অস্তিত্ব সংকটে সিলেটের নদনদী

এ এস রায়হান (সিলেট) :
পানি প্রবাহ স্বল্পতায় অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে সিলেটের অনেক নদনদী। দখল, দূষণ ও ভরাটে মরতে বসা এসব নদনদী পাথর ও বালু উত্তোলনেও হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্থ। নদী খেকোদের দখলে থাকা স্থাপনা উচ্ছেদ, খনন না করা ও দূষণ থেকে নদী রক্ষা করতে না পারায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদীরা।
সরকারি হিসাব বলছে, সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা কুশিয়ারাসহ ৮টি নদীর প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার তীর নদী খেকোদের দখলে রয়েছে। দখলের সঙ্গে শতাধিক ব্যাক্তি ও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান জড়িত। বাস্তবে এ সংখ্যা হাজারের বেশি। দখলবাজরা শুধু নদীর দুই পাড় দখল করেই ক্ষান্ত হয়নি। তারা প্রবাহমান নদীর পানিতে বাঁশ-কাঠের মাচা তুলে বানিয়েছে ঘরবাড়ি-দোকানপাট। নদীর তীর কেটে বালু ও মাটি উত্তোলন করে লুটে নিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া স্থানীয় প্রভাবশালীরা বিভিন্নভাবে গিলে খাচ্ছে এক সময়ের প্রমত্তা নদীগুলো।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, অবৈধ দখলদারদের দখলে নদীর তীর। নদীর অভিভাবকদের চরম উদাসীনতার কারণে নদীগুলো অস্থিত্ব সংকটে রয়েছে বলে দাবি তাদের। নদীকে বাঁচাতে এসব দখলদারদের উচ্ছেদ করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
উদ্ধার তৎপরতা
দখল হওয়া এসব নদীর তীর উদ্ধার তৎপরতা নেই। গত দুই বছরে সিলেট সিটি কর্পোরেশন এলাকায় সুরমা নদীর তীর দখল করা ২৪ জন ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এর বাইরে দুই একটি জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান চললেও জেলার বিভিন্ন উপজেলায় নিশ্চুপ প্রশাসন। নদী রক্ষায় সরকারের কোনো ভ্রæক্ষেপ নেই বলে দাবি পরিবেশবাদীদের।
সেভ দ্য এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হেরিটেজ এর প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হাই আল হাদী বলেন, নদীর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে প্রশাসনের চরম উদাসীনতা রয়েছে। শুধু মাত্র সিটি কর্পোরেশন এলাকা ছাড়া এর বাইরে কোনো অভিযান হয় না। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন নদীর অবৈধদখলদারদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তা সঠিক নয়। এর বাইরে অনেক দখলদার রয়েছে। প্রতিটি নদীর পরিদর্শন করে এই তালিকা প্রকাশ করা দরকার।
সুরমা রিভার ওয়াটার কিপার আব্দুল করিম কিম বলেন, সুরমা নদীতে পানির প্রবাহ কম থাকার কারণে প্রচুর চর পড়ে আছে। অপরিকল্পিতভাবে নদী খননের কারণেই এই চরগুলো পড়ছে। নদী খননের পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে যেভাবে বালু উত্তোলন করা হয় তার কারণেও চর পড়ছে। যেভাবে বালু মহাল থেকে বালু উত্তোলনের কথা সেভাবে না তুলে সুবিধামত স্থান থেকে বালু তুলার কারণেই মূলত এসব চর পড়ছে। ফলে সুরমার অবস্থা এখন এমন মনে হবে; নদীর মাঝখানে বিশাল একটি খেলার মাঠ হয়ে আছে।
নদী দখলের চিত্র:
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, সিটি কর্পোরেশন এলাকায় সুরমা নদীর ৪৫০ মিটার জায়গা ২৩ জন অবৈধ দখলদারের দখলে রয়েছে। তারা নদী তীরবর্তী স্থানে গড়ে তুলেছেন ৭২টি স্থাপনা। ২০১৯ সালের নভেম্বরে তাদেরকে উচ্ছেদ করা হলেও সরেজমিনে দেখা গেছে উচ্ছেদ হওয়া স্থান ফের দখলে নিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয়রা।
কানাইঘাট বাজারে সুরমা নদীর ২৫০ মিটার দখল করে রেখেছেন স্থানীয় ৬ জন নদী খেকো। সেখানে ২৩টি অবৈধ স্থাপনা গড়ে তুলেছেন তারা। এছাড়া ওই উপজেলার গাছবাড়ি এলাকায় সুরমা নদীর ৩০০ মিটার অবৈধ দখলদারদের দখলে রয়েছে। একই উপজেলার গাছবাড়ি এলাকায় সুরমার ৩০০ মিটার দখল করে স্থাপনা নির্মান করেছেন ২৫ নদীখেকো।
