বিদ্যুৎ-জ্বালানি: লোকসান দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে চক্র
গত দেড় দশকে খুচরা-পাইকারি মিলে অন্তত ১৮ বার দাম বেড়েছে বিদ্যুতের। দফায় দফায় বেড়েছে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দামও। তবু বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অধিকাংশ কোম্পানিই বছরের পর বছর ধরে লোকসান গুনছে।
এসব খাতে প্রতি অর্থবছরেই হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সরকারকে। তবে বিস্ময়কর হলেও সত্যি, বছর শেষে লাভ দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোটি কোটি টাকা ভাগ করে নিয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এটি রীতিমতো শুভঙ্করের ফাঁকি।
কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) গণশুনানিতে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম এ বিষয়ে দৃষ্টিপাত করলে তৎকালীন সরকার কোনো গুরুত্বই দেয়নি। উল্টো সরকার একপর্যায়ে গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য সমন্বয় প্রক্রিয়াই বরং বাতিল করে দেয়।
গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এখন থেকে ফের গণশুনানিতেই দাম বাড়ানো হবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান দেখিয়ে গত দেড় দশকে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৪ বার বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। লোকসানের বোঝা এসে পড়েছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে।
এদিকে সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ, পিডিবি ও আরইবির অধীন বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলো প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা মুনাফা দেখাচ্ছে। মুনাফার ৫ শতাংশ ভাগবাটোয়ারা হচ্ছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে। অথচ প্রায় প্রতিটি কোম্পানিতে ভর্তুকি দিয়ে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হচ্ছে সরকারকে।
শুধু বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানিগুলো নয়, গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোও একই কাজ করছে। কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল) ২০২১-২০২২ অর্থবছরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১৮ লাখ টাকা করে বোনাস দিয়েছিল।
২০২২ সালের জুন পর্যন্ত কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড (কাফকো) থেকে আয় করা দুই হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা পেট্রোবাংলাকে দেয়নি কেজিডিসিএল। নিজেদের লাভ দেখিয়ে বছর শেষে বোনাস নিয়ে নেয় তারা।
বিইআরসির নির্দেশনা অনুসারে, বিতরণ চার্জ বাদে, গ্যাস বিক্রির সব আয় পেট্রোবাংলাকে দিতে হবে। কিন্তু ২০১০ সালে কেজিডিসিএল গঠনের পর থেকেই তা করা হয়নি। কর্ণফুলী এই অর্থ আয় করে বহুজাতিক কোম্পানি কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডের (কাফকো) কাছ থেকে; গ্যাস কোম্পানিটি কাফকোর কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত সার কোম্পানিগুলোর জন্য বিইআরসি নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে উচ্চদামে গ্যাস বিক্রি করে। অর্থাৎ নিজেদের লাভের জন্য কোম্পানিগুলো বছর শেষে লাভ দেখাচ্ছে। শুধু তাই নয়, পাঁচ তারকা হোটেলে কয়েক কোটি টাকা ব্যয় করে প্রতিষ্ঠানটি এজিএম করছে। অথচ সরকার এ খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে প্রতিবছর।
এদিকে প্রফিট (মুনাফা) বোনাস পাওয়া কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের দাবি, শ্রমিক আইন অনুযায়ী কোম্পানির বার্ষিক মুনাফার ৫ শতাংশ বোনাস তারা পেয়ে থাকেন। এখানে আইনের ব্যত্যয় হয়নি। কিন্তু ক্রমাগত লোকসানে থাকা বিদ্যুৎ খাতের জন্য এ আইন কতটা প্রযোজ্য, এ নিয়ে প্রশ্ন জেগেছে।
পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৮-২০০৯ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছর পর্যন্ত ১৬ বছরে রাষ্ট্রীয় এই সংস্থাটি লোকসান দেখিয়েছে ২ লাখ ২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এ সময় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে প্রায় ১৮৮ শতাংশ।
আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতা নেয়, তখনও লোকসান অনেক কম ছিল। বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিপরীতে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় লোকসান অনেক বেড়ে গেছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে পিডিবি লোকসান গুনেছিল ৮২৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা। পরের অর্থবছরে ৬৩৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। দশ বছর পর, ২০২০-২১ অর্থবছরে সংস্থাটির লোকসান হয়েছে ১১ হাজার ৬৪৮ কোটি ৬৩ লাখ টাকা।
এরপর হঠাৎ করেই লোকসান অনেক বেড়ে গেছে। ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪- এই তিন অর্থবছরে রেকর্ড এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি লোকসান হয়েছে পিডিবির। লোকসানের কারণে সরকার দেড় দশকে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি দিয়েছে। এর মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে পিডিবি বিভিন্ন বিদ্যুৎ কোম্পানিকে দিয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারি ৫টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানি নিট মুনাফা করেছে ১৫১৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর ৫ শতাংশ প্রফিট বোনাস হিসেবে ওই অর্থবছর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেওয়া হয়েছে ৭৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। বেশি লাভে থাকা কোম্পানির কর্মীরা বেশি মুনাফা পেয়েছেন।
সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগ, পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের অধীনস্থ লাভে থাকা কোম্পানিগুলো হলো- আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি (এপিএসসিএল), ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি (ইজিসিবি), নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (নওপাজেকো), রুরাল পাওয়ার কোম্পানি (আরপিসিএল) ও বি-আর পাওয়ার জেন (বিআরপিএল)। এর আগের তিন অর্থবছরও এই কোম্পানিগুলো লাভে ছিল।