কর ফাঁকিতে ২ লাখ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারিয়েছে বাংলাদেশ

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, কর ফাঁকির কারণে ২০২৩ সালে প্রায় ২ লাখ ২৬ হাজার ২৩৬ কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই করপোরেট খাতে, যার পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার ১১৮ কোটি টাকা।
সিপিডির গবেষণা বলছে, মূলত ২০১১ সাল থেকে দেশে কর ফাঁকির ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে শুরু করে। ২০১২ সালে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৯৬ হাজার ৫০৩ কোটি টাকা এবং ২০১৫ সালে তা বেড়ে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকায় পৌঁছে যায়। বাংলাদেশে মোট কর ফাঁকির পরিমাণ ৪১৮ বিলিয়ন থেকে ২ হাজার ২৩০ বিলিয়ন টাকা পর্যন্ত হতে পারে। দেশের ২ লাখ ৮৮ হাজার নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কর দিয়েছে ২৪ হাজার ৩৮১টি প্রতিষ্ঠান, যা মোট নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের মাত্র ৯ শতাংশ। বাকি ৯১ শতাংশ প্রতিষ্ঠানের কর প্রদানের তথ্য পাওয়া যায়নি।
সিপিডি কার্যালয়ে গতকাল ‘করপোরেট ইনকাম ট্যাক্স রিফর্ম ফর গ্র্যাজুয়েটিং বাংলাদেশ: দ্য জাস্টিস পারস্পেকটিভ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
সিপিডি ও খ্রিস্টান এইড যৌথভাবে ঢাকা-চট্টগ্রামের নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত মোট ১২৩টি প্রতিষ্ঠানের ওপর এ গবেষণা পরিচালনা করেছে। পাশাপাশি ব্যাংক, সিরামিক, আইটি, জ্বালানি, ফার্মাসিউটিক্যাল, তৈরি পোশাক, প্লাস্টিক, চামড়া ও ইঞ্জিনিয়ারিং খাতের ব্যবসায়ীদের মতামতও নেয়া হয়েছে। গবেষণায় এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন-পরবর্তী সময়ে কর আদায় ও করপোরেট খাতের কর ১৫ শতাংশ করাসহ নানা সুপারিশ করেছেন গবেষকরা।
সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী তামিম আহমেদ। তিনি বলেন, ‘২০২৫ সালের নভেম্বর নাগাদ বাংলাদেশ এলডিসি গ্র্যাজুয়েট হতে যাচ্ছে। কিন্তু পরবর্তী ট্রানজেকশন সহজ করার জন্য রাজস্ব আদায় সহজ করতে হবে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বৈশ্বিক অবস্থার মতো বাংলাদেশেও করপোরেট কর কমতির দিকে। তাই শুধু রাজস্ব আদায় করলে হবে না, পাশাপাশি কর ন্যায্যতা দেখতে হবে।’
সিপিডির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মাত্র ৯ শতাংশ নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান করপোরেট কর প্রদান করে। বাকি ৯১ শতাংশ কর দিচ্ছে না। অথচ দেশের ২ লাখ ৮৮ হাজার প্রতিষ্ঠান সরকারিভাবে নিবন্ধিত। এ প্রসঙ্গে তামিম আহমেদ বলেন, ‘এটা একটা বড় বৈষম্য, যারা কর দিচ্ছেন তাদের ওপর করের বোঝা বাড়ছে। এটি ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে ৫৯ শতাংশ করা যেতে পারে। এটা করতে পারলে ২০২৯ সালে যখন শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা বন্ধ হবে, তখন এ বর্ধিতসংখ্যক ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে।’
যেসব প্রতিষ্ঠান কর দিচ্ছে না তাদের চিহ্নিত করে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার কথা বলেছে সিপিডি। একই সঙ্গে কর না দেয়ার কারণ হিসেবে চারটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হলো উচ্চ করহার, জটিল আইন-কানুন, দুর্বল প্রশাসনিক নজরদারি ও কর ব্যবস্থায় দুর্নীতি। এসব বন্ধ করার জন্য করপোরেট খাতে কর বাড়ার পাশাপাশি ন্যায্যতার ভিত্তিতে কর আদায়, রাজস্ব ব্যবস্থায় প্রণোদনা দেয়া বন্ধ করা ও কর আদায় ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজ করার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।
বাংলাদেশে করপোরেট কর মাত্র ৬ শতাংশ। এটি ১০-১২ শতাংশ হলেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে মনে করে সিপিডি। এ প্রসঙ্গে তামিম আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশে করপোরেট কর জিডিপির ৬ শতাংশ হলেও উন্নত দেশগুলোয় এ হার ১৫ শতাংশ। এটা কোনোভাবে ১৫ শতাংশের নিচে হতে পারে না। তবে আমাদের লক্ষ্য থাকা উচিত করপোরেট করকে নামিয়ে আনা। তাহলে করপোরেট কর যে ৩১-৩৩ শতাংশের মধ্যে আছে, সেটা ২৩ শতাংশে নামিয়ে এনেও লক্ষ্যপূরণ করা সম্ভব। এর মাধ্যমে পাঁচ বছরে সাড়ে ২৪ বিলিয়ন ডলার আদায় করা সম্ভব।’
গবেষণা প্রতিবেদনে এনবিআরের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের মতপার্থক্যের বিষয় তুলে ধরে বলা হয়েছে, ব্যবসায়ীদের মধ্যে যারা কর রিটার্ন দিতে চান তাদের মোট করের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি ব্যয় করতে হয় কাগজপত্র তৈরি ও অন্যান্য খরচ হিসেবে। এসব কাজ শেষ করতে গড়ে ৯৩ দিন সময় লাগে। এ কারণে অনেকে রিটার্ন দিতে উৎসাহিত হন না, তাই এটিকে সহজ করতে হবে। এছাড়া এনবিআরে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হতে হয় অনেক করদাতাকে।
গবেষণার তথ্যদাতাদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ করদাতা জানিয়েছেন কর প্রদান করতে গিয়ে রাজস্ব বোর্ডে ঘুস দিতে হয়েছে। এসব জটিলতা নিরসনে কর রিটার্নকে ডিজিটালাইজড করার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম কর আদায়ে ন্যায্যতার বিষয়টিতে সরকারকে গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আগামীতে দেশকে এগিয়ে নিতে অভ্যন্তরীণ আয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে কীভাবে রাজস্ব আহরণ বাড়ানো যায়। বর্তমানে দেশে ২০ শতাংশ কর আসে করপোরেট খাত থেকে। ৪০ শতাংশ আসে মূল্য সংযোজন কর থেকে। এ দুই উৎস থেকে প্রায় ৬০ ভাগ রাজস্ব প্রতি বছর আসছে।’ এজন্য করপোরেট কর বাড়াতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শুধু কর ফাঁকি নয়, অযৌক্তিক প্রণোদনা ও কর ছাড়ের কারণেও সরকার প্রতি বছর বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে বলে মনে করেন ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ‘বিনিয়োগের নামে খাতভিত্তিক কর ছাড় দেয়া হচ্ছে, যা পুরোপুরি রাজনৈতিক বিবেচনায় করা হয়। এ ধরনের প্রণোদনা কাঠামো থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।’
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন খ্রিস্টান এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর নুসরাত জাবিন, গবেষক মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন, তাসনিও নূর পিংকী ও ইখতেখারুল ইসলাম প্রমুখ।