জমজমাট স্নায়ুক্ষয়ী ফাইনালে মেসির হাতে বিশ্বকাপ
পঞ্চমবারের চেষ্টায় অবশেষে বিশ্বকাপ শিরোপার স্বাদ পেলেন ফুটবলের মহারাজা লিওনেল মেসি। আর্জেন্টিনা পেল বিশ্বকাপের তৃতীয় মুকুট। গতকাল কাতারের লুসাইল আইকনিক স্টেডিয়ামে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স ও দুবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার মধ্যকার শিরোপার ম্যাচে জমজমাট লড়াই হয়। নির্ধারিত ৯০ মিনিট ও অতিরিক্ত ৩০ মিনিটেও আলাদা করা যায়নি বিশ্বের অন্যতম সেরা দুটি দলকে। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলানো এ দ্বৈরথ সব নাটকীয়তাকেই যেন হার মানায়। অবশেষে টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে ফ্রান্সকে হারিয়ে তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আর্জেন্টিনা। মেসিদের এ রোমাঞ্চকর জয়ে বিফলেই যায় ফরাসি সুপারস্টার কিলিয়ান এমবাপ্পের অনবদ্য এক হ্যাটট্রিক।
এটি ছিল দুই মহাতারকা মেসি ও এমবাপ্পের শ্রেষ্ঠত্বেরও লড়াই। দুজন দুই দেশের সেরা খেলোয়াড়। দেশকে শিরোপা এনে দেয়ার দায় এ দুজনেরই কাঁধে। ফাইনালে এ দুজনই থাকলেন লড়াইয়ের কেন্দ্রে। লড়াইয়ের মঞ্চে কখনো কর্তৃত্ব ছিল মেসির, কখনো বা তা কেড়ে নেন এমবাপ্পে। মেসি ও ডি মারিয়ার গোলে আর্জেন্টিনা ২-০ গোলে লিড নেয়ার পর এমবাপ্পে ২ মিনিটের ব্যবধানে দুই গোল করে সমতা আনেন। এ যেন স্বর্গ থেকে পতন আর্জেন্টিনার। আকস্মিক দুই গোল খেয়ে মানসিকভাবেও ভেঙে পড়ে আর্জেন্টাইনরা। তখন মনে হচ্ছিল ফুটবলের জাদুকর মেসির শিরোপা স্বপ্নটা বুঝি অপূর্ণই থাকবে।
কিন্তু ২০১৪ সালের পর আরেকবার তীরে এসে তরী ডোবার পরিস্থিতি হলে দলকে টানার দায়িত্বটা কাঁধে নিলেন আর্জেন্টিনার অধিনায়ক নিজেই। ১০৮ মিনিটে তার গোলে আবার লিড নেয় আর্জেন্টিনা। কিন্তু নাটক যে তখনো শেষ হয়নি। ১০ মিনিট পর ফের পেনাল্টিতে গোল করে সমতা আনেন এমবাপ্পে (৩-৩)।
এরপর টাইব্রেকারে এমবাপ্পে, লরিসদের কাঁদিয়ে জয়লাভ করে আর্জেন্টিনা। পেনাল্টি ও টাইব্রেকার মিলিয়ে এমবাপ্পের তিন-তিনটি শট সেভ করতে ব্যর্থ হলেও টাইব্রেকারের নায়ক আর্জেন্টিনার গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। ফ্রান্সের কিংসলে কোমানের শট সেভ করেন তিনি। এরপর অরেলিয়েঁ চুয়ামেনিও নিশানা ভেদ করতে ব্যর্থ হন।
বিশ্বকাপে টাইব্রেকারে সবচেয়ে বেশি জয় আর্জেন্টিনার। গতকাল তারা তুলে নেয় ষষ্ঠ জয়। আর ফাইনালে তৃতীয় দল হিসেবে টাইব্রেকারে জয় পেল আর্জেন্টিনা। বাকি দুটি দল ব্রাজিল (১৯৯৪) ও ইতালি (২০০৬)।
এর মধ্য দিয়ে মাত্র দ্বিতীয় দল হিসেবে প্রথম ম্যাচে হেরেও শেষ পর্যন্ত শিরোপা জিতল আর্জেন্টিনা। ২০১০ সালে স্পেন প্রথম দল হিসেবে এ কীর্তি গড়ে। সেবার গ্রুপের প্রথম ম্যাচেই সুইজারল্যান্ডের কাছে হেরেছিল স্পেন।
আর্জেন্টিনার মতো ফ্রান্সও এবার গ্রুপ পর্বে হেরেছে। তারা ১-০ গোলে তিউনিসিয়ার কাছে হেরে যায়। ফলে দ্বিতীয়বারের মতো গ্রুপ পর্বে পরাজিত দুটি দল ফাইনালে মুখোমুখি হয়। ১৯৭৮ সালের ফাইনালে আর্জেন্টিনা মুখোমুখি হয় নেদারল্যান্ডসের। সেবার দুই দলই গ্রুপে হেরেছিল। তার মানে ১৯৭৮ সালের পর আবারো গ্রুপের প্রথম ম্যাচে হেরেও শিরোপা জিতল আর্জেন্টিনা।
২৩ মিনিটে মেসির পেনাল্টি থেকে করা গোলে লিড নেয় আর্জেন্টিনা। চোট কাটিয়ে একাদশে ফেরা অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া এ পেনাল্টি আদায় করেন। ফ্রান্সের বক্সের মধ্যে ওসমান দেম্বেলে তাকে ফেলে দিলে পেনাল্টি পায় আর্জেন্টিনা। স্পট কিক থেকে দুর্দান্ত গোল করেন মেসি। তিনি যেদিকে শট নেন তার উল্টো দিকে ঝাঁপিয়েছেন ফ্রান্স গোলকিপার উগো লরিস।
