চাহিদামতো টাকা দিতে পারছে না কয়েকটি ব্যাংক
চরম তারল্য সংকটে আছে দেশের কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার পেয়েও সংকট কাটাতে পারছে না ব্যাংকগুলো।
ফলে গ্রাহকের চাহিদামতো টাকা দিতে পারছে না এসব ব্যাংক। গত কয়েক মাসে তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা ধার দেওয়া হয়েছে।
এর মধ্যে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছেপে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর বাকি সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে গ্যারান্টির মাধ্যমে ধার দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে সংকটে থাকা কয়েকটি ব্যাংকের শাখা পরিদর্শনে গিয়ে গ্রাহকদের অতি প্রয়োজনেও টাকা না পাওয়ার বেশ কিছু চিত্র চোখে পড়ে।
রফিকুল ইসলাম নামের ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী তার অসুস্থ বাবার দেওয়া চেক নিয়ে দুই মাস ধরে ঘুরছেন। তার বাবা মিরপুর-১০ নম্বরে একটি বেসরকারি ব্যাংকের গ্রাহক। নিজের সেমিস্টার ফি ও বাবার চিকিৎসার জন্য দুই লাখ টাকার চেক কোনোভাবেই তিনি ক্যাশ করতে পারছেন না। টাকাটা খুবই প্রয়োজন ওই শিক্ষার্থীর।
নিরুপায় হয়ে রফিক টাকাটা তুলতে ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের পরিচিত এক কর্মকর্তার দ্বারস্থ হোন। তিনি শাখা ব্যবস্থাপককে বলে দেওয়ার পরও টাকাটা তুলতে পারেননি। রফিকুল বলেন, ‘নিজেদের জমানো টাকা তুলতে এভাবে জুতা ক্ষয় করতে হবে তা কখনো ভাবিনি। এই টাকা কবে পাব, তাও বলতে পারছি না। ’
সংকটে থাকা আরেক বেসরকারি ব্যাংকের এক শাখায় কথা হয় গ্রাহক নুরুজ্জামান সৈকতের সঙ্গে। তিনি ৫০ হাজার টাকা তুলতে এসেছেন। কিন্তু তাকে দেওয়া হয়েছে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। এ নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, ‘পুরান ঢাকায় আমার একটা ছোট্ট ব্যবসা আছে। এখানে কয়েকজন কর্মীও রয়েছে আমার। মাস শেষে তাদের বেতন দিতে হয়। ব্যাংকে টাকা থাকা সত্ত্বেও এখন তাদের টাকা দিতে পারছি না। তাদের সামনে আমি বেইজ্জত হয়ে গেছি। ’
ঢাকার একজন আইনজীবী ওই ব্যাংক থেকে ডিপিএসের বিপরীতে ঋণ নিয়েছিলেন। সেই টাকা স্থানান্তর করেন ওই শাখাতেই তার মেয়ের অ্যাকাউন্টে। প্রথম দফায় হাজার পঞ্চাশেক তুলতে পারলেও বাকি টাকা আর তুলতে পারছেন না। ব্যাংকটির বাসাবো শাখা অক্টোবর থেকে জনপ্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে দিচ্ছে বলে জানান ওই আইনজীবী। ব্যবস্থাপকের সঙ্গে দেখা করেও লাভ হয়নি। ব্যক্তিগত তথ্য বলে তিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি।
ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকের উদ্ধৃতি দিয়ে ওই আইনজীবী জানান, সবাই একসঙ্গে টাকা তুলতে আসায় এমনটি হচ্ছে। তাদের কিছুই করার নেই। পরে ওই আইনজীবী ঋণের টাকা তুলতে না পারলেও এর বিপরীতে ঠিকই তাকে সুদ গুনতে হবে। এ নিয়ে ক্ষোভ ও বিরক্তি প্রকাশ করেন তিনি।
ওই আইনজীবীর মতো হাজারো গ্রাহক এখন বেশ কয়েকটি ব্যাংক থেকে জরুরি দরকারে নিজের অর্থ তুলতে পারছেন না। এমনকি কিছু ব্যাংকার যেমন নিজের বেতনের টাকাও তুলতে পারছেন না, তেমনি এসব ব্যাংকে ‘স্যালারি অ্যাকাউন্ট’ থাকা অন্য প্রতিষ্ঠানের কর্মীদেরও টাকা পেতে নাজেহাল হতে হচ্ছে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ফোরকান উল্লাহ বলেন, ‘বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রতিদিনই মানুষ টাকা তুলতে আসে। আমরা এখন সব গ্রাহকের পুরো চাহিদা পূরণ করতে পারছি না। তবে সবাইকেই কিছু না কিছু দেওয়ার চেষ্টা করছি। সব গ্রাহক একসঙ্গে টাকা চাইলে বিশ্বের কোনো ব্যাংকই টাকা দিতে পারবে না। আগের সপ্তাহগুলোতে যতটা চাপে পড়তে হয়েছে এখন সেই চাপ অনেকাংশেই কমে এসেছে। ’
