South east bank ad

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংকে জমা ২ লাখ কোটি টাকার বেশি

 প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   বাংলাদেশ ব্যাংক

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংকে জমা ২ লাখ কোটি টাকার বেশি

সরকারের পরিচালন ব্যয় বাড়তে থাকায় অর্থের চাহিদাও বাড়ছে। তবে আয় সে অনুপাতে না বাড়ায় ব্যাংক ও ব্যাংক-বহির্ভূত প্রতিষ্ঠান থেকে ক্রমেই বাড়ছে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংকে গচ্ছিত আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ কোটি টাকার বেশিতে। এসব অলস আমানত থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো বিপুল পরিমাণ সুদ আয় করছে। অর্থ সংকট থাকলেও সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতের টাকা কাজে লাগাতে পারছে না। এজন্য কোনো নীতিমালা না থাকাকে দায়ী করছেন খাতবিশ্লেষকরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় এসব টাকার কতটা জমা রাখা হবে, কতটুকু সরকারের কোষাগারে ফেরত দেয়া হবে বা সুদ আয় দিয়েই কী করা হবে, তা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। এজন্য সরকারকে নীতিমালা প্রণয়নের পরামর্শ দেন তারা। এছাড়া সরকার ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ করলে ব্যক্তি খাত বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি এবং রাষ্ট্রের সুদব্যয়ের বোঝাও ভারী হয়ে ওঠে বলে অভিমত তাদের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর গচ্ছিত আমানতের পরিমাণ ২ লাখ ১৩ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। যার মধ্যে চলতি হিসাবে রয়েছে ১৪ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা। সঞ্চয়ী আমানতের পরিমাণ ২ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। বিশেষ নোটিসের আমানত ৭৭ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা। মেয়াদি আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ১৫ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। অন্যান্য আমানত রয়েছে ৪ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা।

মূলত সুদ আয় বাড়তে থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক আমানত বড় হচ্ছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরু থেকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার (রেপো রেট) ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে। এর পর থেকে ক্রমাগতভাবে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ছে। এ হার এখন ১৫-১৬ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আর সুদহার বাড়ার সুযোগ নিচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো। উচ্চ সুদের প্রভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের সুদের আয়ও বড় হচ্ছে।

জ্বালানি তেল বিপণনকারী রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড। ২০২৪ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ব্যাংকে গচ্ছিত আমানতের সুদ বাবদ কোম্পানিটি আয় করেছে ২৪৯ কোটি টাকা। আগের বছরের একই সময়ে এ বাবদ কোম্পানিটির আয় হয়েছিল ১৭২ কোটি টাকা। মূলত সুদহার বাড়তে থাকার প্রভাবে এক বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির এ খাত থেকে আয় বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ।

পদ্মা অয়েলের মতো কোম্পানিগুলোর মূল আয়ের উৎস হিসেবে ধরা হয় জ্বালানি তেল বিক্রির কমিশন বাবদ আয়কে। যদিও এরই মধ্যে পদ্মা অয়েলের ব্যাংকে গচ্ছিত আমানতের সুদ বাবদ আয় জ্বালানি তেল বিক্রির কমিশন হিসেবে করা আয়কে ছাড়িয়ে গেছে। কোম্পানিটির আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কোম্পানিটি জ্বালানি তেল বিক্রির কমিশন থেকে আয় করেছে ১৬২ কোটি টাকা। আর আগের বছরে একই সময়ে এ বাবদ আয় হয়েছিল ১৩৬ কোটি টাকা। পদ্মা অয়েলের মতো রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি তেল বিপণন কোম্পানিগুলোর প্রতিটিরই আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস এখন ব্যাংকে জমা রাখা আমানতের সুদ।

একদিকে সরকারের ব্যাংকনির্ভরতা বাড়লেও এসব প্রতিষ্ঠানের অলস অর্থ সরকার কাজে লাগাতে পারছে না। এজন্য কোনো নীতিমালা না থাকাকে দায়ী করছেন খাতবিশ্লেষকরা। ফলে নানা অজুহাতে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাংকে টাকা জমা রেখে সুদ আয় বাড়াচ্ছে।

এ বিষয়ে ইনস্টিটিউট অব ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিগত সরকার কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান থেকে জমা রাখা অর্থ নিয়েছিল। কিন্তু সবগুলো প্রতিষ্ঠান থেকে তা নিতে পারেনি। কারণ এখানে কোনো অর্থ জমা রাখা হবে, কোন অর্থ সরকারকে ফেরত দেয়া হবে বা সুদ আয় দিয়ে কী করা হবে—এসব নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। ফলে নানা অজুহাতে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো এসব টাকা ব্যাংকে জমা রেখে সুদ থেকে আয় করে থাকে। তাই এসব নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে সুস্পষ্ট নীতিমালা করা উচিত।’

এদিকে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ বাড়ছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস জুলাই-ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ৬ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা নিট ঋণ করেছে। শুধু ব্যাংক নয়, সরকারের ব্যাংক-বহির্ভূত ঋণও বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ব্যাংকের বাইরে থেকে ২৪ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা নিট ঋণ নিয়েছে সরকার। যদিও গত অর্থবছরের একই সময়ে নিট ঋণ নেয়া হয়েছিল ৭ হাজার ৯০ কোটি টাকা। অর্থাৎ সরকারের ব্যাংক ও নন-ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরতা বাড়ছে।

দেশের ব্যাংকগুলোর আয়ের প্রধান উৎস এতদিন ছিল বেসরকারি খাত। মুনাফা করত শিল্প ও সেবা খাতে দেয়া ঋণের সুদ ও কমিশন থেকে। কিন্তু এ মুহূর্তে ব্যাংকের আয় ও মুনাফার প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে সরকারি খাত। ব্যাংকগুলো এখন ব্যক্তি খাতকে না দিয়ে সরকারকেই বেশি ঋণ দিচ্ছে। এতে বেশি মুনাফা পাচ্ছে বেশির ভাগ ব্যাংকও।

সরকার ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলে ব্যক্তি খাত বঞ্চিত হয় বলছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া সরকারে সুদ ব্যয়ের বোঝাও বেড়ে যায়। তাই শক্তিশালী আর্থিক ব্যবস্থাপনার তাগিদ দিচ্ছেন তারা। এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকারের উন্নয়ন ও পরিচালন ব্যয় বড় হচ্ছে। কিন্তু সে হারে আয় বাড়ছে না। তাই সরকার ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিচ্ছে। এতে সরকারের সুদের বোঝা ভারী হচ্ছে। আবার এতে করে ব্যক্তি খাত ঋণ নিতে পারে না। বহু বছর ধরেই সম্পদের সঞ্চালন বাড়াতে না পারায় আমরা দুর্বল অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় রয়েছি। সরকারকে এ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান লোকসানি আছে। তবে যারা আয় করে ব্যাংকে টাকা জমাচ্ছে, তাদের থেকেও সরকার অর্থ নিতে পারে। এটা সরকার আবার ফেরতও দিতে পারে।’

রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক আমানতের পরিমাণ ফুলেফেঁপে উঠলেও এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের পরিমাণ মাত্র ৩৩ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা। যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলোর মেয়াদি আমানতের পরিমাণই ১ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। অর্থাৎ এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণের তুলনায় মেয়াদি আমানতের পরিমাণ তিন গুণের বেশি।

BBS cable ad

বাংলাদেশ ব্যাংক এর আরও খবর: