এখন গ্রামে ব্যাংকিং করা লাভজনক
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মনজুর হোসেনকে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয়া হয় গত এপ্রিলে। এর মাসখানেক আগে তিনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে অবসর নেন। চাকরি জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র, পরিকল্পনা এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। সম্প্রতি রূপালী ব্যাংক নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।
লোকসানি প্রতিষ্ঠান থেকে লাভজনক- রূপালী ব্যাংকের এ পক্ষে এটা কিভাবে সম্ভব হলো?
মনজুর হোসেন: ২০০৯ এর আগে ব্যাংকটির অবস্থা খুব খারাপ ছিল। ওই বছরের মাঝামাঝির পর থেকে ব্যাংকের অবস্থা ভালো হওয়া শুরু হয়। ২০০৮ সালে নির্বাচনে জেতার পর সরকার বিভিন্ন পর্যায়ে যে রিফর্ম করা শুরু করল তারই ধারাবাহিকতায় এখানেও কিছু পরিবর্তন হয়েছিল, এই সহায়তার ফলে ব্যাংকটিতে অনেক পরিবর্তন আসে। আগের থেকে অবস্থার অনেক উন্নতি ঘটে। যে সময়ের কথা বলছি তখন কয়েকটি ব্যাংকে বিভিন্ন অনিয়মের কথা শোনা গেলেও রূপালী ব্যাংকে কিন্তু এ ধরনের কিছু ঘটেনি। এর ফলে ব্যাংকটি যেমন ঘুরে দাঁড়িয়েছে, তেমনি ব্যাংকের অবস্থার অবনতি ঘটে এমন কিছু থেকে সামাল দিতে সক্ষম হয়েছিল। এ জন্য সে সময়ের পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই ধন্যবাদ দিতে হবে। এবং এজন্য ব্যাংক এখনো ভালোভাবে চলছে।
এ ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদ কি ভূমিকা রাখছে?
মনজুর হোসেন: বোর্ডের দায়িত্ব হিসেবে আমরা সবচয়ে বেশি প্রাধান্য দিই ডিপোজিটরদের স্বার্থ রক্ষাকে। তবে ব্যাংক যে শুধু টাকা নেবে বা জমা রাখবে তা না। এর বাইরে টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনীতি যাতে সামনের দিকে এগিয়ে যায় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয়। এজন্য আমরা চেষ্টা করি যাতে এমন কোনো সমস্যা না হয় যা অন্য সমস্যা ডেকে আনবে। এর বাইরে মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মতো নতুন ধারণা বাস্তবায়ন করতেও আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। এছাড়া বৈধ পথে রেমিট্যান্স আসার মতো বিষয়গুলোও আমরা নিশ্চিতের চেষ্টা করছি। এজন্য কানাডায় আমরা কাজ করেছি। এখন মালয়েশিয়া, ইতালি ও সিঙ্গাপুরে করার চেষ্টা করছি।
কোন কোন বিষয়গুলোকে রূপালী ব্যাংক এখন অগ্রাধিকার দিচ্ছে?
মনজুর হোসেন: অর্থনীতির অগ্রসরমানতার জন্য বড়-ছোট দুটি খাতই জরুরী। এজন্য শিল্পের পাশাপাশি কৃষি-এসএমই মতো খাতে জোর দিচ্ছি। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে এখন গ্রামে ব্যাংকিং করাটা কিন্তু লাভজনক। এর কারণ হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতিতেও পরিবর্তন আসা শুরু করেছে। এজন্য আমরা এতে আরও বেশি জোর দিচ্ছি। তবে ঝুঁকি যে নেই তা নয়। অনেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দেয় না বা দিতে পারে না। সে বিষয়গুলো আমরা কড়া নজরদারিতে রাখছি।
মাকের্টে বিকাশের ব্র্যান্ডের একচেটিয়া দখল থাকার পরেও কি মোবাইল ব্যাংকিংয়ে রূপালী কোন সম্ভাবনা দেখছে?
মনজুর হোসেন: ইনিশিয়েটিভটা ব্র্যাক প্রথম নিয়েছে এটা সত্য, তবে এখানে চাহিদা অনেক বেশি এবং সম্ভাবনা ফুরিয়ে যায়নি। যদি ভালো সেবা দেয়া যায় এবং গ্রাহকদের এটা বুঝিয়ে দেয়া যায় সেক্ষেত্রে কোনো সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যাবে না। ইন্টারনেটের এ যুগে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বার্থে নতুন নতুন পণ্য বাজারে ছাড়ার সম্ভাবনাও প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
সরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে এ ধরনের নজিরও কম। আর গ্রাহক সংকট হবে কি না-
মনজুর হোসেন: গ্রাহক ঠিকই আছে। আসলে আমাদের দরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া। এটি করতে পারলে যে কোনো সরকারই ব্যাংকই ভালো করতে পারবে। খারাপ সম্ভাবনাও কিন্তু আছে এবং থাকবে। তবে এটা নির্ভর করছে আমরা কিভাবে ব্যবহার করছি তার ওপর। এ ব্যাপারে সর্তক থাকাটাই আগে জরুরী। যেমন প্রযুক্তির ভালো-খারাপ দুটিই আছে। এটার ভালো দিকটাকে কাজে লাগিয়ে খারাপ দিকটি সম্পর্কে সজাগ থাকলেই হলো।
সব মিলিয়ে এটা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। এর সম্ভাব্য সবগুলো দিক আমরা খতিয়ে দেখছি, আপাতত বলতে পারি আমরা ফেলে দিচ্ছি না।
অটোমেশনে ব্যাংকের অগ্রগতি কতটুকু?
মনজুর হোসেন: পুরা ব্যাংককে নেটওয়ার্কের আওতায় আনার কাজ এখন চলছে। এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে চাপ যেমন আছে, তেমনি বাংলাদেশ ব্যাংকেরও নির্দেশনা আছে। আমরা এসব বাস্তবায়নের কাজ করছি। প্রাইভেট ব্যাংকের শাখা কম এবং তা শহর বা মফস্বল এলাকাতে। তবে আমাদের শাখা দুর্গম থেকে দুর্গম এলাকায় বিস্তৃত। এজন্য আমাদের জন্য এ কাজ একটু কঠিন বলা চলে। তুলনামূলকভাবে হয়তো আমরা পিছিয়ে আছি কিন্তু প্রকৃত বিচারে আমরা এগিয়ে চলেছি। এটা হয়ে যাবে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে যদি আমরা আরও ভালো কর্মী নিয়োগ দিতে পারি কাজ দ্রুত এগিয়ে যাবে। এটা সত্য যে প্রাইভেট ব্যাংকে বেতন বেশি, তবে চাকরির নিশ্চয়তা সরকারিতেই বেশি। কিন্তু এখানে এসে অনেকে বিসিএসের মতো জব পেলে চলে যায়। এসব সমস্যার মাঝেও আমরা ব্যাংকিং সেক্টরে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিতের মতো পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। এটা করতে পারলে ব্যাংকিংয়ের যে ঝুঁকি সেটাও যেমন কমবে তেমনি আমার যে কোনো সমস্যা সহজেই মোকাবেলা করতে পারবো।
নারীদের উদ্যোক্তাদের ব্যাপারে আপনাদের অবস্থান-
মনজুর হোসেন: নারীদেরকে তো আমাদের সাপোর্ট দিতেই হবে। এটা যত বেশি হয় তত ভালো। তাদের সংখ্যাটাই মূল সমস্যা। যত বেশি নারী উদ্যোক্তা আসবে অর্থনীতি এগিয়ে যাবে।
ব্যাংকের ভবিষ্যত সর্ম্পকে আপনার মূল্যয়ন-
মনজুর হোসেন: আমরা কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করি। তবে আমরা কৃষি থেকে শুরু করে সব সেক্টরে জোর দিচ্ছি। সরকার ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে তা অর্জন করতে পারলে আমাদের সম্পৃক্ততাও বাড়বে। বাসেল-৩ বাস্তবায়ন করা যায় ২-৩ বছরের মধ্যে ব্যাংক আরও ভালো অবস্থানে যাবে।
ঢাকাটাইমস: এতে মুনাফা বাড়ানোর সুযোগ আছে কিনা?
মনজুর হোসেন: বাড়ানোর সুযোগ নাই বলবো না, আছে। তবে আমাদের জন্য এখন বিভিন্ন সীমা নির্ধারণ করে দেয়া আছে। এর কিছু সমস্যাও আছে। এর ভালো দিক হলো সর্তক থাকা। হয়তো এজন্য কম লাভ হচ্ছে কিন্তু আমি মনে করি আমরা ভালো করছি।
দীঘ কর্মজীবনে সরকারের বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন, তবে কখনো ব্যাংকে নয়। এখন দায়িত্ব পালনে কোনো সমস্যার মুখে পড়ছেন-
মনজুর হোসেন: আমি বা আমরা মূলত ব্যবস্থাপনা অংশ দেখি। এতে ছোটখাট বিষয়গুলো হয়তো নজর দিতে পারি না। ব্যাংক কোনদিকে যাচ্ছে বা কোনদিকে যেতে চাই সেটা আমরা ঠিক করি। আধুনিক সময়ে একক জ্ঞান দিয়ে কিছু করা যায় না। সরকারের নীতি থেকে শুরু করে রাজনীতির অবস্থা সর্ম্পকে ধারণা থাকতে হয়। সে দিক দিয়ে সব কাজই মিলেমিশে করি। তাই আমাদের কোন সমস্যা হয়না।
আপনাকে ধন্যবাদ।
মনজুর হোসেন: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ।