১০ ব্যাংকে অস্থিরতা, মালিকানা নিয়ে চরম দ্বন্দ্ব শুরু
ব্যাংকে ব্যাংকে দেখা দিয়েছে চরম অস্থিরতা। মালিকানা দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে এখন ব্যাংক পাড়ায় প্রতিদিই বিরাজ করছে উত্তেজনা। বিদায়ি শেখ হাসিনা সরকারের আমলে এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপের মালিকসহ আরও সরকারঘেঁষা ব্যবসায়ীরা যেসব ব্যাংক জবরদখল করেছিল এখন সেগুলোতে মালিকানা বদলের সুর উঠেছে।
মালিকানা বদলের দাবিতে এখন ৮ থেকে ১০টি ব্যাংকের সামনে আন্দোলন করছেন ব্যাংকগুলোর কর্মীরা। এস আলম গ্রুপের লোকজন গতকাল ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে প্রবেশ করতে গেলে এলোপাতাড়ি গোলাগুলির ঘটনাও ঘটে এবং ছয়জন কর্মী আহত হন। এ ছাড়া অন্যান্য ব্যাংকের সামনে মানববন্ধনসহ নানা রকম কর্মসূচি পালন করছেন ব্যাংকাররা। এই পরিস্থিতিতে আগে থেকে চলে আসা ব্যাংকিং খাতের নানা রকম সংকটের সঙ্গে চলমান অস্থিরতার সংকট যোগ হওয়ায় পুরো ব্যাংক খাতেই এখন ভঙ্গুর দশা দেখা দিয়েছে।
এদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের পদত্যাগ ও ডেপুটি গভর্নরদের বের হয়ে যাওয়াকে ঘিরে বাংলাদেশ ব্যাংকে যে সংকট দেখা দিয়েছে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের পুরো ব্যাংকিং খাতে। এ অবস্থায় প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক খাতের চলমান সংকট নিরসনে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সময়ের আলোকে বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের ফলে দেশে এখন একটি বিশেষ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ অবস্থায় হুট করেই হয়তো সব সংকট দূর করা যাবে না, তবে ব্যাংকসহ পুরো আর্থিক খাতে যাতে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে-নতুন সরকারকে সেদিকটিতে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা সবাই জানি, বিদায়ি সরকারের আমলে দেশের ব্যাংকিং খাতের সর্বনাশ করা হয়েছে। ব্যাংকিং রীতিনীতি, ব্যাংকের কার্যকলাপ-এক কথায় পুরো ব্যাংক খাতের অনেক ক্ষতি করা হয়েছে। এ অবস্থার অবসান যেমন ঘটাতে হবে নতুন সরকারকে, ঠিক তেমনি এখন মালিকানা নিয়ে যে দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে সেটিও দ্রুত সমাধান করতে হবে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অচলাবস্থারও দ্রুত অবসান করতে হবে।’
মূলত সরকার পতনের পর দেশের ব্যাংক খাতে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে। অন্তত ৮টি বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতেও হট্টগোল হচ্ছে। গভর্নরসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতিতে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকেও শৃঙ্খলা ফেরেনি। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অভিভাবকশূন্য হয়ে যাওয়ার কারণেই ব্যাংক খাতে এতটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি), আইএফআইসি ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকে বিশৃঙ্খলা হয়েছে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ মুনিরুল মওলাকে দাফতরিক কাজে বাধা দেওয়া হয়েছে। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের দুজন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (ডিএমডি) জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। বিক্ষোভ ও মানববন্ধন হয়েছে ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সামনে। ন্যাশনাল ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন কিংবা নতুন পরিচালক অন্তর্ভুক্তির দাবি উঠেছে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক নির্বাহীরা বলছেন, সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে দেশের ব্যাংক খাতের অবস্থা এমনিতেই নাজুক। ঋণের নামে অর্থ লোপাটের কারণে বেশিরভাগ ব্যাংকের ভিত একেবারেই দুর্বল হয়ে গেছে। এখন সময় হলো ব্যাংক খাতকে টেনে তোলার। কিন্তু যে বিশৃঙ্খলা দেখা যাচ্ছে, সেটি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠবে। আতঙ্কিত গ্রাহক আমানতের টাকা তুলে নিতে শুরু করলে দেশের অনেক ব্যাংকই দেউলিয়া হয়ে যাবে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনার পাশাপাশি নতুন সরকারের প্রধান দায়িত্ব হবে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো।
বিক্ষোভে যোগ দেওয়া কর্মকর্তাদের দাবি হলো, ২০১৬ সালে মালিকানা পরিবর্তনের পর ইসলামী ব্যাংকের সৎ ও দক্ষ অনেক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। বিপরীতে দ্রুত পদোন্নতি পেয়েছেন ব্যাংকের অর্থ লোপাটের সহযোগীরা। এখন সেসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে ব্যাংকে আর চাকরি করতে দেওয়া হবে না। আবার ২০১৬ সাল থেকে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদেরও আর ব্যাংকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।
সালমান এফ রহমানের পদত্যাগের দাবিতে আইএফআইসির কর্মীদের বিক্ষোভ : বেসরকারি আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ও তার ছেলেসহ বেক্সিমকো গ্রুপের প্রতিনিধিত্বকারী সব পরিচালকের পদত্যাগ দাবি করেছেন ব্যাংকটির চাকরিচ্যুত কর্মকর্তারা। একই সঙ্গে সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহ এ সরোয়ারের সময়ে ‘অন্যায়ভাবে’ যাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, তাদের পুনর্বহালের দাবি তোলা হয়েছে। রাজধানীর দৈনিক বাংলা মোড়ে অবস্থিত ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে গতকাল রোববার দুই শতাধিক লোক ‘আইএফআইসি ব্যাংকের চাকরিচ্যুত সকল কর্মকর্তাবৃন্দ’-এই ব্যানারে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন।
সালমান এফ রহমান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। একই সঙ্গে তিনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তাকে কোথাও প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তার ছেলে আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমান আইএফআইসি ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান।
বিক্ষোভকারীরা অভিযোগ করেন, আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন সাবেক এমডি শাহ এ সরোয়ার, যিনি বর্তমানে ব্যাংকটির উপদেষ্টা। শাহ এ সরোয়ার ‘মানসিক চাপ সৃষ্টি করে’ অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরি থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করছেন।
বিক্ষোভে যারা অংশ নিয়েছেন, তাদের পক্ষ থেকে ৯ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। এসব দাবির মধ্যে রয়েছে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, তাদের অবিলম্বে পুনর্বহাল করা। তবে যারা ইতিমধ্যে চাকরির বয়স অতিক্রম করেছেন তাদের পদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধিসহ পাওনা পরিশোধ করতে হবে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এস আলমমুক্ত করতে মানববন্ধন : বেসরকারি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংককে (এসআইবিএল) এস আলম গ্রুপের হাত থেকে মুক্ত করতে মানববন্ধন করেছে ব্যাংকটির কিছু শেয়ারধারী। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধনের পর এক সংবাদ সম্মেলনে তারা অভিযোগ করেন, এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম ও তার সহযোগীরা আমানতকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা নামে-বেনামে তুলে পাচার করেছেন। ফলে শুধু এসআইবিএল নয়, পুরো আর্থিক খাতই হুমকির মুখে পড়েছে। সাধারণ আমানতকারীরা জমাকৃত অর্থ প্রয়োজন অনুযায়ী তুলতেন পারছেন না।
মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল হক, সাবেক পরিচালক আনিসুল হক, আসাদুজ্জামান, সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, আবদুর রহমান, আবুল বসর ভূঁইয়াসহ সাধারণ ও উদ্যোক্তা শেয়ারধারীরা।
জানা যায়, ২০১৭ সালে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের মালিকানায় আসে চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ। ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান বেলাল আহমেদ, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের জামাতা। মালিকানা পরিবর্তনের সময় বাদ পড়েন ব্যাংকটির কয়েকজন উদ্যোক্তা ও পরিচালক। এরপর ব্যাংকটি থেকে নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ টাকা বের করা এবং চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের পটিয়ার বাসিন্দাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে ব্যাংকটি ইতিমধ্যে আর্থিক সংকটে পড়েছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে রক্ষিত চলতি হিসাবেও ঘাটতিতে রয়েছে। গতকালের মানববন্ধনে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে এস আলম গ্রুপের ‘কবল থেকে দখলমুক্ত’ করে প্রকৃত মালিক ও প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তাদের কাছে ব্যাংকটির মালিকানা হস্তান্তরের দাবি জানানো হয়।
ইসলামী ব্যাংকে গোলাগুলি : রাজধানীর দিলকুশায় অবস্থিত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের প্রধান কার্যালয়ের বাইরে গুলির ঘটনা ঘটেছে। রোববার সকালে এ ঘটনার সময় ২০১৭ সালের আগে ব্যাংকে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং এর পরে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। গুলিতে ছয়জন আহত হয়েছে। গুরুতর একজনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
এদিকে ইসলামী ব্যাংকের দখল নিয়ে গোলাগুলিতে যারা জড়িত তাদের ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেন, ইসলামী ব্যাংকের এ ঘটনার বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথা বলা হবে। যারা দোষী, তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগে মতবিনিময় সভার পর দুপুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে অর্থ উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।
ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতি রোধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের দাবি : এদিকে ব্যাংকিং খাত সংস্কারের লক্ষ্যে রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থ পাচার, ঋণখেলাপি ও দুর্নীতি রোধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল। রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক অফিসার্স ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তানভীর আহমেদ এবং সাধারণ সম্পাদক এ কে এম মাসুম বিল্লাহর স্বাক্ষর করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানানো হয়েছে।
তারা বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সমগ্র ব্যাংকিং এবং আর্থিক খাতের সংস্কারের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে কাউন্সিল তার এ প্রত্যয়ের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সমগ্র ব্যাংকিং সেক্টর সংস্কারের জোর দাবি জানাচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি ব্যাংকিং তথা আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন জরুরি।
নতুন ডেপুটি গভর্নর খুঁজতে সার্চ কমিটি গঠন-অর্থ মন্ত্রণালয় : এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলমান সংকট দূর করার উদ্যোগ নেওয়া শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। গতকাল এক প্রজ্ঞাপনে গভর্নরের দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহারকে। একই সঙ্গে অন্য ডেপুটি গভর্নরদেরও দায়িত্ব চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
আরেক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন ডেপুটি গভর্নর খুঁজতে ৩ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। সার্চ কমিটির সদস্যরা হলেন-ড. আহসান এইচ মনসুর, মুসলিম চৌধুরী ও নজরুল ইসলাম।