নেইমারদের কান্নার রাতে সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনা
পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলকে টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে হারিয়ে কাতার বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠেছে গতবারের রানার্সআপ ক্রোয়েশিয়া। গতকাল আল রাইয়ানের এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে নির্ধারিত ৯০ মিনিট গোলশূন্য থাকার পর অতিরিক্ত সময়ে লড়াই ১-১ গোলে অমীমাংসিত থাকে। এরপর পেনাল্টি শুটআউটে জয় তুলে নেয় বলকান দলটি। এ নিয়ে টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে হারল সেলেসাওরা। নেইমারদের কান্নার রাতে আরেক কোয়ার্টার ফাইনালে নেদারল্যান্ডসকে টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে হারিয়ে সেমিফাইনালে উঠেছে আর্জেন্টিনা। এই ম্যাচটি নির্ধারিত ৯০ মিনিট ও অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের লড়াই শেষে ২-২ গোলে অমীমাংসিত ছিল।
বিদায়ী আসরে সৌরভ ছড়িয়েই চলেছেন বিশ্ব ফুটবলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসি। গতকাল লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে তার জাদুকরী পারফরম্যান্সে ভর করে ডাচদের বিপক্ষে ২-০ গোলের লিড নেয় দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা। ম্যাচের ৩৫ মিনিটে তার অনবদ্য এক পাসে গোল করে আর্জেন্টিনাকে লিড এনে দেন নাহুয়েল মলিনা। মেসির মেধার স্ফুরণ শেষে দুর্দান্ত ফিনিশিংয়ে গোল করেন মলিনা। এটা তার প্রথম আন্তর্জাতিক গোল।
প্রথমার্ধে লিড নিয়ে মাঠ ছাড়া আর্জেন্টিনা দ্বিতীয়ার্ধেও আত্মবিশ্বাসী ছিল। ৬৩ মিনিটে মেসির বুলেট গতির ফ্রি কিক অল্পের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। অবশ্য এর ১০ মিনিট পরই লক্ষ্যভেদ করেন তিনি। পেনাল্টি থেকে গোল করে ব্যবধান ২-০ করেন ৩৫ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড। প্রচণ্ড চাপের মুখে থাকলেও তিনি ঠাণ্ডা মাথায় ডাচ গোলকিপারকে পরাস্ত করেন। এটা চলতি আসরে তার চতুর্থ গোল।
তবে ৮৩ মিনিটে বদলি খেলোয়াড় ভাউট ভেগহর্স্ট শক্তিশালী হেডে গোল করে ব্যবধান কমান (১-২)। শেষ দিকে প্রচণ্ড চাপ তৈরি করে ডাচ শিবির। ১০ মিনিটের ইনজুরি টাইমেও ছিল চরম উত্তেজনা। তখন আর্জেন্টিনা লিড ধরে রাখার ও ডাচরা সমতায় ফেরার প্রাণান্ত চেষ্টা করে। আর্জেন্টাইনদের হূদয় ভেঙে যোগ করা সময়ের শেষ মিনিটে গোল করে বসেন সেই ভেগহর্স্ট। ফ্রি কিকে স্টিভেন বেরগুইস মত পাল্টে নিচু শট দেন, তখন জটলার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা ভেগহর্স্ট স্নায়ু শক্ত রেখে নিচু শটে আর্জেন্টিনার গোলকিপারকে পরাস্ত করে বলকে জালে পাঠিয়েছেন (২-২)। অতিরিক্ত সময়ের খেলায় কোনো দল গোল পায়নি।
