চরাঞ্চলবাসীকে দেখাতেন স্বপ্ন, ১২’শ কোটি টাকা ঋণ রেখে উধাও রিপন
গাইবান্ধার ফুলছড়ি-সাঘাটা উপজেলার দুই–তৃতীয়াংশ চরাঞ্চল। এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেকটা অনুন্নত। শুকনা মৌসুমে চারদিকে ধু ধু বালুচর। বর্ষা মৌসুমে থইথই পানি। তবে ওই এলাকার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখাতেন রিপন। এখন তিনি পলাতক। ঋণ রেখে গেছেন ১ হাজার ২০৯ কোটি টাকা। বলছি, গাইবান্ধা–৫ (ফুলছড়ি–সাঘাটা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাহমুদ হাসান রিপনের কথা।
রিপন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ছিলেন। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার আগে পর্যন্ত বেশ দাপুটে সংসদ সদস্য হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। কিন্তু ৫ আগস্টে আত্মগোপনে যাওয়ার পর ঋণখেলাপিসহ একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ আসতে শুরু করেছে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রিপন এলাকায় উন্নয়নের স্বপ্ন দেখিয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এ আসনের (ফুলছড়ি–সাঘাটা) উপজেলা দুই–তৃতীয়াংশ চরাঞ্চল। এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেকটা অনুন্নত। শুকনা মৌসুমে চারদিকে ধু ধু বালুচর। বর্ষা মৌসুমে থইথই পানি। কৃষি, শিক্ষা, অবকাঠামো উন্নয়নে অন্যান্য উপজেলার চেয়ে অনেক পিছিয়ে ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলা।
দীর্ঘদিন ধরে ওই আসনটিতে (গাইবান্ধা-৫) আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি ছিলেন অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী। তখন থেকে মাহমুদ হাসান রিপন আলাদা করে দলীয় বিভিন্ন প্রোগ্রাম করতেন। উন্নয়নের বাণী শোনাতেন জনগণকে। তবে তিনি এমপি না হওয়ার কারণে এলাকার মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে বলে জানাতেন। ফজলে রাব্বী মারা যাওয়ার পর উপনির্বাচনে ওই আসন থেকে আওয়ামী লীগের টিকিট পেয়ে নির্বাচিত হন রিপন।
ছয় মাসের অল্প সময়ে এমপি হয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকা উন্নয়নের জন্য বাজেট পেয়েছেন বলে জানান এলাকায়। কাজগুলো বাস্তবায়নে সময় লাগবে আশ্বাস দিয়ে দ্বাদশ নির্বাচনে আবারও বিজয়ী হন তিনি। তবে এলাকার জন্য কাজ করেননি সাবেক এ ছাত্রলীগ নেতা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা থেকে জানা যায়, নির্ভরশীল ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের এসএম স্পিনিং মিলস লিমিটেডে ১ শতাংশ, এসএম নিটওয়্যারস লিমিটেডে ২ দশমিক ৪৮ এবং মায়ার লিমিটেডে ৬৫ শতাংশ শেয়ার দেখিয়ে মাহমুদ হাসান রিপন ইসলামী ব্যাংক থেকে ৭ কোটি ৯৬ লাখ ৫৭ হাজার ৬২৮ টাকা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকে ২০ কোটি ২ লাখ ৩১ হাজার ৯৩৮, ডাচ্–বাংলা ব্যাংকে ৩৭৩ কোটি ১০ লাখ ২৬ হাজার ৭৬৪, ইস্টার্ন ব্যাংকে ২০৬ কোটি ৫১ লাখ ৪ হাজার ৯৪৫, যমুনা ব্যাংকে ৩০ কোটি ৮৭ লাখ ৫৪ হাজার ৭৭১, সিটি ব্যাংকে ৪৯ কোটি ৫ লাখ ১১ হাজার ৫৪৩, ব্যাংক এশিয়ায় ৭২ কোটি ৯ লাখ ১৩ হাজার ৮৯০, ব্র্যাক ব্যাংকে ৭৮ কোটি ৮০ লাখ ২৭ হাজার ৪৭৬ টাকা ঋণ নিয়েছেন।
এ ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, ম্যানেজিং ডিরেক্টর বা ডিরেক্টর হওয়ার সুবাদে এসএম স্পিনিং মিলস লিমিটেডের ৩ শতাংশের শেয়ারহোল্ডার দেখিয়ে, ইস্টার্ন ব্যাংক ৬১ কোটি ৪০ লাখ ৭৭ হাজার ৯৭৩ টাকা, সিটি ব্যাংকে ৪৯ কোটি ৫ লাখ ১১ হাজার ৫৪৩, ব্র্যাক ব্যাংকে ৭৮ কোটি ৮০ লাখ ২৭ হাজার ৪৭৬, ব্যাংক এশিয়া ৭২ কোটি ৯ লাখ ১৩ হাজার ৮৯০, ডাচ্–বাংলা ব্যাংক ১০৩ কোটি ৯৭ লাখ ২৫২ টাকা ঋণ নেন রিপন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে শীর্ষ ১০ ঋণ ও দায়গ্রস্ত ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেছে। এর মধ্য সর্বোচ্চ ঋণগ্রস্ত প্রার্থী এস এ কে একরামুজ্জামান। তাঁর ঋণ ও দায় ২ হাজার ৫৩৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। আর মাহমুদ হাসান রিপনের ঋণ ও দায় ১ হাজার ২০৯ কোটি ১৭ লাখ টাকা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া–১ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা একরামুজ্জামান আবার রিপনের শ্বশুর।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মাহমুদ হাসানও আত্মগোপনে গেছেন। এখন এসব ঋণ আদায় অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। আত্মগোপনে গেলেও রিপন ও তার ব্যক্তিগত সহকারী তারেক ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলে জানা যায়। তবে তারা কেউই এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি।
মাহমুদ হাসান রিপনের ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা নিজেরাই এখন বিপদে আছেন। নেতাকর্মীদের রেখে এভাবে তিনি পালিয়ে যাবেন, তা তারা ভাবতে পারেননি।
ফুলছড়ি উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাদেকুল ইসলাম নান্নু জানান, গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দেশের সব ব্যাংক লুট করেছেন। ব্যাংকগুলো থেকে নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করেছেন। রিপনকে দ্রুত গ্রেফতার করে ঋণ আদায়ের ব্যবস্থার দাবি জানান তিনি।