রেকর্ডের পর রেকর্ড ভাঙছে মৃত্যু : সামনে ভয়াবহ মৃত্যুর মিছিল এর আশংকা!
দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে। এ কারণে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। চিকিত্সার অভাবে করোনা রোগীরা মারা যাচ্ছে। রেকর্ডের পর রেকর্ড ভাঙছে মৃত্যু। হাসপাতালে সিট নেই। ধারণক্ষমতার তিন থেকে চার গুণ রোগীর ভিড়। অক্সিজেন নেই। দিনের পর দিন অপেক্ষায় থেকেও মিলছে না আইসিইউ। সব মিলিয়ে করোনার চিকিত্সা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
দেশে করোনায় মৃত্যুর হার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ চিকিৎসা না পাওয়া। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৩৬ জেলায় আইসিইউ নেই। এসব জেলায় কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে চলে আসছে ঢাকায়। আবার যেসব জেলায় আইসিইউ আছে, সেসব জেলায়ও দায়িত্ব না নিয়ে চিকিত্সকরা রোগীকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিচ্ছেন। অনেক রোগী আবার নিজের ইচ্ছায় ঢাকায় চলে আসছে। বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ও সিভিল সার্জনরা জেলা শহরে করোনা রোগীদের চিকিত্সাসেবা নিশ্চিত করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছেন। গত দুই সপ্তাহ ধরে ঢাকায় প্রচণ্ড রোগীর চাপ। অনেকে হাসপাতালে ভর্তি হতে না পেরে রাস্তায় মারা যাচ্ছে। ঢাকায় মৃত্যু ও শনাক্তের হার বেশি। ১০ মাস আগে প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এত দিনেও ৩৬ জেলায় আইসিইউ ইউনিট তৈরি না হওয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগের গাফিলতিকে দায়ী করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, যথেষ্ট সময় পাওয়ার পরও চিকিত্সা ব্যবস্থার সক্ষমতা বাড়ানো হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন হলে চিকিত্সা ব্যবস্থার এই বেহাল অবস্থার সৃষ্টি হতো না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষরাও বলছেন, প্রচণ্ড রোগীর চাপ আমরা আর সামাল দিতে পারছি না।
রাজধানীতে করোনা রোগীদের চিকিত্সাসেবা নিয়োজিত ডাক্তাররা বলেন, সাধ্যের মধ্যে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে চিকিত্সাসেবা দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু হাসপাতালে রোগী রাখার ঠাঁই নেই। চোখের সামনে রোগী বিনা চিকিত্সায় মারা যাচ্ছে। এই দৃশ্য আর সইতে পারছি না। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা যারা বাস্তবায়ন করেননি, তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির প্রস্তাব মানেন না নন-মেডিক্যাল পার্সনরা। ৩৬ জেলায় আইসিইউ এখনো কেন চালু হয়নি। চিকিত্সাসেবা খাতের সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি আরো কয়েকটি মন্ত্রণালয় জড়িত। করোনার এই অবস্থার জন্য শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একা দায়ী নয়। তারাও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণির কর্মকর্তা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে অবহেলা করছেন। কারণ কী? এটা নিয়ে চিকিত্সকদের প্রশ্ন। এটা কী সরকারকে বেকায়দায় ফেলানোর ষড়যন্ত্র? এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নইলে সামনে ভয়াবহ মৃত্যুর মিছিল তৈরি হবে। বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা করোনা নিয়ন্ত্রণে আগামী দুই সপ্তাহ কঠোর লকডাউনের পরামর্শ দিয়েছেন।
করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, আমরা বলে যাচ্ছি, করোনা ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে। এটা নিয়ন্ত্রণে যেসব মতামত দিচ্ছি তা হালকাভাবে নেওয়া ঠিক হবে না। এখন আমরা ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছি। মানুষ সচেতন না হলে সামনে আরো ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধে আছি। যুদ্ধে যা করতে হয়, করোনা যুদ্ধে তাই করতে হবে। করোনা যুদ্ধে জয়ী হতে হলে সবার স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, মানাতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে সব কিছু চলছে। এ কারণে করোনা চিকিত্সা সক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। এখনো সময় আছে, সব সিটি করপোরেশন ও বড় বড় শহরে দুই সপ্তাহের জন্য কঠোর লকডাউন দিতে হবে। তাহলে সংক্রমিত মানুষ অন্যদের মধ্যে ছড়াতে পারবে না। দুই সপ্তাহ পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব কিছু খুলে দিতে পারে। অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ বলেন, মনে রাখতে হবে, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে করোনা এমন ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে চলে গিয়েছিল যে, ঐ সব দেশে এক পর্যায়ে ৬০ বছরের বেশি মানুষকে চিকিত্সাসেবার বাইরে রেখে ইয়ংদের চিকিত্সাসেবা দেওয়া হয়েছিল। বৃদ্ধদের আইসিইউ থেকে সরিয়ে অল্প বয়স্কদের আইসিইউতে রাখা হয়েছিল। এতে আইসিইউ সাপোর্ট না পেয়ে বৃদ্ধরা মারা যান। সেই পরিস্থিতি এখন বাংলাদেশে চলে এসেছে। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই।
করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সব জেলায় আইসিইউ চালুর নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি। ৩৬ জেলায় এখনো আইসিইউ নেই। যারা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে পারেননি, তারাই করোনায় মৃত্যুর জন্য দায়ী। ব্যর্থতার দায়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ চিকিত্সার অভাবে করোনা রোগীরা মারা যাচ্ছে। ব্যাপক হারে করোনা রোগী বাড়ায় সক্ষমতার বাইরে চলে গেছে চিকিত্সাসেবা। সব রোগী ঢাকায় চলে আসছে। তিনি বলেন, করোনা থেকে রক্ষা পেতে এখন স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, মানাতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, যে হারে করোনা রোগী বাড়ছে তাতে চিকিত্সাসেবা ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। মৃত্যু আরো বাড়তে থাকবে। চিকিত্সার অভাবে রোগীরা মারা যাবে। তাই সবার স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, মানাতে হবে। এ ব্যাপারে কঠোর থেকে কঠোরতর হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশ সোসাইটি অব এনেসথেসিওলজিস্টের সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এনেসথেসিওলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, আমরা ৩৬ জেলায় আইসিইউ করার জন্য জনবল ও যন্ত্রপাতি ক্রয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। এরপর মিটিংয়ের পর মিটিং হয়েছে। কিন্তু সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। মাঝখানে করোনা কমে গেলে অনেকে সুর দিয়েছিলেন যে, করোনা জয় করেছি। তিনি বলেন, এখন করোনা রোগী বৃদ্ধি পাওয়ায় চিকিত্সা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সিট পাওয়া যাচ্ছে না, অক্সিজেন পাওয়া যাচ্ছে না। অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বণিক বলেন, আমরা বিদেশফেরতদের কোয়ারেন্টাইনে রাখতে পারিনি। যার খেসারত দিতে হচ্ছে। এখন লকডাউন, লকডাউন, লকডাউন, কঠোর লকডাউন দিতে হবে দুই সপ্তাহ। আর এই দুই সপ্তাহ দেশের গরিব মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।
দেশে করোনা ভাইরাসে গত এক দিনে ৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা এ যাবত্কালের সর্বাধিক। তবে দিনে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা গত কয়েক দিনের তুলনায় কমেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শনিবার জানিয়েছে, গতকাল শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ৫ হাজার ৩৪৩ জন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৯৩৭ জন। সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে গত কয়েক দিন ধরেই দিনে ৬ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়ে আসছিল। এর মধ্যে গত বুধবার রেকর্ড ৭ হাজার ৬২৬ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছিল।
জনগণের সচেতনতার অভাব, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে উদাসীনতাসহ বিভিন্ন কারণে দেশে করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) গবেষণায় বাজার ও গণপরিবহন থেকে করোনা সংক্রমণের সর্বোচ্চ ঝুঁকির চিত্র উঠে এসেছে। আইইডিসিআরের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাজার ও গণপরিবহন থেকে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে ৬১ শতাংশ। অন্যদিকে জনসমাগমস্থল থেকে করোনা ছড়ানোর ঝুঁকি শতকরা ৩৫ ভাগ। এদিকে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্তে নমুনা পরীক্ষা, নতুন রোগী শনাক্ত, মৃত্যু এবং সুস্থতাসহ সব সূচকই ঊর্ধ্বমুখী। এপিডেমিওলজিক্যাল ১৩তম সপ্তাহের (২৮ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল) সঙ্গে এপিডেমিওলজিক্যাল ১৪তম সপ্তাহের (৪ এপ্রিল থেকে ১০ এপ্রিল) তুলনামূলক বিশ্লেষণে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এতে দেখা গেছে, একই সময়ে করোনায় মৃত্যু বেড়েছে ৩০ দশমিক ২৩ শতাংশ, নমুনা পরীক্ষা বেড়েছে ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ, নতুন রোগী শনাক্ত বেড়েছে ২৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ এবং রোগী সুস্থতা বেড়েছে ৪২ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এক দিনে মৃতদের মধ্যে ৫১ জন ঢাকা বিভাগের, ১৫ জন চট্টগ্রাম বিভাগের।