South east bank ad

একগুচ্ছ উদ্যোগে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে পুঁজিবাজার

 প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ পূর্বাহ্ন   |   শেয়ার বাজার

একগুচ্ছ উদ্যোগে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে পুঁজিবাজার

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় থেকেই নানা অনিয়মে জর্জরিত ছিল পুঁজিবাজার। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর অবশ্য কিছুদিন পুঁজিবাজারে সুদিন ফিরে আসে। যদিও তা বেশিদিন স্থায়ী থাকেনি। এর ভেতরে থাকা নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে আবারও বাজার নিয়মিত পতনের বৃত্তে পড়ে যায়। এ ধারাবাহিক পতনে গত ২৮ অক্টোবর ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স এর পয়েন্ট নামে পাঁচ হাজারের নিচে, যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এরপর সরকারের আর কিছু সিদ্ধান্ত ও কারসাজির অভিযোগ এনে রাস্তায় নামেন বহু বিনিয়োগকারী। শুরু হয় অচলাবস্থা। এরপর বৈঠকের বৈঠক ও অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের পুঁজিবাজার নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আশ্বাস বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশার আলো দেখায়।

এছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কমিশনের নেয়া নানামুখী উদ্যোগে পতনের মুখ থেকে একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে পুঁজিবাজার। বিএসইসি ও সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে ডিএসইর প্রধান সূচক বেড়েছে ৪৪৮ পয়েন্ট, বাজার মূলধন বেড়েছে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা। বাজার ভালো করতে বিএসইসি ও সরকারের একগুচ্ছো উদ্যোগ-

পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ও তারল্য বাড়াতে সরকার থেকে আইসিবির ফান্ড আনার উদ্যোগ।
ক্ষুদ্র ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের প্রণোদনা দেওয়ার উদ্যোগ।
পুঁজিবাজারে স্থিতিশীলতা ফেরাতে স্বল্প মধ্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার আশ্বাস অর্থ উপদেষ্টার।
শেয়ার বিক্রি করে অর্জিত মূলধনী মুনাফা বা ক্যাপিটাল গেইনের ওপর করহার কমানো।

পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজার ভালো করতে সরকারের নানামুখী উদ্যোগের মধ্যে শেয়ার বিক্রি করে অর্জিত মূলধনী মুনাফা বা ক্যাপিটাল গেইনের ওপর করহার কমানোর প্রভাবে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে, যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বাজারে। বাজারে তারল্য ঘাটতি ছিল দীর্ঘদিন ধরে। আইসিবির ফান্ড বাড়ানোর উদ্যোগও বিনিয়োগকারীদের মাঝে আশার আলো জাগিয়েছে। এছাড়া জুন ক্লোজিংয়ের কারণে অধিকাংশ কোম্পানি ডিভিডেন্ড ঘোষণা করছে। এটাও বাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বাজার ভালো করতে হলে বিনিয়োগকারীদের মাঝে আস্থা ও সরকারি-বেসরকারি ভালো কোম্পানি তালিকাভুক্ত করতে হবে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নানা অনিয়মে ধুঁকতে থাকা পুঁজিবাজার অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে ঘুরে দাঁড়াবে- এমন প্রত্যাশা ছিল সবার। কিন্তু তা হয়নি। পুঁজিবাজারে লাগাতার পতনে পুঁজি হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন বিনিয়োগকারীরা। এতে করে পুঁজি হারানোর প্রতিবাদে রাস্তায় বিক্ষোভসহ বিভিন্ন কর্মসূচি দেন বিনিয়োগকারীরা। যদিও তাতে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। তবে সূচক ৫ হাজার পয়েন্টের মনস্তাত্ত্বিক স্তরের নিচে নেমে যাওয়ার পর নড়েচড়ে বসে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও স্টক এক্সচেঞ্জ। এ পরিস্থিতিতে ২৭ অক্টোবর জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খানের সঙ্গে বৈঠক করে ডিএসইর পর্ষদ। বৈঠকে মূলধনী মুনাফায় কর কমানোর দাবি জানান তারা। এরপর একই দাবিতে গত ৩১ অক্টোবর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি থেকে এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়। এছাড়া পুঁজিবাজারের তারল্য সহায়তা বাড়াতে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবিকে একটি তহবিল প্রদানের জন্যও তদবির শুরু করে বিএসইসি। এছাড়া ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনও (ডিবিএ) বিভিন্ন সময় মূলধনী মুনাফায় কর প্রত্যাহারে দাবি জানান।

ডিবিএ সভাপতি সাইফুল ইসলাম ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, মূলধনী মুনাফায় কর প্রত্যাহারের প্রভাবে পুঁজিবাজারে উত্থান হয়েছে বলে আমি মনে করি। এটা হচ্ছে সাইকোলজিক্যাল ইমপ্যাক্ট। ট্যাক্সকে মানুষ ভয় করে। ভয়ের জন্য অনেকে সাইডলাইনে ছিলেন। ভালো খবর সব সময় বাজার ইতিবাচকভাবে নেয়। এটার প্রতিফলন দেখা গেছে বাজারে। এর সঙ্গে বাজার ধারাবাহিক পতনে অনেক নিচে চলে গিয়েছিল। বাজার ঊর্ধ্বমুখী রাখতে হলে ভালো কোম্পানি ও স্বচ্ছতা আনতে হবে। স্বচ্ছতা আনতে হলে বাজারের সঙ্গে জড়িত রেগুলেটরি, স্টক এক্সচেঞ্জের মধ্যে কাজের জবাবদিহিতা আনতে হবে।

পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান আবু আহমেদ ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, গত ১৫ বছরে পুঁজিবাজারে যেমন খারপ কোম্পানি এসেছে, এর সঙ্গে কারসাজি করে এগুলোর ২০ টাকার শেয়ারকে হাজার টাকায় নিয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের হাতে দিয়ে বড় বিনিয়োগকারীরা চলে গেছে। এছাড়াও ফ্লোর প্রাইসসের কারণে মার্জিন লোনের শেয়ারগুলো ফোর্স সেলে পড়ে যায়, এতে বাজারের ধারাবাহিক পতন হয়। তবে সরকার ও বিএসইসি উদ্যোগে ক্যাপিটাল গেইনের ওপর করহার কমানো ও আইসিবির ফান্ডের ব্যবস্থায় ঊর্ধ্বমুখী বাজার।

ঊর্ধ্বমুখী বাজারের ধারা ধরে বজায় রাখতে হলে বিএসইসি ও সরকারের আরো কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে বলে মনে করেন আইসিবির চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, বাজারে ভালো কোস্পানি আনতে হবে, ক্ষুদ্র ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের প্রণোদনা দিতে হবে, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের মার্জিন লোনের সুদ মওকুফ করতে হবে। এতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসবে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশের ম্যাক্রো অর্থনীতি ভালো হলে ব্যাংকের সুদ হার কমে যাবে। ব্যাংকের সুদ হার কমলে এমনেতেই পুঁজিবাজার ভালো হয়ে যাবে।

অর্জিত মূলধনী মুনাফার ওপর কর হার কমানোর নতুন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী একজন করদাতার ৫০ কোটি টাকার অধিক নীট সম্পদ থাকলে শেয়ার বাজার থেকে অর্জিত ৫০ লাখ টাকার অতিরিক্ত আয়ের ওপর তাকে ১৫ শতাংশ হারে কর এবং প্রদেয় কর ১৫ শতাংশ এর ওপর ৩৫ শতাংশ অর্থাৎ ৫.২৫ শতাংশ সারচার্জসহ কর প্রদান করতে হবে। তবে করদাতার নীট সম্পদের পরিমাণ ৫০ কোটি টাকার কম হলে সারচার্জের হার ৩৫ শতাংশের পরিবর্তে কম হারে (১০ শতাংশ /২০ শতাংশ /৩০ শতাংশ) হতে পারে। সেক্ষেত্রে আয়কর ও সারসার্জের মোট হার নীট সম্পদের ভিত্তিতে ২০.২৫ শতাংশ থেকে আরো কম হবে।

স্বাভাবিক ব্যক্তি করদাতাসহ অন্যান্য সব করদাতার ১ জুলাই ২০২৪ থেকে ৩০ জুন ২০২৫ সময়কালে (করবর্ষ-২০২৫-২০২৬), স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সিকিউরিটিজ লেনদেন থেকে ৫০ লাখ টাকার অধিক অর্জিত মূলধনী মুনাফার ওপর প্রদেয় আয়কর ও সারচার্জ বাবদ সর্বোচ্চ করের হার ৪০.৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০.২৫ শতাংশ করায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন মর্মে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড মনে করে।

গত ৪ নভেম্বর অর্জিত মূলধনী মুনাফার ওপর কর হার কমাতেই লেনদেন চলাকালে এই খবর ছড়িয়ে পড়লে ঐদিনই ৬১ পয়েন্ট সূচক বাড়ে। এর ফলে একদিনের ব্যবধানে ডিএসইর বাজার মূলধন বাড়ে ৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

গত ২৮ অক্টোবরের সাত কর্মদিবসে ডিএসইর প্রধান সূচক ৪৪৮ পয়েন্ট, শরিয়াহ সূচক ডিএসইএস ১০৫ পয়েন্ট এবং মূলধনী সূচক ডিএস-৩০ এর ১৬১ পয়েন্ট বাড়ে। সাতদিনে ডিএসইর গড় লেনদেন হয় সাড়ে পাঁচশ কোটি টাকার বেশি। আলোচ্য সময়ে ডিএসইর বাজার মূলধন বেড়েছে ২৮ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকা।

সর্বশেষ মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স অবস্থান করছে ৫ হাজার ২৯৮ পয়েন্টে, ডিএসইর শরিয়াহ সূচক ডিএসইএস ১ হাজার ১৮৩ পয়েন্ট এবং ডিএস-৩০ সূচক ১ হাজার ৯৭০ পয়েন্টে অবস্থান করছে।

আজ ডিএসইতে ৫৭৭ কোটি ৬৬ লাখ ০৭ হাজার টাকার শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয়েছে ৫৭৬ কোটি ৫৬ লাখ ৭৬ হজার টাকা।

এদিন ডিএসইতে মোট ৪০০টি কোম্পানির শেয়ার ও ইউনিট লেনদেন হয়েছে। লেনদেনে অংশ নেয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দর বেড়েছে ১৩৬টির, বিপরীতে ২১৬ কোম্পানির দর কমেছে। পাশাপাশি ৪৮টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দর অপরিবর্তিত রয়েছে।

ডিএসইর বাজার মূলধন রয়েছে ৬ লাখ ৭২ হাজার ২ কোটি ৪৩ লাখ ৮৯ হাজার টাকা।

BBS cable ad