লাগামছাড়া ওষুধের দাম
দেশের চলমান পরিস্থিতির মধ্যেও থেমে নেই বাজারে ওষুধের দাম বাড়ার প্রতিযোগিতা। খোঁড়া অজুহাতে অনেক কোম্পানি ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে চলছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে কারফিউ, শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং অন্তর্বর্তী সরকার গঠনসহ নানা কারণে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ছিল উত্তপ্ত।
এই সময়েও বেশ কয়েকটি ওষুধের দাম যেমন-ভিটামিন, গ্যাস্ট্রিক, অ্যান্টিবায়োটিক, ইনজেকশন, ব্যথানাশক ট্যাবলেট এবং ডায়াবেটিকস রোগীর বিভিন্ন ধরনের জীবনরক্ষাকারী ওষুধের দাম বেড়েছে ৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৪৯ শতাংশ। আর ধারাবাহিক এবং নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ওষুধের দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। শনিবার সরেজমিন রাজধানীর বংশাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা, শাহবাগ এবং বিভিন্ন পাড়া-মহল্লার একাধিক ওষুধের দোকান ঘুরে ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
পাইকারি ও খুচরা ওষুধ বিক্রেতাদের অভিযোগ, উৎপাদন ব্যয়ভারের নানা খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে ইচ্ছেমতো প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম বাড়ানো হচ্ছে। মূলত ওষুধের মূল্য নির্ধারণে সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা না থাকায় এবং যথাযথ মনিটরিং ব্যবস্থা না নেওয়ায় ব্যাপক হারে বাড়ছে ওষুধের দাম। ফলে এ খাতে জনসাধারণের ব্যয়ও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। তাই ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নতুন সরকারের নজর দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন তারা।
তবে ওষুধের দাম বাড়ার পেছনে ডলারের দাম, কাঁচামালের দাম এবং গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়াকে কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন ওষুধ কোম্পানিগুলোর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা।
ব্যবসায়ীরা জানান, দেশে হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি কাঁচামাল উৎপাদন করে। যা মোট চাহিদার মাত্র ৫ শতাংশ। অর্থাৎ কাঁচামাল উৎপাদনে এখনও আমরা পিছিয়ে আছি। আবার বিদেশ থেকে কাঁচামাল আনতে গিয়ে এলসি সংক্রান্ত অনেক দুর্ভোগে পড়তে হয়। সময়মতো পণ্য পাওয়া যায় না। তা ছাড়া পণ্য পরিবহন খরচও অনেক বেশি। তাই আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে কাঁচামাল উৎপাদন করা গেলে ওষুধ প্রস্তুতকারীদের খরচ ও ওষুধের দাম কমবে।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওষুধ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের (বিএপিআই) এক নেতা বলেন, ওষুধ উৎপাদন ব্যয়, প্যাকেজিং মূল্যবৃদ্ধি, পরিবহন, কর্মচারী খরচ, গ্যাস-বিদ্যুৎ বা জ্বালানি খরচ দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। আবার ওষুধের গুণগত মান এবং উৎপাদন খরচের জন্য দামে তারতম্য হয়। কিন্তু কেউ ইচ্ছা করলেই ওষুধের দাম বাড়াতে পারে না। কোনো কোম্পানির ওষুধের দাম নির্ধারণ করতে হলে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরে আবেদন করতে হয়। পরে ঔষধ প্রশাসন তা যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত দেয়।
সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা ঘুরে দেখা গেছে, এক মাস আগে ইনফ্লুয়েঞ্জা সমস্যাজনিত রোগীদের জন্য ব্যবহৃত ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ট্যাবলেট কিলব্যাক ২৫০ এমজির প্রতি পিসের দাম ১২ থেকে ১৫ টাকা হয়েছে। এক পাতা ৬টির দাম আগে ছিল ৭২ টাকা আর এখন বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায়। দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ। জিসকা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট প্রতি পিস ৯ টাকা থেকে ১০ টাকা হয়েছে। এক পাতা ১০টির দাম আগে ছিল ৯০ টাকা আর এখন বেড়ে হয়েছে ১০০ টাকা। বেড়েছে ১০ শতাংশের ওপরে। হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের বমিভাব দূর করার জন্য ব্যবহৃত ইমিসটেট এফটি ট্যাবলেট প্রতি পিস ১০ থেকে বেড়ে ১২ টাকা হয়েছে। এক পাতা ১০০ টাকা থেকে হয়েছে ১২০ টাকা। এই ট্যাবলেটের দাম বেড়েছে শতকরা ২০ শতাংশ।
রেনেটা লিমিটেড কোম্পানি ৫০০ মিলিগ্রাম ভায়াল মেরোপেন ইনজেকশনের দাম ৭০০ টাকা বেড়ে ১ হাজার ৪০ টাকা করা হয়েছে। অর্থাৎ শতকরা হিসেবে বেড়েছে ৪৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ। একই কোম্পানির ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণে ব্যবহৃত কোরালসিন-ডিএক্স প্রতি পিস ১৫ টাকা থেকে ১৭ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক পাতা ৩০টি আগে বিক্রি হতো ৪৫০ টাকায় এখন বেড়ে হয়েছে ৫১০ টাকা। অর্থাৎ বেড়েছে ১৩ শতাংশের ওপরে। আবার একই ওষুধ রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ট্যাবলেট কোরারক্যাল ডিএক্সের দাম প্রতি পিস ১৫ টাকা থেকে বেড়ে ১৭ টাকা করা হয়েছে। এক পাতা ১০টির দাম ১৫০ টাকা থেকে ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বেড়েছে ১৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
