শিরোনাম

South east bank ad

যেভাবে তিন দশক আত্মগোপনে ছিলেন চরমপন্থি মানিক

 প্রকাশ: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   র‍্যাব

যেভাবে তিন দশক আত্মগোপনে ছিলেন চরমপন্থি মানিক

বিডিএফএন টোয়েন্টিফোর.কম

১৯৮৭ সালে গুরুদাসপুর থানা লুট করে একজন কনস্টেবলকে খুন, অস্ত্র লুট এবং আটক চরমপন্থিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি সাইফুল ইসলাম ওরফে মানিককে (৫৬) গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)।

সাইফুলকে গ্রেপ্তারের পর র‍্যাব বলছে, গ্রেপ্তার মানিক সর্বহারা দলের সক্রিয় সদস্য। সর্বহারাদের নেতৃত্বে পরিচালিত সব কার্যক্রমে নিয়মিত অংশ নিতেন তিনি। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে তিনি ‘ছাত্তার’ নামে শ্রমিক সরদার হিসেবে কাজ করতেন।

২০১৮ সালে মানিক তার নাম পরিবর্তন করে সাইফুল প্রধান নামে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকার ভোটার হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেন বলেও জানিয়েছে র‍্যাব। শনিবার (১০ সেপ্টেম্বর) কারওয়ান বাজারে র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, ১৯৮৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে একদল চরমপন্থি ছদ্মবেশে লুঙ্গি, গামছা পরা অবস্থায় হাতে পোটলা নিয়ে হাটের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে থাকে। পোটলার মধ্যে তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্র লুকায়িত ছিল। তাদের মধ্যে কিছু লোক অস্ত্র প্রদর্শন করে টেলিফোন অফিস নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সেন্ট্রাল কমান্ড বিকল করে দেন এবং কয়েকজন থানায় প্রবেশ করে অস্ত্রের মুখে থানা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন।

এ সময়ে কনস্টেবল হাবিবুর রহমান বাধা দিলে চরমপন্থিরা তাকে গুলি করে হত্যা করে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে থানার অস্ত্রাগার লুট করে দুটি এসএমজি, চারটি এসএলআর, ১৮টি ৩.৩ রাইফেল ও গোলাবারুদ লুট করে থানার লকআপে বন্দি এক চরমপন্থি আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে যান। তারপর আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য তারা একযোগে টেলিফোন অফিস ও থানা কম্পাউন্ডে বোমা বিস্ফোরণ ঘটান। পরে লুণ্ঠিত মালামাল নিয়ে পালিয়ে যান।

এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে নাটোর জেলার গুরুদাসপুর থানায় ১৯৮৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা হয়। এ মামলার তদন্ত শেষে সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তা ২০ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করেন। গ্রেপ্তার আসামিদের জবানবন্দি, সাক্ষীদের সাক্ষ্য ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ৪৯ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। বিচার প্রক্রিয়া শেষে ২০০৭ সালে মামলার রায় ঘোষণা করেন আদালত।

র‌্যাব-৩ এর আভিযানিক দল গোপন সংবাদের মাধ্যমে জানতে পারে, এ মামলার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি নারায়ণগঞ্জ এলাকায় আত্মগোপন করে আছেন। তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় ও গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে শুক্রবার (৯সেপ্টেম্বর) রাতে অভিযান চালিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ এলাকা থেকে ‘ছাত্তার’ নামে ছদ্মবেশে আত্মগোপন করা সাইফুল ইসলাম ওরফে মানিককে গ্রেপ্তার করা হয়।

জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাতে র‍্যাবের এ কর্মকর্তা জানান, মানিক ১৯৮৪ সালে চরমপন্থি নেতা তারেকের মাধ্যমে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। চরমপন্থি নেতা তারেক প্রতি সপ্তাহে চাটমোহর এলাকায় উঠতি বয়সের যুবকদের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে উঠান বৈঠক করতেন। এ বৈঠকে তিনি আকর্ষণীয় কথাবার্তা বলতেন। কেউ তাদের কাজে বাধা দিলে তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার কথা বলতেন। যদি সরকার বা সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তারা পুলিশ হত্যা করে থানা ফাঁড়ি লুট করবেন বলেও জানান ।

তাদের এমন আকর্ষণীয় কথায় মুগ্ধ হয়ে মানিক সক্রিয়ভাবে চরমপন্থিদের সঙ্গে হত্যা, লুটপাট, ত্রাস সৃষ্টি ও অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির মতো কাজে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। চরমপন্থিদের সঙ্গে যোগ দেওয়ায় এলাকায় সবাই তাকে সমীহ করতেন। যাদের সঙ্গে তার বিরোধিতা ছিল, সবাই আপসে চলে আসেন।

চরমপন্থি নেতা তারেক এ ঘটনার দুই মাস আগে থেকে গুরুদাসপুর থানা লুট করার পরিকল্পনা করেন। এজন্য তিনি ঝিনাইদহ, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ি, কুষ্টিয়া, পাবনা, টাঙ্গাইল এলাকা থেকে চরমপন্থি দলের সদস্যদের আহ্বান জানিয়ে একত্রিত করেন। ঘটনার দিন তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৬০ জন নাটোরের ধামাইর মাঠে এসে জড়ো হয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী ছদ্মবেশে লুঙ্গি, গামছা পরিহিত অবস্থায় পোটলার মধ্যে অস্ত্র লুকিয়ে গুরুদাসপুর থানা ও টেলিফোন অফিসের আশপাশ এলাকা এবং হাট এলাকায় অবস্থান নেন।

ঘটনার এক সপ্তাহ আগে থেকেই কয়েকজন সার্বক্ষণিকভাবে টেলিফোন অফিসের কর্মী এবং গুরুদাসপুর থানার ফোর্সের গতিবিধির ওপর নজরদারি করছিলেন। তাদের সবুজ সংকেত পাওয়া মাত্রই সুলতানের নেতৃত্বে পাঁচজন টেলিফোন অফিসে প্রবেশ করে সেন্ট্রাল কমান্ড বিকল করে দেন। অন্যদিকে তারেকের নেতৃত্বে মানিকসহ প্রথমে চারজন জিডি করার জন্য থানায় প্রবেশ করেন এবং মজিদের নেতৃত্বে ১০ জন থানা ব্যারাকে প্রবেশ করে সব ফোর্সকে কক্ষের মধ্যে বন্দি করে রাখেন।

এ সময় ডিউটিরত কনস্টেবল হাবিবুর রহমান প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাইলে তারেক গুলি করে হত্যা করা হয়। গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে থানার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তখন তারেক অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে অস্ত্রাগার থেকে সকল অস্ত্র, গোলাবারুদ লুটপাট করে এবং থানার লকআপে বন্দি ইয়াকুব নামে চরমপন্থি দলের আটক একজনকে তালা ভেঙে মুক্ত করেন। এরপর তারা বোমা ফাটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে থানা কম্পাউন্ড এবং টেলিফোন অফিস ত্যাগ করে লুণ্ঠনকৃত অস্ত্র নিয়ে স্থানীয় হাটের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে চলে যান।

পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের দলের সদস্যরা ভিড়ের মধ্যে ছদ্মবেশে লুকিয়ে ছিলেন। কেউ তাদের কাজে বাধা দিলে প্রতিহত করার পূর্ব প্রস্তুতি তাদের ছিল। লুণ্ঠনকৃত অস্ত্র তারেক, সুলতান, মজিদ ও ইয়াকুব তাদের হেফাজতে নিয়ে চাটমোহর, চলনবিল এলাকায় লুকিয়ে রাখেন। ঘটনার পর মানিক বাড়িতে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে থাকেন। ১৯৮৮ সালে তারেকের নেতৃত্বে চাটমোহর থানার খোতবাড়ি এলাকায় মাঠের মধ্যে রাতে নকশালপন্থী ও সর্বহারাদের মধ্যে সম্মুখযুদ্ধ হয়। এতে নকশালপন্থী ১২ জন নিহত হন।

এ ঘটনার পর মানিকসহ সর্বহারা দলের সদস্যরা চলনবিলে গোসল করে যার যার বাড়িতে চলে যান। ভোর হলে পুলিশ ১২টি লাশ উদ্ধার করে থানায় মামলা করে। মামলায় মানিক গ্রেপ্তার হন। এ ঘটনায় গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে গুরুদাসপুর থানার অস্ত্র লুটের সত্যতা বেরিয়ে আসে। জামিনে মুক্ত হয়ে মানিকের পলাতক জীবন শুরু হয়। জামিনে মুক্ত হওয়ার পর তিনি আদালতে কোনো হাজিরা দেননি। থানা লুট ও ১২ জনকে হত্যা মামলাসহ মানিকের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা রয়েছে।

আসামির জীবনবৃত্তান্ত

গ্রেপ্তার আসামি মানিক সর্বহারা দলের সক্রিয় সদস্য। সর্বহারাদের নেতৃত্বে পরিচালিত সকল কার্যক্রমে তিনি নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। তার কোনো নির্দিষ্ট পেশা ছিল না। ত্রাস সৃষ্টি, লুটপাট ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ দিয়েই তিনি জীবিকা নির্বাহ করতেন। সে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। সম্প্রতি তিনি নারায়ণগঞ্জ, রূপগঞ্জ এলাকায় ছাত্তার নামে শ্রমিক সরদার হিসেবে কাজ করছিলেন।

২০১৮ সালে মানিক তার নাম পরিবর্তন করে সাইফুল প্রধান নামে নারায়ণগঞ্জে রূপগঞ্জ এলাকায় ভোটার হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করেন। রূপগঞ্জ এলাকায় তিনি ছাত্তার নামে পরিচিত। রূপগঞ্জ এলাকার মানুষ তার অপরাধ কার্যক্রম সম্পর্কে জানতেন না।

পলাতক জীবন

১২ জন হত্যা মামলার পর তারেকসহ চরমপন্থি দলের সদস্যরা চাটমোহর থেকে আত্মগোপন করে সিরাজগঞ্জে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে তারা তাদের দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। ১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাসে তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে মানিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন।

জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি তারেকের সঙ্গে যোগাযোগ করে চরমপন্থি দলের সঙ্গে আবারও হত্যা, লুটপাট, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, অস্ত্র প্রদর্শন করে ত্রাস সৃষ্টি, অস্ত্র নিয়ে এলাকায় মহড়া দেওয়া, অর্থের বিনিময়ে জমি দখল, পারিবারিক বিরোধ মীমাংসার কাজে লিপ্ত হয়ে পড়েন।

র‍্যাব কর্মকর্তা আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, গ্রেপ্তার মানিক তারেকের সঙ্গে নৌকায় বিলের মধ্যে অবস্থান করতেন। দলের কার্যক্রম শেষে তারা আবারও সশস্ত্র অবস্থায় বিভিন্ন এলাকায় নৌকার মধ্যেই জীবন-যাপন করতেন।

২০০৪ সালে চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে র‌্যাবের সাঁড়াশি অভিযান শুরু হলে তারেকের নির্দেশে চরমপন্থিরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েন। তখন মানিক রাজধানীতে চলে আসেন। রাজধানীতে কিছুদিন বাসের হেলপারি করে্ন। ট্রাকে মালামাল লোড-আনলোডের শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। এরপর নারায়ণগঞ্জে তার এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন। ওই আত্মীয় তাকে একটি গার্মেন্টস কারখানায় চাকরি দেল এবং সবার কাছে তাকে ছাত্তার নামে পরিচয় করিয়ে দেন।

ধীরে ধীরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান স্তিমিত হলে তারা আবার মাঝে মাঝে এলাকায় গিয়ে সর্বহারা দলের কার্যক্রম চালাতে থাকেল। ৭-৮ বছর আগে চরমপন্থি দলের অন্তর্দ্বন্দ্বে তারেক নিহত হলে মানিক সর্বহারা দলের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেন। তিনি এনআইডি পরিবর্তন করে রূপগঞ্জ এলাকার ভোটার হিসেবে নিজেকে ছাত্তার নামে প্রতিষ্ঠিত করে নিজের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন।

BBS cable ad

র‍্যাব এর আরও খবর: