ঋণের চাহিদা বাড়ছে, বাড়ছে না অর্থায়নের সুযোগ
পাইকারি ও খুচরা বাজারে বাঁশ-বেতের তৈরি পণ্য সরবরাহ করেন রংপুরের পীরগাছার বাসিন্দা আজমল হোসেন। বাজারে এসব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে বলে অনুধাবন করতে পারছেন কয়েক বছর ধরে।
পাইকারি ও খুচরা বাজারে বাঁশ-বেতের তৈরি পণ্য সরবরাহ করেন রংপুরের পীরগাছার বাসিন্দা আজমল হোসেন। বাজারে এসব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে বলে অনুধাবন করতে পারছেন কয়েক বছর ধরে। এর পরও তহবিল সংকটে বর্ধিত চাহিদা পূরণে নিজের সক্ষমতা বৃদ্ধি বা ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ পাচ্ছেন না তিনি। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে চেষ্টা করেও ঋণ পাননি।
আজমল হোসেনের মতো ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের বেশির ভাগই ব্যবসা সম্প্রসারণের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হিসেবে দেখছেন ঋণ ও অর্থায়নের সুযোগ না পাওয়াকে। একই বক্তব্য উঠে এসেছে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায়ও।
ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) ২০১৯ সালের এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল, দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের জোগান না থাকা। এখানে মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে চাহিদার সঙ্গে আর্থিক খাত থেকে ঋণপ্রবাহের ব্যবধান প্রায় ২৮০ কোটি ডলার।
দেশে এসএমই খাতে ঋণ ও চাহিদার মধ্যে ব্যবধান নিয়ে এরপর নির্ভরযোগ্য আর কোনো তথ্য প্রকাশ হয়নি। বর্তমানে এ ব্যবধান আরো বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও বন্যার পরিপ্রেক্ষিতে এসএমই খাতে ঋণের চাহিদা আরো বেড়েছে। যদিও এর বিপরীতে ঋণ বিতরণও কমেছে।
আবার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও তহবিলের অভাবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যাপ্ত মাত্রায় ঋণ দিতে পারছে না। দেশে কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ ও উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন এসএমই ফাউন্ডেশন। সংগঠনটির ১৭০টি ক্লাস্টারে ৬৯ হাজার ৯০২টি কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ক্লাস্টারগুলোর অধীনস্থ এসব প্রতিষ্ঠানের ৭৫ শতাংশ ফাউন্ডেশনের কাছে ঋণ চেয়েছিল। যদিও ঋণের আবেদন জানানো প্রতিষ্ঠানগুলোর মাত্র ৪০ শতাংশকে অর্থায়ন করতে সক্ষম হয়েছে ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদার বিপরীতে এসএমই ফাউন্ডেশনের সরবরাহকৃত তহবিল ঘাটতির পরিমাণ ৯৬০ কোটি টাকার বেশি।
ব্যাংকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্যাংকগুলো থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে ঋণ বিতরণ বাড়ানো হচ্ছে বলে দাবি করা হয়। যদিও প্রকৃতপক্ষে এখনো অনেক ব্যাংকের এ ধরনের ঋণ বিতরণে বেশ অনাগ্রহ রয়েছে। কারণ বেশকিছু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার মধ্যে বিতরণকৃত অল্প অল্প অংকের ঋণে যে ব্যবস্থাপনাগত জটিলতা এবং সময় ও অর্থ ব্যয় হয় সে তুলনায় সমপরিমাণ অর্থ বৃহদায়তনের গুটিকয়েক ঋণগ্রহীতাকে বিতরণ করলে তা ব্যাংকের জন্য বেশি লাভজনক। এ কারণে ব্যাংকগুলোর অনেক কর্মকর্তাই মনে করেন ক্ষুদ্র ঋণের সুদহার বাড়ানো প্রয়োজন।
দেশের বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সিএসএমই খাতে সবচেয়ে বেশি ঋণ বিতরণ করে ব্র্যাক ব্যাংক। ব্যাংকটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এসএমই ব্যাংকিং প্রধান সৈয়দ আবদুল মোমেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন করার মতো মানসিকতা থাকে না। এজন্য ব্যাংকের ইচ্ছা থাকা জরুরি। ব্র্যাংক ব্যাংকের নিজস্ব কিছু পলিসি রয়েছে, যার কারণে তারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে পারে।’
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে শিল্প খাতের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৫ শতাংশই কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (সিএসএমই) খাতে। কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান রয়েছে দেশের দুই কোটির বেশি মানুষের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হলেও খাতটি বিকাশের সবচেয়ে বড় অন্তরায় এখন পর্যাপ্ত মাত্রায় ঋণ ও তহবিলের জোগান দিতে না পারা। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় খাতটিতে ঋণপ্রবাহ কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু ব্যাপ্তি ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষের সংখ্যা বিবেচনায় তা একেবারেই অপ্রতুল।