টাইব্রেকারে প্রথম দুই শট মিস করে ডাচরা। যদিও পরে টানা তিন শটে গোল করে তারা টিকে থাকে। লাউতারো মার্টিনেজ শেষ শটে গোল করে আর্জেন্টিনার জয় নিশ্চিত করেন। টাইব্রেকারের এ রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তা শেষে জয় পান মেসিরা। আগামী মঙ্গলবার লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে কাতার বিশ্বকাপের প্রথম সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার মুখোমুখি হবে আর্জেন্টিনা।
এর আগে ব্রাজিলের রদ্রিগো ও মার্কিনোস পেনাল্টি স্পট থেকে গোল করতে ব্যর্থ হন। অন্যদিকে, ক্রোয়াটরা চারটি শট নিয়ে সবগুলোতেই গোল করতে সমর্থ হয়। সতীর্থদের ব্যর্থতায় নেইমার পঞ্চম শটটি নেয়ার সুযোগই পেলেন না! মার্কিনোসের শটটি বারে লেগে ফিরে এলেই গোলকিপারের দিকে দৌড় শুরু করেন লুকা মডরিচ, পেরিসিচরা। শুরু হয় গোলকিপার ডমিনিক লিভাকোভিচকে ঘিরে তাদের আনন্দ, উদযাপন। এক পাশে চলছিল অন্তহীন আনন্দ, আর অন্য প্রাপ্তে তখন শোকের মাতম।
বড় আসরে টাইব্রেকারে বরাবরই নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়ে এসেছে ক্রোয়েশিয়া। পাঁচটি টাইব্রেকারের মধ্যে চারটিই জিতল তারা। ২০০৮ সালে ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনালে হারের পর বিশ্বকাপে চারটি টাইব্রেকারেই জয়লাভ করল ক্রোয়াটরা। এর মধ্যে দুটিই চলতি আসরে। আগের ম্যাচে তারা টাইব্রেকারে হারিয়েছে জাপানকে। ২০১৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠার পথে ১২ গজ দূর থেকে নেয়া শটের লড়াইয়ে তারা মাথা ঠাণ্ডা রেখে হারায় ডেনমার্ক ও স্বাগতিক রাশিয়াকে। এই চারটির মধ্যে দুটি শুটআউটের হিরো লিভাকোভিচ, যিনি জাপান ম্যাচেরও নায়ক।
এর আগে সুপারস্টার নেইমারের গোলে লিড নিয়ে কাতার বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওঠার স্বপ্ন জাগায় ব্রাজিল। ৯০ মিনিটের পর অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধও হতাশায় কাটে ব্রাজিলীয়দের। এ সময় তাদের একের পর এক গোল প্রচেষ্টা রুখে দিতে থাকে ক্রোয়েশিয়ার গোলকিপার লিভাকোভিচ। অবশেষে ডেডলক ভাঙেন নেইমার।
কাল পুরো ম্যাচে সমর্থক ও দলকে হতাশ করছিলেন নেইমার, কিছুতেই ক্রোয়াট ডিফেন্সকে চির ধরাতে পারছিলেন না। অবশেষে তিনি সফল হন ১০৬ মিনিটে। অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধ শেষের বাঁশি বাজার অপেক্ষায় ছিলেন সবাই, তখনই নেইমার ম্যাজিক। বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়টি প্যাকেতার পাসে বল পেয়ে প্রায় একক প্রচেষ্টায় ক্রোয়াট ডিফেন্স ভেঙে বক্সের মধ্যে ঢুকে পড়ে অত্যন্ত কাছ থেকে নেয়া শটে গোল করেন। প্যাকেতাকে পাস দেয়া ও ফিরতি পাস পেয়ে যেভাবে বক্সের মধ্যে আক্রমণে যান নেইমার, তা থেকেই অনুমান করে নেয়া যায়, জিততে কতটা মরিয়া ছিলেন তিনি। এই গোলে অনেক সমালোচনারও জবাব দেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলারটি।
