ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবেদ এর সফলতার গল্প
কোটি মানুষের স্বপ্নকে যিনি নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন। দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের সবচেয়ে বড় এনজিও ব্র্যাক। ব্র্যাকের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যে মানুষটির চিন্তা, চেতনা এবং পরিশ্রম অবিচ্ছেদ্য সূত্রে জড়িয়ে রয়েছে, তাঁর নাম ফজলে হাসান আবেদ। বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষের আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের সংগ্রামে তিনিই প্রধান পথিকৃত্। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বিধ্বস্ত বাংলাদেশের বিপন্ন মানুষের মধ্যে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি এই কার্যক্রমের সূত্রপাত করেছিলেন। তারপর গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশ জুড়ে লক্ষ লক্ষ দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক বিস্তৃত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে ব্র্যাক অনুসরণযোগ্য সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। বর্তমানে দেশের মাটি ছাড়িয়ে বিদেশেও এর কার্যপরিধি বিস্তৃত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে বিদেশি সাহায্যনির্ভর একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ক্ষুদ্র পরিসরে কার্যক্রম শুরু করলেও বর্তমানে ব্র্যাক স্বাধীন এবং স্ব-অর্থায়নে পরিচালিত স্থায়িত্বশীল মানব উন্নয়নের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মুক্তিযুদ্ধের ফসল ব্র্যাক, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্মলাভের পর বাংলাদেশে যত ভাল এবং বড় কাজ হয়েছে তার অনেকগুলোই করেছে ব্র্যাক। এই সাফল্য কিন্তু একবারে আসেনি। নানা ঘাত-প্রতিঘাত এবং প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে লক্ষ্য অর্জনের সংকল্পে স্থির ও একাগ্র থেকে ফজলে হাসান আবেদ আজ ব্র্যাককে এই অবস্থানে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন।
‘দারিদ্র্য বিমোচন ও দরিদ্র মানুষের ক্ষমতায়ন’ এই দুই লক্ষ্যকে সামনে রেখে ব্র্যাক তার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ক্ষুদ্রঋণ তথা উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্র্যাক যে বহুমুখী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে, তা এদেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নের সংগ্রামে উজ্জ্বল মাইলফলক হয়ে থাকবে। ব্র্যাকের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে ফজলে হাসান আবেদের কঠিন পরিশ্রম, নিরন্তর উদ্ভাবনা এবং আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত বারবার উন্মোচিত হয়।
ব্র্যাকের সূচনাপর্বের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ফজলে হাসান আবেদ বলেন, “মানুষের জন্য কাজ করতে হবে ব্র্যাক শুরু করার সময় এই ছিল একমাত্র চিন্তা। কখনও ভাবিনি যে, ব্র্যাক হবে পৃথিবীর সবচাইতে বড় এনজিও, এও ভাবিনি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে এর পরিচিতি ছড়িয়ে পড়বে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। আমি একটা বিষয়ে সবসময় সচেতন থাকার চেষ্টা করেছি। এমন কোনো কাজ আমি করতে চাইনি, যে কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে পারব না। যে কাজই করিনা কেন, ভালভাবে করব, এটাই আমার নীতি। ব্র্যাক শুরু