বালাগঞ্জে এ নদীটির ২৫০ জায়গা দখল করে অবৈধভাবে ২০টি স্থাপনা গড়ে তুলেছেন স্থানীয় ২০জন নদী খেকো। এছাড়া এই উপজেলায় শাহজালাল ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি ও কুশিয়ারা পাওয়ার প্ল্যান্ট নদীটির ১০ মিটার জায়গায় তাদের স্থাপনা নির্মাণ করে দখলে রেখেছে। গোলাপগঞ্জ উপজেলার বুধবারবাজার এলাকায় কুশিয়ারা ৩০০ মিটার তীর দখল করে ২০টি স্থাপনা নির্মাণ করে দখলে রেখেছেন স্থানীয় চন্দরপুর এলাকার ১৭ জন দখলবাজ। ফেঞ্চুগঞ্জে কুশিয়ারার ৯০০ মিটার তীর দখল করে ৩৫ টি পাকা, আধা পাকা ও টিনশেডের ঘর নির্মাণ করে দখলে রেখেছে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
এছাড়া গোয়াইনঘাট উপজেলায় গোয়াইন নদীর ১০০ মিটার দখল করে ৪টি স্থাপনা গড়ে তুলা হয়েছে। এসব জায়গা দখল করে স্থাপনা গড়ে তুলেছে খোদ উপজেলা পরিষদ।
সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার সিঙ্গেরকাচ বাজারে এই নদীটির ৬০ মিটার তীর দখল করে ১২টি ্স্থাপনা নির্মাণ করে দখলে রেখেছে ব্যবসায়ীরা। লামাটুকেরবাজার এলাকায় নদীটির আরো ১০ মিটার জায়গায় অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে ৩টি স্থাপনা।
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার মোহাম্মদপুর বাজারে মাকুন্দার ৪০ মিটার জায়গাও দখল করে ৯ টি স্থাপনা তৈরি করে দখলে ভোগ করে আসছেন ব্যবসায়ীরা।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার এই নদীটির ৪০০ মিটার জায়গায় রয়েছে পাকা-আধা পাকা ও টিনশেডের ৩৫টি৫ স্থপনা। এই নদীটির দখলদারদের চিহ্নত করতে পারেনি পাউবো।
পাথররাজ্য খ্যাত সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার এই মরা ধলাই নদিটির ৪০০ মিটার অবৈধ দখলদারদের দখলে। সেখানে পাকা ঘর ও দোকান কোটাসহ ৩৫টি স্থপনা নির্মাণ করে রেখেছেন স্থানীয়রা। এই দখলদরদের নাম চিহ্নিত করতে পারেনি পাউবো। তবে স্থানীয়দের তথ্য মতে এই নদীটি প্রায় নিশ্চিহ্ন।
প্রায় ১৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই নদীটি দখল-ভরাটে একেবারে নিশ্চিহ্ন। তবে পাউবোর তথ্য মতে, এই নদীটি ৪০ মিটার জায়গা দখল করে পাকা ঘর টিনশেডের দোকানসহ ১৯টি স্থপনা নির্মাণ করা হয়েছে। তবে স্থানীয়রা বলছেন, দখল, দুষণ ও ভরাটে এই নদীর অস্থিত্বই নেই।
সিলেটের পাথর রাজ্য কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার আরেকটি খাল সূর্যখালী খালও রয়েছে নদী খেকোদের দখলে। এই খালের ৩০০ মিটার জায়গা দখল করে ২৫টি স্থাপনা নির্মাণ করে রেখেছেন স্থানীয়রা। পাউবো এসব দখলদারদের তথ্য খুজে পায়নি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, নদীর অবৈধদখলদারদের উচ্ছেদে সবসময়ই অভিযান চলে। সরকার যখন কোনো সিদ্ধান্ত নেয় তখন সরকারের বিপক্ষে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দাঁড়াতে পারে না। নদীর দখলদার অনেকভাবে, অনেক জায়গাতেই তদবির করেছে। কিন্তু যখন তারা বুঝতে পেরেছে এটা সরকারি সিদ্ধান্ত তখন তারা নিজ উদ্যোগেই এসব স্থাপনা সরিয়ে নিয়েছে। এমনকি আমরা যখন উচ্ছেদ অভিযানে যাই তখন আমরা কোনো বাঁধার সম্মুখীন হইনি।
নদীর তীরবর্তী স্থানে কখনো বাজার বা স্থাপনা গড়ে তুলতে পারবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, নদীর তীরে এমনভাবে কিছু ওয়াকওয়ে তৈরি করা উচিত যাতে করে এসবস্থান যাতে কেউ দখল করতে না পারে। একেকটা উচ্ছেদ অভিযানের ব্যয়ও প্রচুর। কেউ যখন দখল করে কোনো স্থাপনা তৈরি করে সেই স্থাপনা ভাঙতেও সরকারের প্রচুর টাকা খরচ হয়। এজন্য সবাইকে সচেতন হওয়ার আহবান জানান তিনি।
সিলেটের জেলা প্রশাসক এম কাজী এমদাদুল ইসলাম বলেন, নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনও গঠন করা হয়েছে। নদীগুলো যাতে দখলমুক্ত থাকে সেই ব্যাপারে এই কমিশন বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে থাকে। সে মোতাবেক আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিনি এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। অবৈধভাবে দখল যাতে না হয় সেই বিষয়ে সরকারের নির্দেশনা আছে। পাশাপাশি উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও রয়েছে। নদীতে চর পড়বে এটা একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে আমাদের দেখতে হবে এই চর পড়ার কারণে চলাচলে সমস্যা হচ্ছে কি না সেটা দেখার বিষয়। সরকার কর্তৃক অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে।