বিস্ময়কর নেতা
জিএম কামরুল হাসান
মোনেম সাহেব সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথম যে কথাটা বলতে হয়, হি ওয়াজ ওয়ান অব দ্য ওয়ান্ডারফুল লিডার ইন বাংলাদেশ। আমার মনে হয়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেও অন্যতম। কারণ তার মতো মানুষ হয় না। ইন্ডাস্ট্রিতে তিনি খুবই মর্যাদাসম্পন্ন একজন ব্যক্তি। তিনটি নৈতিকতার বিষয়ে গুরুত্ব দিতেন—হার্ড ওয়ার্ক, অনেস্টি ও সিনসিয়ারিটি (কঠোর পরিশ্রম, সততা ও আন্তরিকতা)। এ কথা দিয়েই তার সঙ্গে আমার কাজের সূত্রপাত।এবং প্রথম দিন আমাকে বলেছিলেন, ‘এই মিয়া, শোনো, তিনটা জিনিস আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।’ তার জীবদ্দশায় আমি তার সঙ্গে সাড়ে চার বছর কাজ করেছি। তারপর তিনি মারা যাওয়ার পর আমি নেতৃত্ব দিই।
আমি যদি ব্যবসার দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তাভাবনা করি, তাহলে তিনি খুবই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন মানুষ ছিলেন। একজন নেতৃত্বের প্রধান যে গুণাবলি থাকে, তার মধ্যে অন্যতম একটি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া। তিনি খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। সমঝদার ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। মানুষকে তিনি খুব সম্মান করতেন। এটা ছিল তার একটা বড় দিক। তিনি পিয়ন থেকে শুরু করে সিনিয়র—সবাইকে সম্মান করতেন। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতেন, মানুষকে ভালোবাসতেন। নির্বিচারে মানুষের জন্য কাজ করে গেছেন। তিনি সত্যিই একজন দয়ালু মানুষ ছিলেন। মসজিদ, মাদ্রাসা অনেক কিছু তৈরি করেছেন। তার কাছে সাহায্য চেয়ে কেউ সাহায্য পাননি, এমন রেকর্ড আমি আমার পাঁচ বছরে দেখিনি। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তি হিসেবে অসাধারণ মানুষ ছিলেন। তিনি নিজে যেহেতু সংগ্রাম করে বড় হয়েছেন, তাই মানুষের সংগ্রামকে তিনি খুব বেশি মূল্যায়ন করতেন। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখতেন, যা আজকালকার দিনে দেখা যায় না। আমি যদি সংক্ষেপে বলি, হি ওয়াজ আ স্ট্রাগলার, ফাইটার, হি গ্রোন বাই হিমসেলফ, হি ওয়াজ ভেরি ভিশনারি। তিনি আমাকে প্রচণ্ড আদর করেছেন। তার যে ভালোবাসা আমি পেয়েছি, সে ঋণ আমার মনে হয় না কোনোদিন শোধ করতে পারব।
তার সঙ্গে আমার পরিচয়ের ঘটনাটা মজার। তাদের মানবসম্পদ বিভাগ থেকে আমাকে নিয়োগের জন্য কেউ একজন কল করেছিল ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে। তারপর আমি তার সঙ্গে দেখা করি। তিনি অত্যন্ত সুন্দর ব্যক্তিত্ব নিয়ে চলাফেরা করতেন। প্রথম দিকে আমি তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার ব্যক্তিত্বের মুগ্ধতার কারণে আমি কাজ শুরু করি। তিনি আমাকে ব্যবসাটাকে যে জায়গায় দিয়েছিলেন, আমি আমার প্রতিশ্রুতি রাখার চেষ্টা করেছি এবং আমি তাকে বলেছিলাম, তার জীবদ্দশায় তাকে ছেড়ে যাব না এবং আমি তাকে ছেড়ে যাইনি।
তিনি আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। আমার সঙ্গে প্রথম দিন কথা বলেছিলেন ৭০-৮০ মিনিট। দুই দফায় আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম যাব কিনা, কারণ তখন আমার আরেকটি প্রস্তাব ছিল। তারপর দ্বিতীয়বার তিনি আমাকে ডেকে বলেন, ‘তোমাকে আমার লাগবেই।’ পেশাদারিত্বের জায়গা থেকে তিনি আমাকে মূল্যায়ন করেছেন। তার বিজনেস দেখভালের জন্য একজন রাইট হ্যান্ড দরকার ছিল। তিনি আমাকে নিয়োগ দেন। আমি তার ছেলের মতোই ছিলাম। পাঁচ বছরের ভেতরে সাড়ে তিন বছরের মতো তার ডায়ালাইসিস হয়েছে। প্রতিটি ডায়ালাইসিসে আমি অংশ নিয়েছি। ডায়ালাইসিস শুরু হতো সন্ধ্যা ৭টা থেকে, চলত রাত ১০টা পর্যন্ত। আমি তার সঙ্গে অনেকবার লাঞ্চ করেছি। তিনি যখন খেতেন সামনে বসে থেকে একটু গল্প করা।