করার সময়ও কথাটা আমার মাথায় ছিল। নিজেদের অর্থ দিয়ে ব্র্যাকের কাজ শুরু করেছিলাম। আমাদের অর্থের পরিমাণ খুব বেশি নয়, কিন্তু তা দিয়ে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে কাজ শুরু করেছিলাম। সেজন্যই আমরা সাফল্য অর্জন করেছি। পরবর্তী সময়ে বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো আমাদের কার্যক্রমে তহবিল জোগান দিয়েছে। ফলে কাজ করা সহজ হয়েছে। প্রথম যে বিদেশি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাককে অর্থ প্রদান করেছিল, সেটি হল, অক্সফাম-জিবি। অক্সফাম প্রায় দুই লক্ষ পাউন্ড দিয়েছিল। এই অর্থ দিয়ে আমরা অনেক কাজ করেছিলাম। ১৯৭২ সালের অক্টোবরে আমি লন্ডন গেলাম। অক্সফামের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করলাম। লক্ষ্য করলাম তাঁরা আমাদের কাজে খুবই খুশি। তাঁরা বললেন, ‘সারা পৃথিবীতে আমাদের প্রায় সাতশ প্রোজেক্ট আছে। এর মধ্যে যে প্রোজেক্টগুলো সবচাইতে ভাল চলছে, ব্র্যাক তার অন্যতম। অল্প সময়ের মধ্যে ব্র্যাক অনেক কাজ করেছে, যে কাজগুলো মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ছিল খুবই জরুরি।’ অক্সফামের কর্তাব্যক্তিদের এই সন্তুষ্টির যথাযথ কারণ ছিল।”
ফজলে হাসান আবেদের স্বপ্নের ব্র্যাক আজ বাংলাদেশের প্রায় ১০ কোটি মানুষের জীবন-জীবিকায় সহায়তা জুগিয়ে যাচ্ছে। এদেশের সব কয়টি জেলায় ব্র্যাক সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে। দেশের ৭৮ শতাংশ গ্রামে এর কর্মকাণ্ড বিস্তৃত। এ ছাড়া স্বদেশের সীমানা পেরিয়ে ব্র্যাককে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফগানিস্তানেও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহায়তা প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আফগানিস্তানে ব্র্যাক সফলতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।
জন্ম ও বংশ পরিচয় :
১৯৩৬ সালের ২৭ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচংয়ে সচ্ছল ও সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে ফজলে হাসান আবেদের জন্ম। তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিলেন ঐ অঞ্চলের অনেক বড় জমিদার। তাঁরা ছিলেন দুই পরগনার মালিক। ফজলে হাসান আবেদের পরিবারের সবাই ছিলেন শিক্ষিত। দাদারা ছিলেন চার ভাই। তাঁরা সকলেই কলকাতা গিয়ে পড়াশুনা করেছেন। এফএ পাশ করে সরকারী চাকরি করেছেন। ফজলে হাসান আবেদের দাদা খানবাহাদুর রফিকুল হাসানের চার পুত্র ও এক কন্যার মধ্যে তাঁর বাবা সিদ্দিক হাসান ছিলেন সবার বড়। তাঁর মেজ চাচা রাশিদুল হাসান ছিলেন জেলা জজ। আরেক চাচা ওবায়দুল হাসান ছিলেন নামকরা ডেন্টিস্ট। দেশভাগের আগে তিনি আসামের শিলচরে প্র্যাকটিস করতেন, পরে ঢাকায় চলে আসেন। ছোট চাচা একাত্তরের শহিদ সায়ীদুল হাসান। ফজলে হাসান আবেদের মায়ের নাম সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। বাবা-মায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা ছিল অনেকটা ফরমাল, তবে বাবার চাইতে মায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল অনেক বেশি। ফজলে হাসান আবেদ বলেন, ‘মায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল অনেক বেশি। মায়ের প্রতি আমার দুর্বলতাও ছিল বেশি। আমার মায়ের কিছু বিশেষ গুণ ছিল। আর এই গুণগুলোই তাঁকে অন্য অনেকের চেয়ে স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট করে রাখত। তাঁর মনটা ছিল খুব দয়ালু। মানুষের জন্য গভীর মমতা ছিল তাঁর। তিনি সর্বদাই দুঃস্থ মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। কারও ঘরে খাবার নেই এ খবর পেলে সঙ্গে সঙ্গে তার জন্য চাল পাঠিয়ে দিতেন। কারও অসুখ হলে চিকিত্সার ব্যবস্থা করতেন। রাতের বেলা কারও ঘরে হয়ত আলো জ্বালার কেরোসিন নেই। খবর পেয়ে ঐ বাড়িতে কেরোসিন পাঠিয়ে দিতেন। এভাবে নানা উপায়ে তিনি অসহায় দরিদ্র লোকদের সাহায্য করতেন। এজন্য এলাকায় তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। মনে হয় মায়ের এই প্রবণতাগুলো কিছুটা হলেও আমি পেয়েছি।’
ফজলে হাসান আবেদের বাবার মামা অর্থাত্ তাঁর নানা নওয়াব জাস্টিস স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা কলকাতার প্রথিতযশা উকিল ছিলেন। পরে তিনি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির গভর্নরের নির্বাহী কমিটির সদস্য হয়েছিলেন। এই কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিল চার জন। তাঁরা এখনকার মন্ত্রিসভার মত বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার সরকার চালাতেন। সৈয়দ শামসুল হুদা ছিলেন এই কমিটির প্রথম ভারতীয় সদস্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনিই ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের বিরোধিতা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি ব্রিটিশ সরকারের সম্মতি লাভে সমর্থ হন। কলকাতায় তিনি ছিলেন খুবই পরিচিত মুখ। তাঁর নামে কলকাতায় একটি সড়ক রয়েছে। সড়কটির নাম সৈয়দ শামসুল হুদা রোড। এটি এখনও বিদ্যমান। তাঁর কোনো সন্তান ছিল না। নিজের একমাত্র বোনের চার সন্তানকে তিনি মানুষ করেছেন।
ফজলে হাসান আবেদের নানা খানবাহাদুর সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন অবিভক্ত বাংলার মন্ত্রী ছিলেন। তাঁর নানাবাড়ি ছিল কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে। নানা ১৯৪১ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত মন্ত্রিত্ব করেছেন। ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন কৃষিমন্ত্রী, পরে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
ফজলে হাসান আবেদের বাবা এবং চাচারা লেখাপড়া করেছেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল অ্যান্ড কলেজে। তাঁর বাবা পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় লেখাপড়া শেষ করে বাড়ি ফিরে সংসারের হাল ধরেন। তিনি ছিলেন হবিগঞ্জের ডিস্ট্রিক্ট সাবরেজিস্ট্রার।
শিক্ষাজীবন :
ফজলে হাসান আবেদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় হবিগঞ্জে। তিনি হবিগঞ্জ সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণী থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। দেশভাগের ঠিক আগে তাঁর বাবা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে হবিগঞ্জ থেকে গ্রামের বাড়ি বানিয়াচংয়ে চলে আসেন। স্থানীয় হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার কথা থাকলেও পরিবারের অনেকের অমতের কারণে তাঁকে মেজ চাচা কুমিল্লার জেলা জজ রাশিদুল হাসানের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি ভর্তি হন কুমিল্লা জেলা স্কুলে। সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানেই লেখাপড়া করেন। এরপর চাচা জেলা জজ হিসেবে পাবনায় বদলি হয়ে যান। চাচার সঙ্গে তাঁকেও পাবনা যেতে হয়। তিনি সেখানে ভর্তি হন পাবনা জেলা স্কুলে। সেখান থেকেই ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন।