লুসাইলে শুরু থেকেই আধিপত্য করা আর্জেন্টিনার কর্তৃত্ব সংহত হলো দ্বিতীয় গোলের মধ্য দিয়ে। এ গোলেও ছিল জাদুকর মেসির ছোঁয়া। ৩৬ মিনিটের সময় তিনি ফ্লিক করেন তার ডান দিকে থাকা হুলিয়ান আলভারেজকে। ২২ বছর বয়সী এ স্ট্রাইকার বল দেন অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টারকে, যার নিচু শট পেয়ে যান ডি মারিয়া। চোট কাটিয়ে ফাইনালের একাদশে ফেরা ডি মারিয়া লরিসকে কোনো সুযোগ না দিয়েই বলকে জালে পাঠিয়েছেন।
৬১ মিনিটে আবারো ডি মারিয়ার জাদুতে গোল পেতে যাচ্ছিল আর্জেন্টিনা। বাম প্রান্তে এক খেলোয়াড়কে কাটানোর পর তিনি পাস দেন ডান প্রান্তে থাকা মেসিকে। যদিও আদ্রিয়েন রাবিওর স্লাইডিং ট্যাকলের কারণে গোল করতে পারেননি মেসি।
দুই গোলে এগিয়ে থেকে আর্জেন্টিনা যেন নির্ভার হয়ে পড়ে অনেকটা। তাই দুই গোলের রূপকার ডি মারিয়াকে তুলে নেন কোচ লিওনেল স্ক্যালোনি। তাতে আক্রমণের ধারটা কমে যায়। এ সুযোগে দারুণভাবে খেলায় ফিরে আসে ফ্রান্স। এরপর এমবাপ্পের মুহূর্তের ম্যাজিকে ২ মিনিটের মধ্যে দুই গোল পরিশোধ করে ফেলে ফ্রান্স। ৮০ মিনিটে পেনাল্টি থেকে এবং ৮১ মিনিটে মার্কাস থুরামের পাস থেকে অনবদ্য এক গোল করেন ২৩ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড। থুরামের পাসটি এমবাপ্পের কাছে এসে পড়লে তিনি ভলিতে ছবির মতো সুন্দর এক গোল করেন। এরপর অতিরিক্ত সময়ে আরেকটি গোল করে ফ্রান্সকে সমতায় ফেরানোর পাশাপাশি হ্যাটট্রিক পূর্ণ করেন এমবাপ্পে। ১৯৬৬ সালের পর বিশ্বকাপ ফাইনালে এই প্রথম হ্যাটট্রিক করলেন কেউ।
বিশ্বকাপে এটা ছিল লাতিন ও ইউরোপের মধ্যে ১১তম ফাইনাল। আগের ১০ ফাইনালে লাতিনরা সাতটি জিতে এগিয়ে ছিল। সর্বশেষ দুটি হারের স্বাদ পায় আর্জেন্টিনা (১৯৯০ ও ২০১৪)। এখন লাতিনদের জয় আটটি।
এটা ছিল দুই দলের ১৩তম লড়াই। আগের ১২ লড়াইয়ে আর্জেন্টিনা ছয়টি ও ফ্রান্স তিনটি জয় পায়। বিশ্বকাপে এটা ছিল দুই দলের চতুর্থ লড়াই। আগের তিনবারের মুখোমুখিতে দুবার জয় পায় আর্জেন্টিনা, একবার ফ্রান্স। ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে শেষ ষোলোর ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে ৪-৩ গোলে হারায় ফ্রান্স, যারা পরে চ্যাম্পিয়ন হয়। লুসাইলে গতবারের হারের প্রতিশোধ নিল আর্জেন্টিনা।
১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে আর্জেন্টিনা প্রথমে দুই গোল দিলেও পরে পশ্চিম জার্মানি তা পরিশোধ করে। যদিও শেষ পর্যন্ত ৩-২ গোলের জয় তুলে নিয়েছিল ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনাই। এবার ছিয়াশির পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে শিরোপা জিতলেন মেসিরা। যদিও ম্যারাডোনার দল নির্ধারিত ৯০ মিনিটেই জয় তুলে নিয়েছিল আর মেসিরা নিলেন টাইব্রেকারের সাহায্য।
দুবারের বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনা ৩৬ বছর ধরে বিশ্বকাপ শিরোপার খোঁজে। কিংবদন্তি ম্যারাডোনার জাদুতে ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয় ও সর্বশেষ শিরোপার স্বাদ পায় আর্জেন্টাইনরা। এরপর তিন যুুগের দীর্ঘ খরা। ম্যারাডোনার পর আর্জেন্টিনায় আবির্ভাব ঘটা আরেক মহাতারকা মেসির হাত ধরে ২০১৪ সালে ফাইনালে উঠলেও জার্মানির কাছে পরাজিত হয় আলবিসেলেস্তেরা। আট বছর পর কাতার বিশ্বকাপে এল শিরোপার স্বাদ। এর আগে ১৯৭৮ সালে প্রথম ও ১৯৮৬ সালে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ জয় করে আর্জেন্টিনা।