ক্যালসিয়ামজনিত সমস্যায় ব্যবহৃত ইউরো ফার্মা লিমিটেডের ভিটাকোরাল ডিএক্স এক পাতা ১২০ টাকা থেকে বেড়ে ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। এরিস্টো ফার্মা লিমিটেডের ভিটামিন জাতীয় ট্যাবলেট নিওবিয়ান ভিটামিন বি-১, বি-৬, বি-১২-এর আগে এক পাতা ১০টির দাম ছিল ১০০ টাকা, সেটি এখন বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। বেড়েছে ২০ শতাংশ। হাঁপানি চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইনসেপ্টা লিমিটেডের বুডিকর্ট নেবুলাইজার সাসপেনশন ২ এমএল পাঁচটির দাম ছিল ১০০ টাকা, তা এখন বিক্রি হচ্ছে ১২৫ টাকা। দাম বেড়েছে ২৫ শতাংশ। একই কোম্পানি চোখের সমস্যাজনিত ড্রপস অপটিমক্স ৫ এমএলের দাম ১৬০ টাকা থেকে বেড়ে ২০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। দাম বেড়েছে ১৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। এ ছাড়াও ইনসেপ্টা লিমিটেডের শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ব্যবহৃত আরেক ওষুধ উইন্ডেল প্লাস ৩ এমএলের দাম ২০ টাকা থেকে বেড়ে ২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ ২৫ শতাংশ বেড়েছে।
ওষুধের দাম বাড়ার ব্যাপারে রাজধানীর বংশাল এলাকার উপসম মেডিকেল হলের স্বত্বাধিকারী ওমর ফারুক সময়ের আলোকে বলেন, প্রতিদিনই বাজারে কিছু না কিছু ওষুধের দাম বাড়ে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে অনেক ওষুধের দাম বেড়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভিটামিন জাতীয় ট্যাবলেট ও বিভিন্ন ইনজেকশনের দাম। আর দাম বাড়ার কারণে আমাদেরও অনেক সময় ক্রেতাদের নানা ধরনের কথা শুনতে হয়। কিন্তু আমরা কী কবর, কোম্পানি দাম বাড়ালে তো আমাদের কিছু করার থাকে না। আমাদেরও সেভাবেই ব্যবসা করতে হয়।
শাহবাগ এলাকার ইত্যাদি মেডিসিন সেন্টারের কর্মচারী মো. বাদল মিয়া সময়ের আলোকে বলেন, দাম তো অনেক ওষুধের বেড়েছে। কোনটা রেখে কোনটার নাম বলব। তবে যেসব রোগী নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছেন, তারা বাড়তি দাম দিতে গিয়ে আমাদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছেন। অনেক সময় কটু কথা বলতেও শোনা যায়।
রাজধানীর সোল ফার্মার বিক্রয়কর্মী ফয়েজ উদ্দিন সময়ের আলোকে বলেন, দেশে যে হারে ওষুধের দাম বাড়ছে তা অব্যাহত থাকলে গরিব মানুষের জন্য ওষুধ খাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। কিন্তু আমাদের তো কিছুই করার নেই। কোম্পানির রেট অনুযায়ী আমাদের বিক্রি করতে হয়।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ সময়ের আলোকে বলেন, দেশে ১১৭টি জেনেরিক ওষুধের দাম সরকারের নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু এসব ওষুধের বাইরে যত ধরনের ওষুধ রয়েছে তার সবই দাম নির্ধারণ করে কোম্পানিগুলো।
পৃথিবীজুড়েই ওষুধের দাম নির্ধারণে একটি আলাদা ব্যবস্থাপনা বা অথরিটি আছে। তারা ওষুধের দাম নির্ধারণ করেন। এমনকি ভারতেও প্রাইস মনিটরিংয়ের জন্য আলাদা সংস্থা রয়েছে। তারা ঠিক করেন কোন ওষুধের দাম কী হবে। কিন্তু আমাদের দেশে ব্যতিক্রম। সবই ঔষধ প্রশাসন করে। ওষুধ কোম্পানিগুলো তারা নিজেদের ওষুধের প্রচার করতে অ্যাগ্রেসিভ মার্কেটিং কৌশল ব্যবহার করে। তাই কোম্পানিগুলোর পছন্দের তালিকায় চিকিৎসকসহ কিছু বিষয় জড়িত আছে। বাণিজ্যিক পণ্যের দাম বাড়বে। তবে ওষুধ অন্যান্য নিত্যপণ্যের মতো না। ওষুধের বাজার শতভাগ সরকারের নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে এবং প্রতি বছর যৌক্তিকভাবে দাম সমন্বয় করতে হবে। এটি করা গেলে আগ্রাসী বাণিজ্য বন্ধ হবে এবং প্রমোশনাল ব্যয় অনেক কমবে।
তিনি বলেন, ওষুধ হচ্ছে কমার্শিয়াল প্রোডাক্ট। স্বাভাবিকভাবেই দাম বাড়বে। তবে শুধু ওষুধ নয়, সবকিছুর দাম বেড়েছে। যেমন রোগ শনাক্তের খরচের পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাও বেড়েছে। বাড়তি হাসপাতালে অবস্থান ও যাতায়াত খরচ। ফলে সাধারণ মানুষের এক ধরনের কষ্ট হচ্ছে। এসব থেকে পরিত্রাণের জন্য সবার আগে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির সিস্টেমে হাত দিতে হবে। সব ধরনের ওষুধের মূল্য সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ফর্মুলার ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে। তা না হলে সমস্যা থেকেই যাবে।
দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক মো. আসরাফ হোসেনকে একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।