এরপর ইন্টারমিডিয়েট পড়ার জন্য তিনি পাবনা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৫৪ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে সে বছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে অনার্সে ভর্তি হন।
তাঁর চাচা সায়ীদুল হাসান তখন লন্ডনে পাকিস্তান দূতাবাসের বাণিজ্য সচিব ছিলেন। তিনি ফজলে হাসান আবেদকে স্কটল্যান্ডে গিয়ে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হতে বলেন। চাচার কথামতো ১৯৫৬ সালের অক্টোবর মাসে তিনি স্কটল্যান্ডে গিয়ে গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে নেভাল আর্কিটেকচারে ভর্তি হন। বিদেশে পড়তে গেলেও লেখাপড়া শেষে দেশে ফিরে আসবেন, এই ছিল তাঁর সিদ্ধান্ত। তাঁর ভাষায়, ‘যখন নেভাল আর্কিটেকচারে পড়তে গিয়েছিলাম তখন একটা রোমান্টিসিজম ছিল। স্বপ্নের হাতছানি ছিল, দেশের প্রথম নেভাল আর্কিটেক্ট হব আমি। এরকম একটা ভাবনা আমাকে আলোড়িত করত। কিন্তু যখন বুঝতে পারলাম, দেশে ফিরে আমি লেখাপড়াটা কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারব না, তখন আর নেভাল আর্কিটেকচারে পড়বার আগ্রহ থাকল না। সিদ্ধান্ত নিলাম, এ বিষয়ে পড়ব না। নেভাল আর্কিটেকচারের কোর্স ছিল চার বছরের। দুবছর লেখাপড়া করে কোর্স অসমাপ্ত রেখে ১৯৫৬ সালে গ্লাসগো ইউনিভার্সিটি ছেড়ে লন্ডন চলে এলাম। ভর্তি হলাম অ্যাকাউন্টিংয়ে। ভাবলাম, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হয়ে দেশে ফিরে যাব। কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টিংয়ের উপর চার বছরের প্রফেশনাল কোর্স শেষ করলাম। পাশ করলাম ১৯৬২ সালে।’
কর্মজীবন :
চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিংয়ে অধ্যয়নকালে ১৯৫৮ সালে ফজলে হাসান আবেদের মায়ের মৃত্যু হয়। মায়ের অবর্তমানে তাঁর দেশে ফিরে আসার তাগিদ কমে যায়। তিনি লন্ডনে চাকরিতে যোগদান করেন। কিছুদিন চাকরি করার পর চলে যান কানাডা। সেখানেও একটি চাকরিতে যোগ দেন। পরে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ক্রমাগত দেশান্তর ও পেশাবদল করতে করতে এক সময় তিনি বিদেশে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। ১৯৬৮ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। দেশে এসে তিনি শেল অয়েল কোম্পানির হেড অব ফাইন্যান্স পদে যোগদান করেন। এখানে চাকরির সময় সত্তরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হয়। ফজলে হাসান আবেদ উপদ্রুত এলাকা মনপুরায় গিয়ে ত্রাণকাজ পরিচালনা করেন। এর চারমাস পর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি চলে যান মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে তিনি আর চাকরিতে ফিরে যাননি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করার জন্য তিনি ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন।
হেলপ নামক সংগঠনের জন্ম :
মূলত ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের সময় অঙ্কুর আকারে ব্র্যাকের সূচনা হয়েছিল। সে বছর ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর উপকূলীয় এলাকা এবং সন্দ্বীপ, হাতিয়া, মনপুরা এই তিনটি স্থানে অগণিত মানুষের মৃত্যু হয়। দ্বীপগুলো পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সময় তিনি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের মানুষের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। মনপুরা দ্বীপে বেঁচে যাওয়া তের হাজার মানুষের কোন সহায়-সম্বল ছিল না।