একজন ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি খুব দূরদর্শী ছিলেন। মার্কেটিংয়ের বিষয়টি খুব ভালো বুঝতেন। তিনি বুঝতেন কোন জায়গাটায় ব্যবসা হবে। তিনি ঝুঁকি নিতেন, চেষ্টা করতেন। খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন, খুব ভালো নেতৃত্বের অধিকারী ছিলেন, তিনি ছিলেন মানুষের নেতা। তিনি কাউকে তুই বলে, কাউকে তুমি বলে ডাকতেন। তার প্রতি মানুষরে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা একদিনে গড়ে ওঠেনি। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে নির্দেশনা দেয়ার ক্ষেত্রে খুব স্বচ্ছ ছিলেন। তার বিশ্লেষণক্ষমতা ভালো ছিল। তিনি একটা কাগজ দেখে বুঝতে পারতেন এটার ভেতরে ভুল আছে। দুর্দান্ত জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি জানতেন কীভাবে মানুষকে সংগঠিত করতে হয়। তিনি আরেকটি বিষয় বিশ্বাস করতেন, কোনো প্রডাক্ট বা সার্ভিসই কাজ করে না, যদি না এর পেছনে মানুষ কাজ না করে। সেই প্রডাক্ট বা কাজ মুখ থুবড়ে পড়ে। তিনি মাঠ পর্যায়ে যেতেন, সবকিছু দেখাশোনা করতেন। একটা সময় বয়সের কারণে পারেননি। আমার মনে আছে, ১৬ মে বলেছিলেন যে আমার আইসক্রিম ফ্যাক্টরিকে আরো দ্বিগুণ করতে চাই। এই যে এক লাখ মানুষকে চাকরি দিতে চাওয়া, উপকার করতে চাওয়া, মানুষের যেন অনেক কর্মসংস্থান হতে পারে, দশটা পরিবারের যেন উন্নয়ন হয়—এগুলো নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি নীরবে মানুষকে দান করতেন। রমজান মাসে হাজার হাজার মানুষকে ইফতারি দিতেন, কেউ জানতও না।
বিজনেস মানে সবসময় একই রকম যায় না। উত্থান-পতন চলতে থাকে। কখনো ভালো যায়, কখনো খারাপ। আবদুল মোনেম অত্যন্ত বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি নিজেই সান্ত্বনা দিতেন। আমাকে বলতেন, ‘এই সিইও, তুমি মন খারাপ করো না। ঠিক হয়ে যাবে।’ বলতেন, ‘আজকে ভালো হয়নি, কালকে ভালো হবে।’ আমি যখন কাজ শুরু করি স্টেকহোল্ডারে নন-কোঅপারেশনের বিষয়গুলোর সম্মুখীন হতে হয়েছে। তিনি সবসময় আমাকে বলতেন, ‘তুমি আমার দিকে তাকাও, আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখো। তুমি তোমার কাজ করে যাও’। তিনি আরেকটি দামি কথা বলতেন, তুমি কাজ করো বিধায় কথা হবে, কাজ না করলে কাউকে নিয়ে কথা হয় না। তোমার কাজ করে যাও, আমি তোমার পেছনে আছি, সঙ্গে আছি। ক্যারি অন।’ বিভিন্ন সংকট মুহূর্তে যখন আমি তার সঙ্গে কিছু শেয়ার করতাম, নাম্বার শেয়ার করতাম তিনি আমাকে উদ্বুদ্ধ করতেন। বলতেন, ‘ধুর মিয়া, মন খারাপ করো না। আজ ভালো হয়নি। কালকে ভালো হবে। এ মাস ভালো হয়নি, সামনের মাস ভালো হবে।’ বড় নেতৃত্বের বড় গুণ এটা। মানুষকে সমর্থন করা। একটা মানুষের প্রডাক্টিভিটি তুলে আনার জন্য তার দূরদর্শিতা ছিল মারাত্মক। তিনি আবার খুব নরম হূদয়ের মানুষ ছিলেন। এই সংমিশ্রণের কারণে যখন কোনো কিছু তাকে শেয়ার করা হতো তিনি খুব ভালোভাবে বিষয়টা বুঝতেন। পরিস্থিতিকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে পারতেন।
জিএম কামরুল হাসান: সাবেক সিইও ঈগলু, আবদুল মোনেম লিমিটেড
সূত্রঃ বণিক বার্তা