এর মধ্যেই সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বন্যার প্রভাবে এসএমই খাতে ঋণ বিতরণ আরো কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর এসএমই খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ কমেছে। ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসে (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর) এসএমই খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৪ হাজার ৮৪২ কোটি টাকা। কিন্তু চলতি বছরের এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে এসএমই খাতে ব্যাংকগুলো ৫৪ হাজার ৫২৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। জুন শেষে এসএমই খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণকৃত ঋণ স্থিতি ছিল ৩ লাখ ৬ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। তবে এ ঋণের বড় অংশই গেছে মাঝারি আকারের শিল্প ও সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয়। ছোট ও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকের বিনিয়োগ অনেক কম বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এ সংকটকে আরো প্রকট করে তুলেছে ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট।
আবার একই কারণে কমেছে এসএমই খাতের ঋণ আদায়ও। বর্তমানে এসএমই খাত থেকে ব্যাংকের ঋণ আদায়ও ব্যাপক মাত্রায় কমে গেছে। ঋণ আদায়সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে এসএমই খাত থেকে ব্যাংকে ঋণ আদায় কমেছে ৫০ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এর মধ্যে ছোট ও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ আদায় কমেছে ৮৬ দশমিক ৪১ শতাংশ। মাঝারি আকারের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ঋণ আদায়ও ৮ দশমিক ৫২ শতাংশ কমেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। ঋণ আদায় কমে যাওয়ায় এ খাতে ব্যাংকগুলোর মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ স্থিতিও বেড়েছে।
ব্যাংক ঋণ থেকে বঞ্চিত হওয়ায় দেশের ক্ষুদ্র, কুটির ও কৃষি খাতের উদ্যোক্তাদের এখন ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠান (এমএফআই) বা এনজিওর ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। এর মধ্যে এনজিওগুলো সাধারণত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বেশি সুদে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করে। বর্তমানে এ কার্যক্রমেও ব্যাংক খাতে তারল্য সংকটের বিরূপ প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ব্যাংক খাতেই ঋণের সুদহার এখন ১৫-১৬ শতাংশ পর্যন্ত উঠে যাচ্ছে। এ অবস্থায় মাঝারি ও ছোট ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজনীয় মাত্রায় তহবিল জোগানে ব্যর্থ হচ্ছে এনজিওগুলোও।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি বাংলাদেশের (নাসিব) কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি মির্জা নূরুল গণি শোভন এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের এমএসএমই খাত এখন বেশ কঠিন একটি সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় ঋণ কার্যক্রম শক্তিশালী করতে হবে। উদ্যোক্তাদের কাঁচামাল আমদানিতেও সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমদানিনির্ভর শিল্প-কারখানাগুলো সচল রাখা কঠিন হয়ে উঠছে। এছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান ঋণখেলাপি হয়ে পড়ছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সরকারের উচিত দীর্ঘমেয়াদি কোনো পদক্ষেপ নেয়া। তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে টিকে থাকতে পারবে। আবার সরকারের রিফাইন্যান্সিং স্কিমগুলো সম্পর্কে উদ্যোক্তারা ঠিকঠাকভাবে জানেন না। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোও তাদের জানায় না। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে উদ্যোগ নেয়া হলে আমাদের ঋণ ও তহবিলের জোগান বাড়বে। করোনার পর এসএমই ফাউন্ডেশন ও বিসিক এ খাতে বিতরণের জন্য যথাক্রমে ৩০০ ও ১০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ পেয়েছিল। এসএমই ফাউন্ডেশনকে যদি এ ধরনের বিশেষ তহবিল ছাড়াও অন্য আরো কোনো স্কিম দেয়া হয় তাহলে আরো বেশিসংখ্যক উদ্যোক্তা উপকৃত হবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকেরও উচিত এসএমই ফাউন্ডেশন ও বিসিক এ দুটো দিকে আরো বেশি নজর দেয়া।’