ঘূর্ণিউপদ্রুতদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য তাঁরা কয়েকজন মিলে গড়ে তোলেন ‘হেলপ’ নামের একটি সংগঠন। এ সময় ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে ছিলেন ব্যারিস্টার ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী, শেলে তাঁর সহকর্মী কায়সার জামানসহ আরও কয়েকজন। ‘হেলপ’-এর মাধ্যমে তাঁরা মনপুরাতে কাজ করতে থাকেন। এসময় তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনদের রিলিফ দেওয়া, তাদের ঘরবাড়ি তৈরি করা প্রভৃতি কাজ করেছেন। শুরুতে নিজেরা টাকা তুলে সেই টাকা দিয়ে কাজ করেছেন। পরে জার্মানির একটি সংস্থা ত্রাণ কাজ চালানোর জন্য তাঁদেরকে ৩ মিলিয়ন ডয়েচ মার্ক অনুদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা আকবর কবীর (পরে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা) ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজের সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং অ্যাকশন বাংলাদেশ এর জন্মঃ
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ফজলে হাসান আবেদ চলে যান লন্ডনে। উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য একটা সংগঠন তৈরি করা। এ সময় তিনি শেল অয়েল কোম্পানিতে চাকরি করছিলেন। ২৫ মার্চের মধ্যরাতে বাংলাদেশের জনগণের উপর পাকিস্তানীরা সর্বাত্মক সামরিক হামলা চালায়। ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একসময় চট্টগ্রাম শহর হানাদারদের দখলে চলে যায়। ১২ এপ্রিল চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকার সংযোগ পুনঃস্থাপিত হলে ফজলে হাসান আবেদ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে আসেন।
তিনি বলেন, “দু-তিনদিন চেষ্টা করে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা এলাম। তখন শেল কোম্পানির চেয়ারম্যান ছিলেন জেনারেল আবদুর রহিম। তিনি ঢাকায় এসে হোটেল রূপাসী বাংলায় (পূর্বতন ইন্টারকন্টিনেন্টাল) উঠলেন। আমি ঢাকায় আছি জেনে তিনি আমাকে হোটেলে ডাকলেন। তিনি বললেন, ‘টিক্কা খানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তেল কোম্পানিগুলো থেকে একজন অফিসারকে নিয়ে সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের অফিসে বসানো হবে। তিনি লিয়াজোঁ অফিসারের কাজ করবেন এবং আরও সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, আপনিই হবেন আমাদের লিয়াজোঁ অফিসার।’ সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের অফিস ছিল গভর্নর হাউজে (এখনকার বঙ্গভবন)। তেল কোম্পানির লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হল। আমার কাজ তেলের জাহাজ কখন আসবে, কোথা থেকে আসবে, কোন্ জাহাজের তেল কোথায় শোধন করা হবে এসব বিষয় তদারক করা। সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে লিয়াজোঁ রক্ষাই আমার দায়িত্ব। আমি প্রথম দিন অফিসে গেলাম। এপ্রিল মাসের শেষভাগে কোনো একটি দিন হবে। একটি কক্ষে আমি এবং এক কর্নেল বসলাম। এই কর্নেলের কথাবার্তা শুনে আমার গা জ্বলে যেতে লাগল। খুব কষ্ট করে নিশ্চুপ থাকতে হল। আমাকে বাঘের ছাপওয়ালা পরিচয়পত্র দেওয়া হল। এই পরিচয়পত্র পাওয়ার পর যে কোনো জায়গায় যাওয়া-আসার ব্যাপারটি অনেক সহজ হয়ে গেল। যখন খুশি গভর্নর হাউজে যেতে-আসতে আমার কোনো বাধা থাকল না। পরপর দু-তিনদিন অফিসে গেলাম। কিছু কাজকর্ম করলাম। কিন্তু ঐ কর্নেলের কথাবার্তা শুনে মনে হল এখানে থাকা যাবে না। কর্নেল সবসময় বাঙালীদের নিয়ে অযৌক্তিক, অশালীন কথা বলত। ‘এইবার ঠিক হয়ে যাব’, ‘বাঙালীরা শক্তের ভক্ত নরমের যম’-এমনি আরও নানা ধরনের কথা। মুখ বুজে সব সহ্য করতে হত।”
ফজলে হাসান আবেদ সিদ্ধান্ত নিলেন, দেশত্যাগ করতে হবে। ইংল্যান্ডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে কাজ করতে হবে। ফজলে হাসান আবেদের ভাষায়, ‘মে মাসের প্রথম দিকে সিদ্ধান্ত নিলাম, ইংল্যান্ডে চলে যাব। আগে থেকেই সেখানে আমার জানাশোনা ছিল। আমি ভাবলাম, ইংল্যান্ডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য একটি সংগঠন তৈরি করব।’ সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রথমে করাচি গিয়ে সেখান থেকে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল হয়ে তিনি লন্ডন পৌঁছালেন। আবেদ বলেন, “লন্ডনে পৌঁছে দেখি, আমাদের বন্ধুরা ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন তৈরির চেষ্টা করছেন। লন্ডনে আমার অনেক বন্ধু ছিলেন। তাঁদের মধ্যে বিদেশীও ছিলেন বেশ কয়েকজন। তাঁরা বিপদের দিনে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সহযোগিতার হাত। তাঁদের অকুন্ঠ সাহায্য-সহযোগিতার ফলেই আমাদের জন্য কাজ করা সহজ হয়েছিল। এঁদের মধ্যে আমার বান্ধবী মারিয়েটা এবং পল কনেট নামে এক ভদ্রলোক সবচাইতে ত্যাগী মনোভাব নিয়ে নিরলসভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছিলেন। ততদিনে আমার বন্ধু ব্যারিস্টার ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী লন্ডনে চলে এসেছেন। আমরা সবাই মিলে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ শুরু করলাম।”
‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর সদস্যরা উপলব্ধি করলেন, পাকিস্তানীরা বাংলাদেশের মানুষের উপর যে নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে, তা পৃথিবীর মানুষকে জানানো প্রয়োজন। নাহলে বিশ্ববাসী প্রকৃত ঘটনা উপলব্ধি করতে পারবে না। তাঁরা প্রথমেই ‘লন্ডন টাইমস’ পত্রিকায় বড় আকারের একটা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করলেন। বিজ্ঞাপনে বলা হল, বাংলাদেশে গণহত্যা চলছে। এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার ও জাতিসংঘের উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়োজন।
আবেদ বলেন, ‘আমরা শুধু ইংল্যান্ডেই আমাদের কার্যক্রম সীমিত রাখতে চাইছিলাম না। ইউরোপের দেশগুলো মানবিক বিষয়ে খুবই সহানুভূতিশীল এবং সহমর্মী। জানতাম, তাঁদের কাছে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরতে পারলে তাঁরা সক্রিয় হয়ে উঠবেন। প্রথমে আমরা সেখানকার মিডিয়ার লোকজনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করলাম। রেডিও-টেলিভিশনে সাক্ষাত্কার দিয়ে বাংলাদেশের ভয়াবহ নৃশংস পরিস্থিতির কথা তুলে ধরলাম। ইউরোপের দেশগুলো বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানত না। ওখানকার রেডিও-টিভিতে সাক্ষাত্কার প্রচার করার জন্য আমাদেরকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়, ঘটনার প্রেক্ষাপট কী, এসব বিষয় তাঁদেরকে বোঝাতে হয়েছে। …আমি প্রথম টেলিভিশনে সাক্ষাত্কার দিয়েছিলাম কোপেনহেগেনে। তাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরো বিষয়টি বিশদভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। বাংলাদেশে যে নির্মম গণহত্যা চলছে, সে বিষয়ে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বলেছিলাম। সাংবাদিকদের অনেক প্রশ্নের জবাব আমাকে দিতে হয়েছিল। বাংলাদেশ কি স্বাধীন হয়ে টিকে থাকতে পারবে? দেশটিতে কী পরিমাণ সম্পদ আছে? বছরে কী পরিমাণ পণ্য রফতানি করতে পারবে? বৈদেশিক মুদ্রা কীভাবে আয় করবে বাংলাদেশ? এরকম অসংখ্য প্রশ্নের জবাব দিতে হয়েছে আমাদের। আমরা তাঁদেরকে বোঝাতে পেরেছিলাম যে, স্বাধীনতা পেলে আমরা টিকে থাকতে পারব। আমাদের তেমন কোনো সমস্যা হবে না। মিডিয়ায় সাক্ষাত্কারগুলো প্রচারিত হওয়ায় বাংলাদেশে যে নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে, বাঙালীরা যে মরণপণ সংগ্রাম করে যাচ্ছে, ইউরোপের দেশগুলো সে বিষয়ে আস্তে আস্তে জানতে শুরু করল। এরই মধ্যে আমার বন্ধু কায়সার জামানকে আমরা পাঠিয়ে দিলাম যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি সেখানে গিয়ে কাজ শুরু করলেন। ঢাকায় আমাদের কয়েকজন মার্কিন বন্ধু ছিলেন। জন রোডি, লিঙ্কন চেন, রিচার্ড ক্যাশসহ আরও কয়েকজন। এঁরা কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে (বর্তমানে আইসিডিডিআর’বি) কাজ করতেন। যুক্তরাষ্ট্র তাদের এই নাগরিকদের ২৮ কি ২৯ মার্চ বিশেষ বিমানে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাবার পর সিনেট হেয়ারিং-এ তাঁরা সাক্ষ্যপ্রদান করেন। তাঁরা বলেন, বাংলাদেশে গণহত্যা চলছে। হত্যাকাণ্ডের বেশ কিছু ছবিও তাঁরা তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। সিনেটরদের তাঁরা ঐসব ছবি দেখিয়েছিলেন।’
‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ব্যানারে তাঁরা মূলত প্রচারমূলক কাজগুলো করছিলেন। পরে তাঁরা উপলব্ধি করেন, কেবল প্রচারমূলক কাজেই তাঁদের তত্পরতা সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। সীমান্তবর্তী মুক্তাঞ্চলগুলোতে সাহায্য পাঠানোর জন্য তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন আরেকটি সংগঠন ‘হেলপ বাংলাদেশ’।
‘হেলপ’, ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ও ‘হেলপ বাংলাদেশ’-এর ধারাবাহিকতায় জন্ম নেয় ব্র্যাক:
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি ফজলে হাসান আবেদ দেশে ফিরে আসেন। সেই সময় ব্যারিস্টার ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী তাঁকে সিলেটের শাল্লা এলাকার কথা জানান। তিনি জানালেন, পুরো এলাকাটাই পাকিস্তানীরা ধ্বংস করে ফেলেছে। ফজলে হাসান আবেদ শাল্লায় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসবাসরত লোকজনকে দেখতে গেলেন। সেখানে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি শাল্লায় কাজ করবেন। এভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশের দরিদ্র, অসহায়, সবহারানো মানুষের ত্রাণ ও পুনর্বাসনকল্পে শুরু করলেন ‘Bangladesh Rehabilitation Assistance Committee’ সংক্ষেপে ‘BRAC’। ১৯৭৩ সালে সাময়িক ত্রাণ কার্যক্রমের গণ্ডি পেরিয়ে ব্র্যাক যখন উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে কাজ শুরু করে, তখন ‘BRAC’-এই শব্দসংক্ষেপটির যে ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয়, সেটি হল ‘Bangladesh Rural Advancement Committee’ । বর্তমানে ব্যাখ্যামূলক কোনো শব্দসমষ্টির অপেক্ষা না রেখে এই সংস্থা শুধুই ‘BRAC’ নামে পরিচিত।