তিনি আরো বলেন, ‘ইদানীং আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ভালো রকমের সহায়তা পাচ্ছি। আশা করি খুব অল্প সময়ের মধ্যে গ্রাহকের সব চাহিদা পূরণ করতে পারব। পাশাপাশি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ওপর আস্থা ফিরে আসবে গ্রাহকের। ’
সংকটে থাকা একটি ব্যাংকের দিলকুশা শাখার মহাব্যবস্থাপক বলেন, ‘গত ২৭ নভেম্বর থেকে আমরা এটিএম বুথেও টাকা দেওয়া শুরু করেছি। প্রতিদিন গ্রাহক পাঁচ হাজার টাকা করে তুলতে পারবেন। বুথ থেকে কোনো গ্রাহক শাখায় গেলে টাকা পাবেন না। যেকোনো এক জায়গা থেকে একজন গ্রাহক দিনে একবার টাকা উত্তোলন করতে পারবেন। ’ আগামী কিছুদিনের মধ্যে সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে বলে মনে করেন এই শাখার মহাব্যবস্থাপক।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে হওয়া অনিয়মের জের টানছে ব্যাংক খাত। কয়েক দশক ধরে এ নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা হলেও যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। খেলাপি ঋণ আর লুটপাটে প্রথম দিকে সরকারি মালিকানার ব্যাংক এবং পরে বেসরকারি খাতের ব্যাংককেও রুগ্ণ করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। নানা উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও তা কাগজে-কলমেই রয়ে গেছে। কেতাবি আলোচনা হয়েছে দিনের পর দিন।
তাদের মতে, ব্যাংকগুলো টাকা ফেরত দিতে না পারার দায় এককভাবে শুধু ব্যাংকগুলোর নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপরেও দায়িত্ব বর্তায়। কারণ লাইসেন্স দাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমানতের সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থার। কিন্তু গত ১৫ বছরে ব্যাংক খাতের অনিয়ম-দুর্নীতি তাকিয়ে দেখা ছাড়া কোনো কাজ করেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। এমনকি দুর্নীতিবাজদের আইনি সুবিধা দিয়ে এসেছে সংস্থাটি। কিছু অসাধু কর্মকর্তার জন্য পুরো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, ‘ব্যাংকে গ্রাহকের আমানতের টাকা নিয়ে আতঙ্কের কিছুই নেই। সবাই তার আমানতের টাকা ফিরে পাবেন। ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াতে কিছুটা সময় লাগবে। অপ্রয়োজনে বা এক ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অন্য ব্যাংকে রাখার প্রবণতা না কমলে সব গ্রাহকের টাকা একসঙ্গে ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়। একযোগে সব গ্রাহক টাকা তুলতে গেলে পৃথিবীর কোনো ব্যাংকই টিকবে না। কিছু গ্রাহকের আমানতের টাকা উঠানোর প্রয়োজন হচ্ছে না, তার পরও তারা টাকা তুলতে যাচ্ছেন। ফলে কিছু ব্যাংকের তারল্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। ব্যাংকগুলো যেন ঘুরে দাঁড়াতে পারে সে জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক গ্যারান্টির সুবিধা অব্যাহত রেখেছে। তবে অধৈর্য হলে চলবে না। একটু সময় দিতে হবে। ’
মুখপাত্র আরো বলেন, ‘আমরা ১১টি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করেছি। এসব ব্যাংক নিয়ে কাজ চলছে। শুরুতে মনোযোগ ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর দিকে। তবে এই ১১ ব্যাংকই শেষ নয়, প্রতিটি ব্যাংকের অনিয়মই খতিয়ে দেখবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ’