পাচার হওয়া অর্থের ৭৫% হয়েছে বাণিজ্যের আড়ালে

দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের প্রায় ৭৫ শতাংশই বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে পাচার করা হয়। আমদানি ও রফতানির সময় মিথ্যা ঘোষণা এবং ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে এ বিপুল অর্থ বিদেশে পাচার হয়। গতকাল বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় উপস্থাপিত গবেষণাপত্রে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে হিসাবটি করা হয়।
গবেষণাপত্রে আরো বলা হয়, ২০১৫ সালের অর্থ পাচার প্রতিরোধ আইন সংশোধনের পর মোট ৯৫টি টাকা পাচারের ঘটনা নিয়ে কাজ করে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এর সবক’টিই করা হয়েছে বাণিজ্যের মাধ্যমে, যার আর্থিক পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২০১ কোটি টাকা।
বিআইবিএমের তিন শিক্ষক, বেসরকারি ব্যাংকের দুই কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) এক কর্মকর্তা মিলিয়ে ৩৭টি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের প্রশ্ন-উত্তরের তথ্য দিয়ে গবেষণাপত্রটি তৈরি করা হয়। গবেষণার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইবিএমের শিক্ষক আহসান হাবিব।
আহসান হাবিব বলেন, ‘অর্থ পাচারে অপরাধীরা বাণিজ্য চ্যানেলটি ব্যবহার করে, তার পেছনে কয়েকটি বড় কারণ রয়েছে। প্রথমত, বাণিজ্যের মাধ্যমে বড় পরিমাণের অর্থ নেয়া যায়। অন্য যেকোনো মাধ্যমের চেয়ে বাণিজ্যের মাধ্যমে অনেক বেশি পরিমাণ অর্থ লেনদেন করা সম্ভব হয়। ফলে এ মাধ্যমে বড় অংকের অর্থ বিদেশে পাঠানোর আগ্রহ বেশি থাকে।’
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার বলেন, ‘কম দাম দেখিয়ে আমদানি ও রফতানির মাধ্যমেও অর্থ পাচার হয়; এটাও বাণিজ্য অর্থায়নের মধ্যে পড়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাণিজ্য এমনভাবে করা হয় যে বাইরের দৃষ্টিতে সব ঠিকঠাক মনে হয়। তবে ভেতরে অন্য কিছু লুকানো থাকে। অনেক সময় চোখে ধুলা দেয়ার মতো অবস্থা হয়। বলা হয় এক কথা, আসলে ভেতরে অন্য কিছু চলছে। তাই ভালোভাবে দেখা জরুরি।’
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় আহসান হাবিব বলেন, ‘২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আমদানি ও রফতানির সময় মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে, যা দেশের জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ।’ এ সময় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরের তথ্য-উপাত্তও এ গবেষণায় ব্যবহার করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
গবেষণার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় বলা হয়, ২০২৪ সালে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে বছরে গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। এ অর্থ পাচার মূলত বস্ত্র, ভোগ্যপণ্য ও জ্বালানি পণ্য আমদানিতে হয়।
গবেষণায় প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়, দেশে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থ পাচার মোকাবেলায় পর্যাপ্ত সুরক্ষা কাঠামোতে দুর্বলতা আছে। জরিপে অংশ নেয়া শতভাগ ব্যাংক জানায়, নিষেধাজ্ঞা তালিকা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া, অর্থাৎ আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা যাচাইয়ের সক্ষমতা রয়েছে। ৯৫ শতাংশ ব্যাংকের রয়েছে সনাতনী তালিকা যাচাইয়ের প্রক্রিয়া। ১০০ শতাংশ ব্যাংকের লেনদেনের নিজস্ব তথ্যভাণ্ডার রয়েছে। আমদানি-রফতানি মূল্য যাচাইয়ের তথ্যভাণ্ডারে সুবিধা নিতে পারে ৫০ শতাংশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার বলেন, ‘যারা বিদেশে টাকা পাচার করেন, তারা কৌশলে কাজটি করেন। শুধু নিয়ম মেনে চললেই তাদের ধরা যাবে না। বুদ্ধি খাটাতে হয়। তাদের ধরতে খুব সতর্ক থাকতে হয়।’
গোলটেবিল বৈঠকে আরো বক্তব্য দেন বিআইবিএমের এ কে গঙ্গোপাধ্যায় চেয়ার অধ্যাপক ফারুক এম আহমেদ, বিআইবিএমের মহাপরিচালক আবদুল হাকিম, বিআইবিএমের শিক্ষক আলী হোসেইন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক একেএম রেজাউল করিম, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) পরিচালক মোস্তাকুর রহমান প্রমুখ।