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ব্র্যাকের জন্ম। সর্বজনশ্রদ্ধেয় কবি বেগম সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, কাজী ফজলুর রহমান, আকবর কবীর, ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী, এস আর হোসেন এবং ফজলে হাসান আবেদ–এই সাতজনকে নিয়ে ১৯৭২ সালে ব্র্যাকের গভর্নিং বোর্ড গঠিত হল। বোর্ড ফজলে হাসান আবেদকে প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করে। কবি বেগম সুফিয়া কামাল হলেন ব্র্যাকের প্রথম চেয়ারম্যান। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। এরপর সৈয়দ হুমায়ুন কবীর ২০০১ সাল পর্যন্ত ব্র্যাকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাকের চেয়ারপারসন পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। ব্র্যাকের পরিচালনা বোর্ড সম্পর্কে ফজলে হাসান আবেদ বলেন, ‘পরিচালনা বোর্ডে সদস্য নিযুক্তির ব্যাপারে আমি আগাগোড়া সতর্ক ছিলাম। সবসময় এমন কৃতী মানুষদের আনতে চেয়েছি যাঁরা নিঃস্বার্থভাবে সংগঠনের জন্য কাজ করবেন। যাঁরা ব্র্যাকের কাছে কিছুই চাইবেন না। কিন্তু দেবেন অনেক কিছু। … ব্র্যাকের পরিচালনা বোর্ডের সদস্যগণ কখনও কোনো চাহিদা নিয়ে ব্র্যাকের কাছে আসেননি। বোর্ডের কোনো সদস্য কোনোদিন বলেননি, আমার গাড়ি লাগবে বা আমার আত্মীয়কে চাকরি দিতে হবে। এখনও যাঁরা ব্র্যাকের পরিচালনা বোর্ডে রয়েছেন, তাঁরা নিঃস্বার্থভাবে কাজ করছেন। ব্র্যাক যে আজ এত বড় হয়েছে, তার অনেকটা কৃতিত্ব বোর্ডের সদস্যদের। যে কোনো অবস্থায় বোর্ড আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।’
# যেভাবে ব্র্যাকের কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছেন ফজলে হাসান আবেদ :
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাকের কর্মকাণ্ড শুরু করলেন। কিন্তু ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কোথায়? লন্ডনে ফজলে হাসান আবেদের একটি ছোট ফ্ল্যাট ছিল। একাত্তরে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে কাজ করার সময় তিনি নিজের খরচ চালানোর জন্য ফ্ল্যাটটি বিক্রি করে দেন। বিক্রি করে পেয়েছিলেন ৬৮০০ পাউন্ড। লন্ডনের একটি ব্যাংকে এই অর্থ তিনি রেখে দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, ঐ অর্থ দিয়ে তাঁর পরবর্তী তিন-চার বছরের খরচ চলে যাবে। এবার ব্র্যাকের কাজ শুরু করার জন্য ফজলে হাসান আবেদ লন্ডনের ব্যাংক থেকে ঐ অর্থ তুলে দেশে নিয়ে এলেন। এ ছাড়া কলকাতার ব্যাংকে ভিকারুল ইসলাম চৌধুরীর অ্যাকাউন্টে ছিল ২৫ হাজার রুপি। এই ৬৮০০ পাউন্ড এবং ২৫ হাজার রুপি দিয়ে শুরু হল শাল্লার মানুষের জন্য ‘রিলিফ এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন’ কর্মসূচি। সুতরাং বলা চলে, ব্র্যাকের প্রথম ‘ডোনার’ হচ্ছেন ফজলে হাসান আবেদ। শাল্লায় কাজ শুরু করার প্রথম অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা শাল্লায় গিয়ে প্রথম দিনই দশ-বারজন তরুণকে খুঁজে বের করলাম, যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বসে আছে। কোনো কাজ নেই। দিনপ্রতি ১০ টাকা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তাদেরকে জরিপের কাজে লাগিয়ে দিলাম। কিছু ছেলেকে কাজে লাগালাম যারা এস.এস.সি. পাশ। তাদের পারিশ্রমিক দিনে ৫ টাকা। সে সময় ১০ টাকা বা ৫ টাকা একেবারে কম নয়। তারা কাজ করতে থাকল। জরিপের মাধ্যমে কত বাড়িঘর নষ্ট হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন আগে কী ধরনের কাজ করত, এখন কী কাজ করতে পারবে, তার সমস্ত তথ্য-উপাত্ত পেয়ে গেলাম। …জরিপের তথ্য-উপাত্ত হাতে পাওয়ার পর যোগাযোগ করলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান ও অর্থনীতি বিভাগের সঙ্গে। তাঁদের কয়েকজন শিক্ষক এবং পাশকরা ছাত্রছাত্রী জরিপের তথ্য-উপাত্তগুলো বিশ্লেষণের কাজে লেগে গেলেন।