাচাইয়ের দায়িত্ব যাদের তাদের ব্যক্তিগতভাবে আয়কর আইনের ১৪৩ (১) ধারায় দায়বদ্ধ করা আছে। কোম্পানির পরিচালক ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্টদের শ্রেণীকৃত ঋণের প্রকৃত তথ্য অডিট রিপোর্টে প্রকাশ এবং কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ওয়েবসাইটে তাদের আর্থিক বিবরণী প্রকাশের সুপারিশও যৌক্তিক।
এনবিআর সদস্য (ভ্যাট বাস্তবায়ন ও আইটি) ড. মো. আব্দুর রউফ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উৎসে ভ্যাট কর্তনের জন্য ভ্যাট আইনে সরবরাহকারী ও সরবরাহ গ্রহণকারী উভয়কে সমানভাবে দায়ী করা হয়েছে। ভ্যাট আইনে তিনজনকে মূলত দায়ী করা হয়েছে। তারা হলেন উৎসে ভ্যাট কর্তনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি, উৎসে ভ্যাট কর্তন করার পর সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী। অনেক সিএফও নিজেই এসব কাজ করেন। তার পরও সিএফওকে দায়বদ্ধ করা যেতে পারে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাষ্যমতে, শিল্প খাত ও প্রতিষ্ঠান ভেদে নগদ লেনদেনের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করাসহ নগদ লেনদেনের ক্ষেত্র সীমিত করার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে, যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের লেনদেনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যেতে পারে।
এতে আরো বলা হয়, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অডিট কার্যক্রমে নিয়োজিত সব নিরীক্ষা ফার্মকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের ২০২৪ সালের ৯ জুলাইয়ের সার্কুলার লেটার নম্বর-৩১-এর মাধ্যমে জারীকৃত ‘ব্যাংক কোম্পানি বহির্নিরীক্ষণ বিধিমালা, ২০২৪’ শীর্ষক প্রজ্ঞাপনের বিধিবিধান যথাযথভাবে পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া অডিট রিপোর্টের যথার্থতা ও মানোন্নয়নে আধুনিক প্রযুক্তি ও বিশেষায়িত নিরীক্ষা সফটওয়্যার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।