স্বর্ণের দাম বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ : এক বছরের মধ্যে দাম বাড়ল ১২ বার

করোনাভাইরাসের মধ্যে আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক স্বর্ণের বাজার। বিশেষত ভারত-চীন সীমান্ত সংঘর্ষের পর গতকাল বুলিয়ান মার্কেটে স্বর্ণের দাম রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এর প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারেও। এক মাসের মধ্যে দ্বিতীয় দফা বেড়ে গেছে স্বর্ণের দাম। আর এক বছরের মধ্যে (২০১৯-২০ অর্থবছর) দেশে স্বর্ণের দাম বাড়ল ১২ বার।
ভরিপ্রতি ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম বাড়ছে পাঁচ হাজার ৭১৫ টাকা। এতে সবচেয়ে ভালো মানের স্বর্ণের (২২ ক্যারেট) প্রতি ভরির দাম পড়বে ৬৯ হাজার ৮৬৭ টাকা। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণের সর্বোচ্চ দাম, যদিও গত ২৯ মে দেশে স্বর্ণের দামে রেকর্ড হয়। এর আগে ১৯ ফেব্রুয়ারিও স্বর্ণের দাম বেড়ে রেকর্ড হয়েছিল।
এদিকে আজ থেকে ২১ ক্যারেটের স্বর্ণ ৬৬ হাজার ৭১৮ টাকায়, ১৮ ক্যারেটের স্বর্ণ ৫৭ হাজার ৯৭০ টাকায় ও সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি স্বর্ণ বিক্রি হবে ৪৭ হাজার ৬৪৭ টাকায়। বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
জানতে চাইলে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাজুসের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগারওয়ালা বলেন, করোনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা চলছে। বিশ্বে অনেক পণ্যের দামও পড়ে যাচ্ছে। তবে এ সময়ে মানুষের সম্পদ হচ্ছে স্বর্ণ, যে কারণে এ সময়ে স্বর্ণের দাম বাড়ছে। গত আট বছরে বিশ্বব্যাপী স্বর্ণের দাম প্রতি ভরিতে বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার টাকা, যেটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে গতকাল। এটি আরও বাড়তে পারে, যা আপাতত কমার সুযোগ নেই।
ইয়াহু ফাইন্যান্সের তথ্যমতে, গতকাল আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স স্বর্ণের দাম বেড়েছে ২৪ ডলার বা এক দশমিক ৩৭ শতাংশ। গতকাল দিনশেষে বুলিয়ান মার্কেটে প্রতি আউন্স (২৪ ক্যারেট) স্বর্ণ বিক্রি হয় এক হাজার ৭৭৭ ডলারে, ১৬ মার্চ যা ছিল এক হাজার ৫০২ ডলার। অর্থাৎ প্রায় তিন মাসের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম বেড়েছে প্রায় ১৮ দশমিক ৩১ শতাংশ বা আউন্সপ্রতি ২৭৫ ডলার।
বাজুসের তথ্যমতে, গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে স্বর্ণের দাম অস্থির হয়ে উঠেছিল। এতে ১৯ ফেব্রুয়ারি দেশে প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৬১ হাজার ৫২৮ টাকা। এটি ছিল ওই সময় দেশের বাজারে স্বর্ণের সর্বোচ্চ দাম। এর আগে দেশে স্বর্ণের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। সে সময় প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম দাঁড়িয়েছিল ৬০ হাজার ৬৫৩ টাকা।
যদিও করোনায় সারা দেশে সাধারণ ছুটির মাঝেই অনেকটা নীরবে আরেক দফা স্বর্ণের দাম বাড়ায় বাজুস। সে সময় প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয় ৬৪ হাজার ১৫২ টাকা। তবে সে সময় দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি থাকায় তা আর বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়নি সংগঠনটি। পরে ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি শেষে ৩১ মে থেকে সারা দেশে সীমিত আকারে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলার অনুমতি দেয় সরকার।
তথ্যমতে, চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছরের শুরু থেকেই অস্থির দেশের স্বর্ণের বাজার। এতে গত ১২ মাসের মধ্যে ১২ বার বাড়ল স্বর্ণের দাম। এর মধ্যে শুধু আগস্টেই দাম বেড়েছে চারবার, যদিও মাঝে গত সেপ্টেম্বর ও মার্চে দুই দফা দাম সামান্য কমেছিল।
গত (২০১৮-১৯) অর্থবছরের ১৮ জুন ভরিপ্রতি ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম ছিল ৫০ হাজার ১৫৫ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরের শুরুতে ৪ জুলাই এসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫২ হাজার ১৯৬ টাকা ভরি। এরপর ২০ দিনের ব্যবধানে, অর্থাৎ ২৪ জুলাই এসে আবার দাম বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৫৩ হাজার ৩৬৩ টাকা ভরি।
পরে ৬ আগস্ট ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪ হাজার ৫২৯ টাকা ভরি, যদিও তার একদিনের ব্যবধানে (৮ আগস্ট) আবারও দাম বাড়ে স্বর্ণের। সে সময় ভরিপ্রতি ২২ ক্যারেট স্বর্ণের মূল্য দাঁড়ায় ৫৫ হাজার ৬৯৬ টাকা। পরবর্র্তী সময়ে আবার ১১ দিনের মাথায় অর্থাৎ ১৯ আগস্ট প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট স্বর্ণের মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ৫৬ হাজার ৮৬২ টাকা। এর আট দিন পর ২৭ আগস্ট তা আরেক দফা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৮ হাজার ২৮ টাকা।
যদিও ১১ সেপ্টেম্বর এসে ভরিপ্রতি ২২ ক্যারেট স্বর্ণের মূল্য কমে দাঁড়ায় ৫৬ হাজার ৮৬২ টাকা। এরপর প্রায় আড়াই মাস স্থিতিশীল ছিল স্বর্ণের বাজার। তবে ২৪ নভেম্বর এসে আবার প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম বেড়ে হয় ৫৮ হাজার ২৮ টাকা। ১৯ ডিসেম্বর এসে ভরিপ্রতি (২২ ক্যারেট) স্বর্ণের মূল্য দাঁড়ায় ৫৯ হাজার ১৯৫ টাকা। ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধিকে এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। ৫ জানুয়ারি থেকে স্বর্ণের দাম আরও এক দফা বেড়ে হয় ভরিতে (২২ ক্যারেট) ৬০ হাজার ৩৪১ টাকা।
১৯ ফেব্রুয়ারি তা আরেক দফা বাড়ার পর ১৯ মার্চ তা আবার কিছুটা কমে। সে সময় প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম নির্ধারণ করা হয় ৬০ হাজার ৩৬১ টাকা। এরপর করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ায় ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এতে ৬৬ দিন বন্ধ ছিল সব স্বর্ণের দোকান। আর ২৬ দিনের ব্যবধানে দুবার বাড়ল স্বর্ণের দাম।
জুয়েলারি ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতি ভরি ২২ ক্যারেটে ৯১ দশমিক ছয় শতাংশ, ২১ ক্যারেটে ৮৭ দশমিক পাঁচ শতাংশ ও ১৮ ক্যারেটে ৭৫ শতাংশ বিশুদ্ধ স্বর্ণ থাকে। আর সনাতন পদ্ধতির স্বর্ণ পুরোনো অলঙ্কার গলিয়ে তৈরি করা হয়। এক্ষেত্রে কত শতাংশ বিশুদ্ধ স্বর্ণ মিলবে তার কোনো মানদণ্ড নেই। অলঙ্কার তৈরিতে স্বর্ণের দরের সঙ্গে মজুরি ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) যোগ করে দাম ঠিক করা হয়।
এদিকে বৈধপথে স্বর্ণ আমদানির নীতিমালা জারি করে লাইসেন্স দেওয়া হলেও কোনো ব্যবসায়ী এখন পর্যন্ত স্বর্ণ আমদানি করেননি। ভ্যাট-শুল্ক দিয়ে আমদানি করতে গেলে দাম বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় স্বর্ণ আমদানি হয়নি। যদিও আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে স্বর্ণ আমদানিতে ভ্যাট-শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে।
যদিও চোরাচালান প্রতিরোধ, সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে এক বছর আগে বৈধ পথে স্বর্ণ আমদানির নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই নীতিমালার আলোকে স্বর্ণ আমদানির অনুমতি চেয়ে ৪৭টি প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আবেদনও করেছিল। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব আবেদন যাচাই-বাছাই করে গত বছরের ১ ডিসেম্বর একটি ব্যাংক ও ১৭টি জুয়েলার্সকে স্বর্ণ আমদানির অনুমতি দেয়। বাতিল করা হয় ২৯টি আবেদন।
যদিও আমদানির অনুমোদন পাওয়ার কেউই এক মাসে স্বর্ণ আমদানি শুরু করেনি। জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, নীতিমালায় পাঁচ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর ধার্য করা থাকলেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইটে এখন তা দেখানো হচ্ছে ১৫ শতাংশ। তার সঙ্গে যোগ করা হয়েছে পাঁচ শতাংশ ট্রেড ভ্যাট। আর প্রতি ভরি স্বর্ণ আমদানিতে শুল্ক দুই হাজার টাকা রয়েছে অপরিবর্তিত। এই ভ্যাট-ট্যাক্স ও শুল্ক দিয়ে স্বর্ণ আমদানি করলে বাজারে স্বর্ণের দাম আট থেকে ১০ হাজার টাকা বেড়ে যাবে।
এ প্রসঙ্গে দিলীপ কুমার আগারওয়ালা বলেন, ‘স্বর্ণ আমদানির নীতিমালায় যে কোনো নাগরিককে বিদেশ থেকে আসার সময় সঙ্গে করে দুটি বার নিয়ে আসার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রতি বারের জন্য ২০ হাজার টাকা শুল্ক দিতে হবে। অন্যদিকে আমরা যারা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে টাকা খরচ করে লাইসেন্স পেয়েছি, তারা আমদানি করলে প্রতি বারের জন্য শুল্ক দিতে হবে ২৮ হাজার টাকা। এই বৈষম্যের কারণে আমাদের কেউ গোল্ডের বার আমদানি করবে না।’
এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বাজুসের পক্ষ থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে চিঠি দেওয়া হয়েছে বলে জানান আগারওয়ালা।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের ১৪ জানুয়ারির দিকে ভরিপ্রতি (২২ ক্যারেট) স্বর্ণের দাম ছিল ৪৬ হাজার ৭৩ টাকা। ২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি তা বেড়ে হয় ৫০ হাজার ৭৩৮ টাকা। এছাড়া ২০১৯ সালের ২ জানুয়ারি প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট স্বর্ণের দাম ছিল ৪৮ হাজার ৯৮৯ টাকা।