জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার দেয়া হয় ২ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা

দেশের ব্যাংক খাতে বিরাজমান তারল্য সংকট তীব্র হচ্ছে। তা মোকাবেলায় দেশের ব্যাংকগুলোর তারল্য জোগানে বড় উৎস হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেবল গত জুনেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে ২ লাখ ২৭ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। রেপো ও স্পেশাল লিকুইডিটি ফ্যাসিলিটিজ হিসেবে ব্যাংকগুলো এ সহায়তা নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি করা ‘মানি মার্কেট ডাইনামিকস’ শীর্ষক প্রতিবেদনের জুন সংখ্যায় এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রতি মাসে গড়ে ব্যাংকগুলোকে দেয়া তারল্য সহায়তার পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯০ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে গড়ে ৯৪ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে রেপো হিসেবে। আর স্পেশাল লিকুইডিটি ফ্যাসিলিটিজ হিসেবে গড়ে ধার দেয়া হয়েছে ৯৫ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা।
এতদিন দেশে ১, ৭, ১৪ ও ২৮ দিন মেয়াদি রেপো চালু ছিল। তবে চলতি জুলাই থেকে কেবল সাতদিন মেয়াদি রেপো চালু রয়েছে। সে হিসেবে রেপোর মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ধার দেয়া অর্থের বেশির ভাগই সমন্বয় হয়েছে। আর স্পেশাল লিকুইডিটি ফ্যাসিলিটিজের মেয়াদ একদিন। বর্তমানে রেপোর সুদহার ১০ শতাংশ। আর স্পেশাল লিকুইডিটি ফ্যাসিলিটিজের সুদহার ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারিত রয়েছে। দৈনন্দিন লেনদেন শেষে কোনো ব্যাংক সিআরআর (আমানতের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমা সংরক্ষণ) ঘাটতিতে পড়লে তবেই স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট নেয়।
তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো অর্থের জোগানের জন্য প্রথমে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে (কলমানি) যায়। সেখানে পর্যাপ্ত অর্থ না মিললে রেপোর মাধ্যমে মুদ্রাবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে ধার দেয়া ব্যাংকের কাছে সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ধক রাখতে হয়। কলমানি কিংবা রেপোর মাধ্যমে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে না পারলে তবেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। এক্ষেত্রে দিনের নির্দিষ্ট সময়ে আবেদন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপোতে ধার নেয়া হয়। দৈনন্দিন লেনদেন শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষিত সিআরআর ঘাটতি দেখা দিলে স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট হিসেবে ব্যাংকগুলো অর্থ ধার করে। উভয় ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ড তথা সিকিউরিটি বন্ধক রাখতে হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে বিরাজমান তারল্য সংকটের সূত্রপাত হয়েছিল ২০২২ সালে। ওই সময় ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে ডলার কেনার টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে চলে যায়। তবে এ সংকট তীব্র হয়েছে লুণ্ঠনের শিকার ব্যাংকগুলোর বিপর্যয়ের কারণে। এ ব্যাংকগুলো পুরোপুরি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধারনির্ভর হয়ে পড়েছে। ভালো ব্যাংক হিসেবে পরিচিত কয়েকটি ব্যাংকও রেপো ও স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট নিচ্ছে। অপেক্ষাকৃত কম সুদে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নেয়া অর্থে ওই ব্যাংকগুলো সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ড কিনছে। এভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থে সরকারকে ঋণ দিয়ে ওই ব্যাংকগুলো বড় অংকের মুনাফা করছে।
রেপোতে ধার নিয়ে সরকারি বিল-বন্ড কেনাকে অনৈতিক চর্চা বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘রেপো কিংবা স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট নেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সরকারি সিকিউরিটিজ জমা রাখতে হয়। এখন কোনো ব্যাংক যদি তারল্য সংকট না থাকা সত্ত্বেও রেপো নেয়, তাহলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তেমন কিছু করার থাকে না। রেপোতে ধার নিয়ে সে অর্থে বিল-বন্ড কেনা অবৈধ না হলেও এটি অনৈতিক। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, ব্যাংকগুলো এ ধরনের অনৈতিক চর্চা থেকে বিরত থাকবে।’
আরিফ হোসেন খান আরো বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করেছে। গত কয়েক মাস মূল্যস্ফীতির হার নিম্নমুখী। এটি আরেকটু কমে এলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহারও কমাবে। এতে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহারও কমবে। আশা করছি, আগামী মাসগুলোতে বিল-বন্ডের সুদহার রেপো রেটের পর্যায়ে নেমে আসবে। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নেয়ার প্রয়োজনীয়তাও কমবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস তথা গত জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপোতে ধার নেয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৯৬ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা। ওই মাসে একদিন মেয়াদি রেপোতে ১ হাজার ৬৫১ কোটি, সাতদিন মেয়াদি রেপোতে ২৩ হাজার ৯৭৮ কোটি, ১৪ দিন মেয়াদি রেপোতে ২৯ হাজার ১৬৫ কোটি ও ২৮ দিন মেয়াদি রেপোতে ৪১ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা ধার নেয় ব্যাংকগুলো। এর পরের মাসগুলোয় রেপোতে ধার নেয়ার প্রবণতা কোনো মাসে কমেছে, আবার কোনো মাসে বেড়েছে। ব্যাংকগুলো আগস্টে ৮১ হাজার ৬৬৮ কোটি, সেপ্টেম্বরে ৯৫ হাজার ৪০৫ কোটি, অক্টোবরে ৯৬ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা রেপোতে ধার নেয়। নভেম্বরের পর থেকে মার্চ পর্যন্ত রেপোতে ধার নেয়ার পরিমাণ কিছুটা কম ছিল। কিন্তু চলতি বছরের এপ্রিল-পরবর্তী সময় থেকে রেপোতে ধার নেয়ার প্রবণতা অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। মে মাসে রেপোতে ধারের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪ কোটি টাকা। আর জুনে রেপোতে ধার আরো বেড়ে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের জুলাইয়ে স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্টে ব্যাংকগুলোর নেয়া ধারের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। আগস্টে গিয়ে তা লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ওই মাসে স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ধার দিয়েছিল ১ লাখ ২ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে বিশেষ এ ধার ১ লাখ ১০ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকে। এরপর অক্টোবরে কিছুটা কমে এলেও নভেম্বরে স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্টের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৯১ কোটি টাকায়। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে এ ধার ৮০ হাজার কোটি টাকার নিচে নেমে এলেও ফেব্রুয়ারিতে এসে আবারো ১ লাখ ৭ হাজার ৭১ কোটি টাকায় ওঠে। মার্চ ও এপ্রিলে স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্টের পরিমাণ কিছুটা কমলেও মে মাসে সেটি ১ লাখ ১৬ হাজার ১৮০ কোটি টাকায় ঠেকে। তবে অর্থবছরের শেষ মাস তথা জুনে স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট হিসেবে ব্যাংকগুলো ৮১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা ধার করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ভালো ব্যাংকগুলো রেপোতে ধার বেশি নিলেও স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট নিয়েছে মূলত তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংক। গত তিন বছর ইসলামী ধারার বেশির ভাগ ব্যাংকসহ অনিয়ম-দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া ব্যাংকগুলো স্পেশাল লিকুইডিটি সাপোর্ট নিচ্ছে। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এত বেশি পরিমাণ অর্থ ধার দিতে হচ্ছে। তবে মেয়াদ কম হওয়ায় এ অর্থের বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ফিরে এসেছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে গত দুই অর্থবছর সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য রেপো বা নীতি সুদহার পাঁচ দফায় বাড়ানো হয়েছে। রেপো রেট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে উন্নীত করা হয় ১০ শতাংশে। আর সরকার ট্রেজারি বিল-বন্ডের মাধ্যমে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিচ্ছে সাড়ে ১১ থেকে সাড়ে ১২ শতাংশে। এটিকে সুযোগ হিসেবে নিয়ে অনেক ব্যাংক ১ থেকে দেড় শতাংশ মুনাফা করছে। বেসরকারি খাতে না দিয়ে ব্যাংকগুলো এখন সরকারকে বেশি ঋণ দিচ্ছে। এ কারণে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে।