পিঠে সিলিন্ডার বেঁধে মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া সেই জিয়াউল নিজেই করোনা পজিটিভ

মোঃ রাজু খান (ঝালকাঠি):
ঝালকাঠির নলছিটি পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সূর্যপাশা এলাকার রেহেনা পারভীন (৫০)। তিনি নলছিটি বন্দর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ১০ দিন ধরে জ্বরে ভোগার পর ১০ এপ্রিল করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দেন। কিন্তু প্রতিবেদন পাননি। এর মধ্যেই ১৭ এপ্রিল সকালে দেখা দেয় শ্বাসকষ্ট। কষ্ট কমাতে একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার বাড়িতে আনেন ছেলে জিয়াউল হাসান। সেটি দিয়েও অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল না। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্বাসকষ্টও বাড়তে থাকে রেহেনা পারভীনের। কী করবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না জিয়াউল। এরপর মাকে বরিশালের হাসপাতালে নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স এবং অন্য যানের খেঁাজে নামেন। কিন্তু পাচ্ছিলেন না। নিরুপায় হয়ে নিজের মোটরসাইকেলে মাকে হাসপাতালে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পিঠের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধেন অক্সিজেন সিলিন্ডারটি। এরপর মাকে পেছনে বসিয়ে তঁার মুখে পরান অক্সিজেন মাস্ক। এভাবে ২০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে ওই দিন বিকেলে মাকে নিয়ে পেঁৗছান বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পাশে আরেকটি মোটরসাইকেলে ছুটছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ছোট ভাই রাকিব। পথিমধ্যে কোন সমস্যা হলে তা সার্বিক দেখার জন্য সঙ্গি রাকিব। ছয় দিন এই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর শুক্রবার সুস্থ হন রেহেনা পারভীন।
এরপর অনেকটা বিজয়ীর বেশে মোটরসাইকেলেই শুক্রবার দুপুরে মাকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন জিয়াউল। শনিবার সকালে আবার মাকে নিয়ে যান নলছিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে অ্যান্টিজেন টেস্ট করান জিয়াউল, তাঁর মা রেহেনা পারভীন (৫০) ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া ছোট ভাই রাকিব হাসান। মায়ের ও ছোট ভাইয়ের প্রতিবেদন আসে ‘নেগেটিভ’। কিন্তু জিয়াউল করোনা ‘পজিটিভ’। শনিবার দুপুরে প্রতিবেদন পাওয়ার পরই জিয়াউল বলেন, ‘ আমি পজিটিভ। দোয়া করবেন, কোনো সমস্যা নেই। সুস্থই আছি। অক্সিজেন স্যাচুরেশনও ভালো। আসুক না, তাতে কী! আমার মা ও ছোট ভাই তো সুস্থ আছে।’ এমন ভালোবাসা ও কর্মনিষ্টার দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেন তিনি।
১৭ থেকে ২২ এপ্রিল ছয় দিন ধরে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন মায়ের সার্বক্ষণিক সেবাযত্ন করেন জিয়াউল। ঝঁুকি আছে জেনেও তঁাকে এই কাজে নিবৃত্ত করতে পারেননি চিকিৎসক, নার্স এমনকি স্বজনেরা।
জিয়াউলের মা স্কুল শিক্ষক রেহেনা পারভীন বলেন, ‘খুব ভালো আছি। কিন্তু আমার ছেলেটা যে করোনা পজিটিভ হলো, এ নিয়ে তো বেশ চিন্তা লাগছে। আমাকে কত যত্ন করেছে ছেলেরা। বাড়িতে ১০ দিন ধরে জ্বরে পড়ে ছিলাম। রাতে একটু তন্দ্রা লেগে এলে আবার উঠে দেখতাম, আমার দুই ছেলে আমার দুই পাশে বসে মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কীভাবে আমাকে সুস্থ করা যায়, তা নিয়ে দুই ভাই শলাপরামর্শ করছে। কী করলে আমার একটু আরাম লাগবে, সারা রাত সে চেষ্টাই করত। কত কষ্ট করে মোটরসাইকেলে আমাকে হাসপাতালে নিয়েছে। ছয় দিন এক মুহূর্তের জন্য হাসপাতাল থেকে আমার ছেলে চোখের আড়াল হয়নি। গত বছরের ১ মার্চ আমার স্বামী মারা গেছেন। এরপর নিজেকে অসহায় লাগত। কিন্তু এবারের অসুস্থতায় বুঝেছি, আমি অসহায় নই। ছেলেরা আমার পাশে আছে। কত যত্ন করে।’
জিয়াউল বলেন, ‘মায়ের অক্সিজেন স্যাচুরেশন এখন ৯৮-৯৯। সবার কাছে কৃতজ্ঞতা যে আমি আমার মাকে সুস্থ করে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। সবার দোয়ায় আমিও সুস্থ হয়ে যাব। এত মানুষের শুভকামনা, ভালোবাসা বৃথা যেতে পারে না।’