আইইডিসিআর সমীক্ষা নদীর পানিতে মলের জীবাণু ছড়িয়ে পড়ছে ডায়রিয়া
মোঃ রাজু খান (ঝালকাঠি):
বর্তমানে বাংলাদেশের শহর-গ্রামের ৯৪ শতাংশ লোক গভীর নলকূপের পানি পান করলেও ৭১ শতাংশ মানুষ দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজে নদী অথবা খালের পানি ব্যবহার করে। পানিতে মলের জীবানু ছড়িয়ে পড়ায় ডায়রিয়া আক্রান্তের সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। উপকূলীয় জেলাগুলোতে এর প্রভাব বেশি পড়ছে বলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সমীক্ষায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একটি প্রতিনিধিদল উপকূলীয় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডায়রিয়া রোগীদের তালিকা ধরে সমীক্ষা চালায়।
সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, সমীক্ষাভুক্ত এলাকায় মাত্র ২০ শতাংশ বাড়িতে গভীর নলকূপ আছে। প্রতিষ্ঠানটি সমুদ্য উপকূলীয় জেলা বরগুনাসহ বিভিন্ন উপকূলীয় স্থানের খালের পানির নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকার জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ল্যাবে পরীক্ষা করে খালের পানিতে মলের জীবাণুর উপস্থিতি পেয়েছে। ২০ জন রোগীর মল পরীক্ষায় তিনজনের মলে কলেরা ও ইকোলাই জীবাণুর উপস্থিতি পাওয়ার বিষয়টি সমীক্ষায় প্রকাশ পায়।
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো ওই প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছে। এর মধ্যে খাওয়ার ও গৃহস্থালি কাজে নিরাপদ পানি ব্যবহার নিশ্চিত করা, ঝঁুকিপূর্ণ এলাকায় জরুরি ভিত্তিতে গভীর নলকূপের সংখ্যা বাড়ানো, খাল–নদীর পানি ফুটিয়ে অথবা বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়ে পানি নিরাপদ করে ব্যবহার করা ও স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ উল্লেখযোগ্য।
আইইডিসিআরের প্রতিবেদনের সত্যতা নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে আইইডিসিআরের সুপারিশমালা বাস্তবায়নের জন্য অনুরোধ করে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে একটি চিঠি দিয়েছি।’
এদিকে ডায়রিয়া পরিস্থিতির দিনের পর দিন অবনতি হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে আইইডিসিআর আরেকটি প্রতিনিধিদল গত সোমবার (১৯এপ্রিল) ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদলটি বরিশালের বিভিন্ন হাসপাতাল ও উপকূলীয় জেলা-উপজেলা পরিদর্শন করেন। এসময় ঘুরে ঘুরে রোগীদের মল, বিভিন্ন উৎসের পানির নমুনা সংগ্রহের পাশাপাশি স্বাস্থ্য সচেতনতায় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা করছে।
আইইডিসিআরের তিনজন রোগতত্ত্ববিদ (চিকিৎসক) ও তিনজন কারিগরি সহায়ক এই দলের অন্তর্ভূক্ত আছেন। দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন রোগতত্ত্ববিদ জাহিদুর রহমান। প্রতিনিধিদলের সদস্য রোগতত্ত্ববিদ সুব্রত মালাকার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা নমুনা সংগ্রহ করে সেগুলো ঢাকায় পরীক্ষা নিরীক্ষার পর বোঝা যাবে। ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ার প্রকৃত কারণ তথ্য বিশ্লেষণ করলে বেরিয়ে আসবে।’
প্রতিনিধিদলের অপর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ অঞ্চলের মানুষের একটি নেতিবাচক প্রবণতা হলো দৈনন্দিন কাজে খালের পানি ব্যবহার করা। বিশেষ করে সকালে ভাতের সঙ্গে খালের পানি মিশিয়ে খাওয়ার অভ্যাস আছে। ধারণা করা হচ্ছে, তীব্র গরমের কারণে পানি বাহিত এই রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মন্ডল বলেন, বুধবার ২৪ ঘণ্টায় বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় আরো ১ হাজার ৫২৪ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত বরিশাল বিভাগে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩৩ হাজার ৬৬৮। এর মধ্যে গত ২৩ মার্চ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ১৮ হাজার ৬২২ জন। আর গত ৭ দিনে আক্রান্ত হয়েছে ৮ হাজার ৭৭৯ জন।
স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, বিভাগে দুই সপ্তাহে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে আটজনের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, মৃতের সংখ্যা ২৭। তারা আরো বলছেন, হাসপাতালে ও বাড়িতে মৃত্যুর তথ্যগুলো সংগ্রহ করে পূর্ণাঙ্গ ডেটাবেইস তৈরির কাজ চলছে। এ জন্য জেলা ও উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ কাজ করছে।
ঝালকাঠি স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, করোনার মধ্যে তীব্র গরমে হঠাৎ করে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে ডায়রিয়া আক্রান্তের সংখ্যা। গত এক সপ্তাহে জেলায় প্রায় ৩হাজার মানুষ ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় দুই হাজার মানুষ। হাসপাতালের নির্দিষ্ট বিছানায় স্থান না পেয়ে গাদাগাদি করে ফ্লোরে বিছানা পেতে শুয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে আক্রান্তদের।
সিভিল সার্জন ডা. রতন কুমার ঢালী জানান, বর্তমানে পর্যাপ্ত স্যালাইন থাকায় রোগীদের চিকিৎসায় এখন আর কোন বেগ পেতে হচ্ছে না। তবে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এতোটাই বেশি যার কারণে দায়িত্বরত চিকিৎসক ও নার্স সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। একদিকে করোনা মহামারির সংক্রমণ বৃদ্ধি অপরদিকে ডায়রিয়া আক্রান্তের সংখ্যাও অনেক বেশি। সবমিলিয়ে জীবনের ঝুকি নিয়ে রোগীদের নিরলস সেবা দিয়ে যাচ্ছি বলেও জানান সিভিল সার্জন।