১৩ দিনে ই-কমার্সে ক্ষতি ১৭৫০ কোটি টাকা
দেশজুড়ে সম্প্রতি ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলন দমাতে সাবেক আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করাসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে নেয়। এতে করে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ১০ দিন ও ফেসবুক বন্ধ ছিল ১৩ দিন। ইন্টারনেটের এই পরিষেবা বন্ধ থাকার কারণে এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশের ই-কমার্স ব্যবসায়। ই-কমার্স ব্যবসার সব খাত-উপখাতই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন এফ কমার্সভিত্তিক উদ্যোক্তা, অনলাইন শপভিত্তিক উদ্যোক্তা এবং মার্কেট প্লেসভিত্তিক ই-টুরিজম ই-কমার্স উদ্যোক্তারা। এই সময়ে তাদের শত শত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) মতে, ইন্টারনেট বন্ধ থাকা ও গতি কম থাকার ঐ ১৩ দিনে এই খাতে প্রায় ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
ই-ক্যাবের সাবেক সভাপতি শমী কায়সার ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, ইন্টারনেট বন্ধের কারণে প্রত্যক্ষভাবে প্রথম ১০ দিনে দৈনিক ১২০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। এতে ১০ দিনে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশ এফ-কমার্স খাতে ৬০০ কোটি টাকা, ই-ট্যুরিজম খাতে ৩০০ কোটি টাকা এবং ই-লজিস্টিক খাতে ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে অনলাইন শপ, মার্কেট প্লেস, সার্ভিস পোর্টাল, ই-লার্নিং ও ডিজিটাল প্রোডাক্টস খাতে।
তিনি আরো বলেন, ইন্টারনেট বন্ধের কারণে পরোক্ষভাবেও বড় ক্ষতি হয়েছে। এ ক্ষতি সাময়িকভাবে হয়তো চোখে পড়বে না। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ব্যবসা থমকে গেছে। এটাকে আমরা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হিসেবে ধরে নিয়েছি।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) মতে, ইন্টারনেট বন্ধ থাকা ও গতি কম থাকার ঐ ১৩ দিনে এই খাতে প্রায় ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
শমী কায়সার বলেন, বর্তমানে দেশে ৫ লাখের বেশি ফেসবুক উদ্যোক্তা আছেন। কয়েক লাখ ই-কমার্স কর্মী মিলে সরবরাহকারী ও সহযোগী ব্যবসাসহ এ খাতের ওপর নির্ভরশীল প্রায় ২০ লাখ মানুষ। প্রতি বছর এ খাতে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ২৫ শতাংশের মতো।
ই-কমার্স ব্যবসার বড় ক্ষতির বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আলোচিত হচ্ছে। অনলাইনে শাড়ি বিক্রি করে থাকে জামদানি শাড়ি ডিক্লাটার নামে একটি গ্রুপ। এই গ্রুপের অনেকেই বলছেন, ইন্টরনেট বন্ধ থাকায় তাদের যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে সরকারের পক্ষ থেকে যেন উদ্যোগ নেয়া হয়। এতে তাদের ক্ষতি সামান্য পরিমাণ হলেও কমাতে সহযোগিতা করবে।
নারায়ণগঞ্জের মিঠু জামদানি শাড়ি’র স্বত্তাধিকারী মোহাম্মদ মিঠু বলেন, ইন্টরনেট বন্ধ থাকায় তাদের প্রায় ১০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে অনেকেই শাড়ি নেয়ার জন্য মেসেঞ্জারে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ করেছেন এবং শাড়ির ছবিও দিয়েছেন। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে কাউকে রিপ্লাই দিতে পারিনি। এ সময়ে তাদের অনেক নিয়মিত কাস্টমার অন্যত্র চলে গেছেন।
তিনি বলেন, বর্তমানে সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। আমরা আশা করছি, ভবিষ্যতে ইন্টরনেট বন্ধ করে দেওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটবে না। কারণ, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি আকারের ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তাদের বেশ বেগ পোহাতে হবে।
বর্তমানে দেশে ৫ লাখের বেশি ফেসবুক উদ্যোক্তা আছেন। কয়েক লাখ ই-কমার্স কর্মী মিলে সরবরাহকারী ও সহযোগী ব্যবসাসহ এ খাতের ওপর নির্ভরশীল প্রায় ২০ লাখ মানুষ। প্রতি বছর এ খাতে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ২৫ শতাংশের মতো।
ফ্রিল্যান্সার সাগর বলেন, ইন্টারনেট বন্ধ ও গতি কম থাকার কারণে আমার ৪০৫ ডলারের দুটি অর্ডার স্থগিত হয়েছে। অর্ডার স্থগিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনটি বায়ার আমাকে ফাইভ স্টারের পরিবর্তে নেগেটিভ মার্ক দিয়েছেন। আমার প্রতি মাসে দুই হাজার ডলারের বেশি আয় হয়। ইন্টারনেট বন্ধ ও গতি কম থাকার কারণে ১৩ দিন কোনো কাজই করতে পারিনি।
ফ্রিল্যান্সার সারোয়ার আহমেদ দিন বলেন, ইন্টারনেট ছাড়া ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করা সম্ভব নয়। আমাদের এ সময়ে কাজ একবারে বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের ক্লায়েন্টদের কাজ দিতে না পারায় ক্লায়েন্টরা চলে গেছেন। এতে ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি পড়াশোনার পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং করি। গত এক বছর ধরে কাজ করে যে বিদেশি ক্লায়েন্ট আমি পেয়েছি তা এ সময় ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় চলে গেছে। ঐ ১০ দিন ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় আমি এক বছর পিছিয়ে গেছি।
এফ-কমার্স খাতের এক উদ্যোক্তা বলেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ফেসবুককেন্দ্রিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। আমাদের অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া ও কর্মীদের বেতন দিতে না পারার মতো সংকটে পড়েছেন।
এদিকে অর্থনীতিবিদরা বলেন, আমাদের দেশের ই-কমার্স ব্যবসায়ীরা দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখে। আমাদের দেশের চলমান ডলার সংকট নিরসনে তারা কাজ করছেন। কিন্তু টানা ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে লাখ লাখ ই-কমার্স উদ্যোক্তা তাদের বড় ক্ষতির মুখে পড়েছেন। তাদের ক্লায়েন্ট চলে যাওয়ায় তারা বেকার হয়ে পড়েছেন। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর বড় পড়বে।
এফ-কমার্স খাতে ৬০০ কোটি টাকা, ই-ট্যুরিজম খাতে ৩০০ কোটি টাকা এবং ই-লজিস্টিক খাতে ১০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে অনলাইন শপ, মার্কেট প্লেস, সার্ভিস পোর্টাল, ই-লার্নিং ও ডিজিটাল প্রোডাক্টস খাতে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসের (বেসিস) সভাপতি রাসেল টি আহমেদ বলেন, সামগ্রিকভাকে একটি নতুন পদ্ধতি চালু করা প্রয়োজন। সেই পদ্ধতিতে বিদেশের ক্যাবল কাটা গেলেও যেন দেশের ভেতরে বাণিজ্য বন্ধ না হয়, প্রিপেইড মিটার বন্ধ না হয়, ই-কমার্স বন্ধ না হয়। লোকাল সার্ভিসগুলো ইন্টারনেটের ভেতর দিয়ে যায়। এজন্য নেটওয়ার্ক ডিজাইন ও সেইফ ইন্টারনেট কনফার্ম করতে হবে।
বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির (বিএফডিএস) সভাপতি ডা. তানজীবা রহমান বলেন, আমরা যারা আইটি খাত নিয়ে কাজ করি, তাদের জন্য ইন্টারনেট অপরিহার্য। আমাদের আলাদা একটি হাব থেকে ইন্টারনেট কানেকশন দেওয়া হোক। ফ্রিল্যান্সার আইডি কার্ড হোল্ডার যারা আছেন, তারা সেই হাব থেকে কানেকশন নেবেন। সেই হাবটি যেন কখনো ডাউন করে দেওয়া না হয় সেই ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক।