বাণিজ্য সহজ করতে এনবিআরের ব্যতিক্রম উদ্যোগ
বাণিজ্য সহজীকরণ ও সীমান্ত বাণিজ্য সমন্বয় করতে পদক্ষেপ নিচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এরই ধারাবাহিকতায় ব্যতিক্রম উদ্যোগ হিসেবে ‘ওয়ান স্টপ বর্ডার পয়েন্ট’ চালু করতে চায় সংস্থাটি। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল ট্রেড ফ্যাসিলেটশন কমিটির ৭ম সভায় নথিপত্র বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
আমদানি ও রফতানি সহজীকরণ করতে এনবিআর নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করছে। জানা গেছে, দ্রুত কাস্টমস প্রক্রিয়া সম্পন্নের পরও কোনো কোনো পণ্যচালান খালাসে দীর্ঘসময় ব্যয় হচ্ছে। এতে বাণিজ্য ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে।
সভার নথি অনুযায়ী, আমদানি-রফতানি ও ট্রানজিট বাণিজ্য সহজীকরণের উদ্দেশ্য পূরণে স্থানীয় পর্যায়ে ‘বর্ডার এজেন্সি কর্পোরেশন’ এবং ‘কনসালটেশনের’ জন্য দেশের সব কাস্টম হাউস, দুটি বিমানবন্দর ও কয়েকটি শুল্ক স্টেশনে একটি করে ‘সীমান্ত বাণিজ্য সমন্বয় কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। বাণিজ্য সহজীকরণ নিশ্চিতকল্পে সীমান্ত বাণিজ্য সমন্বয়ে এনবিআর সম্প্রতি এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
নথি অনুযায়ী, ৬টি কাস্টম হাউসের কমিশনারকে আহ্বায়ক করে সীমান্ত বাণিজ্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। কাস্টমস হাউসগুলো হলো- কাস্টম হাউস চট্টগ্রাম, কাস্টমস হাউস ঢাকা, কাস্টমস হাউস মোংলা, কাস্টমস হাউস বেনাপোল, কাস্টমস হাউস আইসিডি-কমলাপুর, কাস্টমস হাউস পানগাঁও।
এছাড়া আমদানি-রফতানি ও ট্রানজিটের পরিমাণ বিবেচনায় যেসব কাস্টম স্টেশনসমূহ অধিক গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো হলো- ভোমরা (সাতক্ষীরা), দর্শনা (চুয়াডাঙ্গা), সোনামসজিদ (চাঁপাইনবাবগঞ্জ), হিলি (দিনাজপুর), বাংলাবান্ধা (পঞ্চগড়), বুড়িমারী (লালমনিরহাট), তামাবিল (সিলেট), শেওলা (সিলেট), আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), টেকনাফ (কক্সবাজার) স্থল কাস্টমস স্টেশন। দুটি বিমানবন্দর হলো- ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টমস স্টেশন সিলেট, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কাস্টমস স্টেশন চট্টগ্রাম।
এনবিআরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, প্রতিটি কাস্টম হাউস ও শুল্ক স্টেশনের কমিশনারকে আহ্বায়ক ও উপ-কমিশনারকে সদস্যসচিব করে এই সীমান্ত বাণিজ্য সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে।
২৪ সদস্যের কমিটিতে আরো ২২টি সংস্থার প্রতিনিধি থাকবেন। যেসব সংস্থার প্রতিনিধি থাকবেন তারা হলেন- বন্দর কর্তৃপক্ষ বা সিভিল এভিয়েশন; বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ; ইমিগ্রেশন বিভাগ; বাংলাদেশ বিমান; উদ্ভিদ সংগনিরোধ দপ্তর, কৃষি মন্ত্রণালয়; প্রাণিসঙ্গ নিরোধ দপ্তর, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়; বিস্ফোরক অধিদপ্তর; বাংলাদেশ নৌবাহিনী; বিএসটিআই; সোনালী ব্যাংক লিমিটেড; বাংলাদেশ ব্যাংক; পরমাণু শক্তি কমিশন; চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ; সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন; ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন বা ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন; শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন; কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন; বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোস অ্যাসোসিয়েশন; স্থানীয় পুলিশ (মেট্রোপলিটন-থানা-ট্রাফিক-এপিবিএন); কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর; শুল্ক মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেট; অন্যান্য দফতর বা নিজ দফতরের প্রতিনিধি।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ও ট্রেড ফ্যাসিলেটশন এর আলোকে কমিটির কার্যপরিধি হলো- স্ব স্ব কাস্টম হাউস, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, স্থল কাস্টমস স্টেশনের মাধ্যমে আমদানি-রফতানি ও ট্রানজিট বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাসমূহ চিহ্নিতকরণ ও তা বিদ্যমান আইনের বিধান অনুযায়ী নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
ন্যাশনাল ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন কমিটির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা ও প্রত্যেক তিন মাসে সংশ্লিষ্ট কাস্টমস হাউসে, বিমানবন্দর কাস্টমস স্টেশনে, স্থল কাস্টমস কাস্টমস স্টেশনে ন্যূনতম একটি সভা আয়োজন এবং সভায় উপস্থিত প্রতিনিধিদের মতামতের আলোকে বাণিজ্য সংক্রান্ত প্রতিবন্ধকতাসমূহ নিরসনে যথাযথ প্রস্তাব সংশ্লিস্ট কর্তৃপক্ষের নিকট প্রেরণ, ফলো-আপ এবং সমন্বয় সাধন; কার্যদিবস ও কার্যঘণ্টা প্রয়োজন অনুসারে অভিন্ন রাখার লক্ষ্যে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন করা।
আমদানি-রফতানি কার্যক্রম সহজীকরণে অভিন্ন প্রক্রিয়া ও আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার লক্ষ্যে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন; উন্নয়ন ও অভিন্ন সেবা পরিকাঠামো বিনিময়ের উদ্যোগ গ্রহণ; পারস্পরিক তথ্য ও উপাত্ত আদান-প্রদান, সহযোগিতা, সমন্বয় সাধন ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে যৌথ নিয়ন্ত্রণ মূলক কার্যক্রম; ওয়ান-স্টপ বর্ডার পয়েন্ট প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে পারস্পরিক সমন্বয় ও যোগাযোগ রক্ষা করা।
কো-অর্ডিনেটেডে বর্ডার ম্যানেজমেন্ট বা ইন্ট্রিগেটেড বর্ডার ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে সমন্বয় এবং জাতীয় পর্যায়ের জন্য সুপারিশ প্রেরণ করা।
এনবিআর সূত্রে জানা যায়, বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য সহজীকরণের অংশ হিসেবে ২০১৩ সালে ডব্লিউটিও ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন অ্যাগ্রিমেন্টচূড়ান্ত করা হয়। এই চুক্তি ২০১৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কার্যকর হয়। বাংলাদেশ চুক্তিটিতে ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর অনুসমর্থন প্রদান করে। এই চুক্তির আওতায় বাণিজ্য সহজীকরণের লক্ষ্যে কাস্টমসের প্রয়োজনীয় পদ্ধতি ও কাঠামোগত সংস্কার, দরকারি তথ্য-উপাত্ত প্রাপ্তি সহজীকরণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এনবিআর নানামুখী উদ্যাগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কার্যক্রম চলমান। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশে বাণিজ্য সহজীকরণ নিশ্চিতকল্পে এনবিআর সীমান্ত সংস্থা এবং অংশীজনদের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য পরামর্শ সভা গঠন একটি অন্যতম পদক্ষেপ।
অন্য পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে- পণ্যচালান খালাসে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক পদ্ধতি প্রয়োগের জন্য কাস্টমস রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিশনারেট গঠন; পণ্যচালান খালাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে অনলাইনে তথ্য-আদান প্রদানের মাধ্যমে পণ্য খালাস প্রক্রিয়া দ্রুততর করার জন্য ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো প্রকল্প গ্রহণ; আমদানি-রফতানি সংক্রান্ত বিভিন্ন জিজ্ঞাসার জবাব প্রদানের নিমিত্ত ওয়েবভিত্তিক ন্যাশনাল ইনকোয়ারি পয়েন্ট চালুকরণ; কায়িক ও দলিলাদি পরীক্ষণ ব্যতিরেকে সরাসরি পণ্য খালাস প্রদানের জন্য উত্তম চর্চাকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য অথরাইজড ইকোনমিক অপারেটর (এইও) সুবিধা চালু; আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে পণ্যচালান বন্দরে পৌঁছার পূর্বেই যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা পরিপালন করে পণ্যচালান বন্দরে আসামাত্রই খালাস প্রদানের লক্ষ্যে প্রি-অ্যারাইভাল প্রসেসিং (পিএপি) ব্যবস্থা চালু; পণ্য খালাস প্রক্রিয়া দ্রুততর করার জন্য খালাসোত্তর নিরীক্ষা পদ্ধতি চালু, পঁচনশীল পণ্য দ্রুত খালাসকরণ সংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়ন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।