স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এলো আরো এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশায়
অগ্নিঝরা মার্চের প্রথম দিন আজ। ১৯৭১ সালের এই মার্চেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে স্বাধীনতার জন্য মুক্তিসংগ্রাম শুরু করে বাঙালি জাতি। ৯ মাস ধরে চলা মুক্তিসংগ্রামের বিজয় ধরা দেয় ১৬ ডিসেম্বরে এসে। উত্তাল মার্চ তাই জাতির কাছে সংগ্রামের মাস, স্বাধীনতার মাস। বাঙালির জীবনে মার্চ মাস অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস।
আগামী ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। ২০২১ সালে বাঙালির সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এবারের মার্চ এসেছে এক নতুন প্রত্যাশা নিয়ে।
বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন ১৯৭১ সালে জাতি দেখেছিল, সেই রাষ্ট্র গঠনের শপথ নেওয়ার মাস এই মার্চ। আগামী প্রজন্ম দেশকে সেই গণতন্ত্রের পথে, সমৃদ্ধির পথে আরো এগিয়ে নেবে সেই প্রত্যাশার স্বপ্নে বিভোর সারা দেশের মানুষ।
স্বাধীনতার ৫০ বছর পূরণ হবে এ মাসেই—২৬ মার্চ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাস মার্চ এবার এসেছে ভিন্ন বার্তা নিয়ে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ। স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী পালনের বছরে এই সুপারিশ জাতিকে উচ্ছ্বসিত করেছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে এই প্রাপ্তি বিরাট অর্জন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মুজিববর্ষ উদ্যাপন। গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত মুজিববর্ষ ঘোষণা করা হলেও পরবর্তী সময় ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে এই বর্ষের।
এই ৫০ বছর পেরিয়ে এসে সবাই পেছনে ফিরে দেখছে। সবার মনেই প্রশ্ন, যেমন বাংলাদেশ আমরা চেয়েছিলাম, সেই বাংলাদেশ কি আমরা পেয়েছি?
মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পরেও আমরা জাতিগত জীবনে যা অর্জন করতে পারিনি, জাতি হিসেবে আমাদের যা স্খলন, তার উত্তরণ ঘটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে সমাজে, রাষ্ট্রে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এই সুবর্ণজয়ন্তীতে নতুন করে শপথ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে এবারের অগ্নিঝরা মার্চ।
স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত আন্দোলনের সূচনা হয় একাত্তরের ১ মার্চ। তত্কালীন পাকিস্তানের প্রেডিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এদিন বেতার ভাষণে ৩ মার্চের গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। এ সময় ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) পাকিস্তান বনাম বিশ্ব একাদশের ক্রিকেট খেলা চলছিল। ইয়াহিয়া খানের ঐ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত দর্শক খেলা ছেড়ে বেরিয়ে এসে বিক্ষোভে যোগ দেয়। ততক্ষণে হাজার হাজার মানুষ পল্টন-গুলিস্তানে বিক্ষোভ শুরু করে দিয়েছে। সেই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপ নেয়। সেদিন মতিঝিল-দিলকুশা এলাকার পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা সেখানে গিয়ে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ইত্যাদি স্লোগানে মুখর করে তোলে গোটা এলাকা। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ঢাকাসহ সারা দেশের স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, কলকারখানা কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। অচল হয়ে পড়ে দেশ। স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলন দিনে দিনে তীব্র হয়ে ওঠে। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। বাঙালি যখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার জন্য ক্ষণ গুনছিল, তখন সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান আকস্মিকভাবে এদিন ৩ মার্চের নির্ধারিত অধিবেশন স্থগিত করেন। সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে ওঠে বাংলাদেশ। বিক্ষোভে উত্তাল হয় রাজপথ। ১ মার্চ দুপুর থেকেই পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সর্বাত্মক অসহযোগ শুরু হয়।
তখন সারা দেশের মানুষ আশা-নিরাশা এবং আশঙ্কা ও সম্ভাবনার দোলাচলে দুলছিল। সচেতন তরুণেরা মনে মনে তৈরি হচ্ছিল কঠিন সংগ্রামের সংকল্প গ্রহণে। মানুষের মনে যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২ ও ৩ মার্চ তত্কালীন পাকিস্তানে সর্বাত্মক হরতাল পালনের ঘোষণা দেন এবং ৭ মার্চ তত্কালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভার ঘোষণা দেন। সেই শুরু। একে একে পেরিয়ে আসে বিক্ষুব্ধ ২৫টি দিন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর আক্রমণ চালায়; শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। এরই পথ ধরে ৯ মাসে আমরা পাই একটি স্বাধীন দেশ—বাংলাদেশ।