পরিবেশ রক্ষায় কাজ করতে হবে সবাইকে
দখল ও দূষণের কারণে রাজধানীর পরিবেশ দিন দিন অসহনীয় হয়ে উঠছে। শুধু ঢাকা নয়, পুরো দেশের বায়ুই দূষণের শিকার। নদীও একই সমস্যায় রয়েছে। বায়ু, মাটি ও পানি—সামগ্রিকভাবে পরিবেশ নিয়ে একটাই পৃথিবী। পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে হলে পরিবেশ সুরক্ষায় যার যার অবস্থান থেকে একযোগে কাজ করতে হবে।পরিবেশ দিবস উপলক্ষে গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। মোবাইল অপারেটর কোম্পানি গ্রামীণফোন ও প্রথম আলো যৌথ উদ্যোগে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
সভায় বক্তারা এবারের পরিবেশ দিবসের মূল স্লোগান ‘একটাই পৃথিবী’র উল্লেখ করে প্রত্যেককে তাঁর নিজের চারপাশের পরিবেশ রক্ষায় কাজ করার আহ্বান জানান। আজ ৫ জুন বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে পরিবেশ দিবস পালিত হবে।
অনুষ্ঠানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, প্রকৃতিকে ধ্বংস করায় এখন জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বড় দুর্যোগগুলো বাড়ছে। প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। তিনি বলেন, দেশের উপকূলীয় এলাকাগুলোয় ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে মানুষ বাড়িঘরছাড়া হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার মানুষ এসব এলাকা থেকে ঢাকায় আসছেন। তাঁদের জন্য বসবাস, পয়োনিষ্কাশন ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। এই বাড়তি মানুষের চাপে রাজধানীর পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে।
মেয়র আতিকুল বলেন, ‘আমাদের এখন দুইটি “দ”–এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে। একটি হচ্ছে দখল, আরেকটি দূষণ।’ রাজধানীর নদী ও খালগুলোর উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এগুলোয় হওয়ার কথা মাছ চাষ। কিন্তু হচ্ছে মশার চাষ। সরকারি সংস্থাগুলোর পাশাপাশি প্রত্যেক নাগরিককে দূষণরোধে ভূমিকা রাখতে হবে। প্রত্যেকে যদি তাঁর বাড়ির বর্জ্য নিজেরা পরিশোধন করে বাইরে ফেলেন, তাহলে রাজধানীর পরিবেশের অনেক উন্নতি হবে।
গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইয়াসির আজমান বলেন, ‘আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী রেখে যেতে হবে। সেই কাজ আমাদের এখন থেকে শুরু করতে হবে।’ দেশের ১৭ কোটি মানুষের বেশির ভাগ মুঠোফোন ব্যবহার করেন বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁদের প্রত্যেকে কয়েক বছর পর পর সিমকার্ড পরিবর্তন করেন। সেগুলো যদি মাটির সঙ্গে মেশে তাহলে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হবে। তাই গ্রামীণফোন সিমবিহীন সংযোগ বা ই-সিম চালুর উদ্যোগ নিয়েছে।
ইয়াসির আজমান উল্লেখ করেন, গ্রামীণফোন নিজেদের কার্যক্রমের কারণে তৈরি হওয়া কার্বন নিঃসরণ কমানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০৫০ সালের মধ্যে তাদের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ৫০ শতাংশ কমানো হবে। ২০২১ সালের মধ্যে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ তারা কমিয়েছে।
কোন কোন উপায়ে কার্বন নিঃসরণ কমানো হয়েছে, তা–ও তুলে ধরেন ইয়াসির আজমান। তিনি বলেন, ‘আমরা ডিজেলচালিত জেনারেটরের বদলে বিদেশ থেকে উন্নত মানের ব্যাটারি এনে কার্বন নিঃসরণ কমিয়েছি। তবে ব্যাটারির মেয়াদ শেষ হলে তা মাটি ও পরিবেশ দূষণ করে। সে জন্য আমরা এ পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় ৮০ হাজার ব্যাটারি রিসাইকেল (পূর্ণ ব্যবহারের উপযোগী) করেছি।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক মুজিবর রহমান বলেন, ঢাকার পরিবেশ দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বায়ুদূষণের দিক দিয়ে ঢাকা প্রায়ই বিশ্বের এক বা দুই নম্বর অবস্থানে থাকে। ঢাকার বাতাসে এখন হাইড্রোকার্বন নামে নতুন ধরনের দূষিত পদার্থ দেখা যাচ্ছে। শীতলক্ষ্যা নদীর পানি পরীক্ষা করে তাতে অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা পাওয়া গেছে, যা মাছসহ অন্যান্য প্রাণীর দেহে প্রবেশ করে শেষ পর্যন্ত মানুষের শরীরে ঢুকে পড়ছে।
ঢাকায় অপরিকল্পিত উন্নয়ন, বাড়িঘর নির্মাণ এবং শিল্পকারখানা স্থাপনের কারণে পরিবেশ দূষিত হয়ে পড়ছে উল্লেখ করে অধ্যাপক মুজিবর রহমান বলেন, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ কঠিন। তবে অসম্ভব নয়।
আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেখ বশির উদ্দিন বলেন, ‘আমরা যতই বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক হই না কেন, আমাদের এই শহরে থাকতে হবে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এখানেই বড় হবে। কিন্তু শহরই যদি বসবাসের অযোগ্য হয়, তাহলে বড় শিল্পপতি হয়ে আমাদের কী হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা নিজেরা সব সময় আমাদের সিমেন্ট, টাইলসসহ সব শিল্পকারখানার দূষণ সরকারের বায়ু ও পানিদূষণের মানমাত্রার নিচে রাখি। আমরা আগামী দিনে এমন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করব, যাতে কারখানায় পণ্য উৎপাদনের সময় যে বর্জ্য হবে, তা পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করা যাবে।’
বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তা অরণ্য ক্র্যাফটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নওশীন খায়ের বলেন, ‘আমাদের দেশে কোন খাত থেকে কী পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে, তার প্রয়োজনীয় তথ্য নেই। তাই কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে কার দায়িত্ব কতটুকু, তা নির্ধারণ করা যাচ্ছে না।’
সঞ্চালক হিসেবে দেওয়া বক্তব্যে দেশের পরিবেশ রক্ষায় আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও সচেতনতা তৈরির ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, প্রথম আলো শুরু থেকে পরিবেশ ও বনভূমি রক্ষা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। সামনের দিনগুলোয় এ ব্যাপারে প্রথম আলো আরও ভূমিকা রেখে যাবে। সবাই মিলে চেষ্টা করলে পৃথিবীকে বসবাসের উপযোগী রাখা সম্ভব।