এই গোলের মধ্য দিয়ে পেলের ৭৭ গোলের রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেন নেইমার। দুজনেরই ব্রাজিলের জার্সিতে এখন ৭৭ গোল। তবে কিংবদন্তি গোলের রেকর্ড ছোঁয়ার দিনটি বিষাদেই কাটল নেইমারের। ব্রাজিলের হারে বিফলেই যায় তার সুন্দরতম গোল। পেলে তিনবার বিশ্বকাপ জিতলেও নেইমারের শোকেসে একটিও হলো না। শেষ চেষ্টায়ও তিনি ব্যর্থ হলেন।
১১৬ মিনিটে নেইমার ও ব্রাজিলীয়দের হূদয় ভেঙে গোল করে বসেন পেতকোভিচ। গতকাল ম্যাচে প্রথমবারের মতো অন টার্গেটে শট নিয়েই গোল পায় ক্রোয়েশিয়া। তার বুলেট গতির শট ব্রাজিলের এক ডিফেন্ডারের পায়ে লেগে দিক পাল্টে গেলে অ্যালিসন বিভ্রান্ত হন এবং বল জালে জড়িয়ে যায় (১-১)। ক্রোয়াট সমর্থকরা গর্জে ওঠে, আর ব্রাজিলের সমর্থকরা যেন স্তব্ধ হয়ে যায়।
১২১ মিনিটে আবার সেই লিভাকোভিচের সেভ! ক্যাসেমিরোর শট সেভ করে তিনি শেষ মুহূর্তে বাঁচান ক্রোয়াটকে। কাল সব মিলিয়ে ১১টি সেভ করেন তিনি।
প্রথমার্ধে ব্রাজিলের নিষ্প্রভতায় আলো ছড়ান ক্রোয়েশিয়ার মিডফিল্ডার ত্রয়ী ম্যাতেও কোভাচিচ, মার্সেলো ব্রোজোভিচ ও লুকা মডরিচ। তারা ১০২টি পাসের মধ্যে ৯০টি সম্পন্ন করেন, ট্যাকেল করেন সাতটি, আর বল পুনরুদ্ধার করেন ১১ বার। প্রথমার্ধে মধ্যমাঠের লড়াইয়ে তারাই বিজয়ী। এ সময় ডিফেন্সেও নিখুঁত খেলেছে ক্রোয়েশিয়া। সব মিলিয়ে দারুণ খেলেছে ক্রোয়াটরা। এ সময় তারা সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল ও অদম্য ফুটবল খেলেছে।
ম্যাচের ১৩ মিনিটে দারুণ সুযোগ মিস করে ক্রোয়েশিয়া। ডান প্রান্ত দিয়ে জসিপ জুরানোভিচের পাঠানো বল ধরে নিচু ক্রস দিয়েছিলেন মারিও পাসালিচ, যদিও তাকে সংযোগ ঘটাতে ব্যর্থ হন স্ট্রাইকার ইভান পেরিসিচ। ২১ মিনিটে বাম প্রান্ত দিয়ে রিচার্লিসনের সঙ্গে ওয়ান-টু-ওয়ান খেলার পর ভিনি যে শট নেন তা সরাসরি চলে যায় গার্ডিওলের কাছে। এর কিছুক্ষণ পর নেইমারের দুর্বল শট আশ্রয় নেয় ক্রোয়াট কিপারের গ্লাভসে।
৪৮ মিনিটে সংঘবদ্ধ আক্রমণে গেলেও গোল করতে পারেনি ব্রাজিল। এ সময় ভিনিসিয়ুস, নেইমারদের হতাশ করেন ক্রোয়াট গোলকিপার ডমিনিক লিভাকোভিচ ও ডিফেন্ডার জসকো গার্ডিওল।
এরপর ধীরে ধীরে আক্রমণের ধার বাড়ায় ব্রাজিল, গোলের সুযোগও তৈরি হতে থাকে। ৭৪ মিনিটে রিচার্লিসন দারুণ সুযোগ মিস করেন। তার আগে নেইমারও গোল মিস করেন। তার শট পা দিয়ে সেভ করেন লিভাকোভিচ।
৮২ মিনিটে লুকাস প্যাকেতার বাড়ানো বলে পেনাল্টি বক্সের মধ্যে হেড নিলেও গোলে রূপ দিতে পারেননি রিচার্লিসন। দুই মিনিট পর আক্রমণের ধার বাড়াতে তাকে উঠিয়ে পেদ্রোকে নামান তিতে। শেষ দিকে নেইমারের সঙ্গে রদ্রিগো আর পেদ্রো ক্রোয়াট গোলমুখে আক্রমণে যান, তবে তাদেরও হতাশ হতে হয় লিভাকোভিচ নামক দেয়ালে। ফলে ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে।
এর আগে বিশ্বকাপে দুবার মুখোমুখি হয়ে দুবারই ব্রাজিলের কাছে হেরেছে ক্রোয়েশিয়া। ২০১৪ সালে ঘরের মাঠে ৩-১ গোলের জয় তুলে নেয় সেলেসাওরা। তার আগে ২০০৬ সালে ব্রাজিল জিতেছিল ১-০ গোলে। বিশ্বকাপে তৃতীয় মোকাবেলায় জয় পেল ক্রোয়েশিয়া।