ব্যবসায়িক পরিবেশে স্থবিরতা, চাপ বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধিতে
দেশের ব্যবসায়িক পরিবেশে গত এক বছরে তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। বরং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, আর্থিক খাতের দুর্বলতা ও প্রশাসনিক জটিলতা অর্থনীতিকে চাপে ফেলেছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের (পিইবি) যৌথ গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে।
রাজধানীর গুলশানে গতকাল এক অনুষ্ঠানে ‘বাংলাদেশ বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স (বিবিএক্স) ২০২৪-২৫’ শীর্ষক এ প্রতিবেদন উন্মোচন করেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। অস্ট্রেলিয়া সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ট্রেডের সহায়তায় টানা চতুর্থবারের মতো এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে।
ব্যবসায়িক অবকাঠামো, বিরোধ নিষ্পত্তি, প্রযুক্তি অভিযোজন ও শ্রম নীতিমালাসহ মোট ১১টি খাতের ওপর জরিপ চালিয়ে দেশের ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিস্থিতির এ সূচক তৈরি করা হয়। মোট চার শ্রেণীতে বিভক্ত এ সূচকে সার্বিক মান ৪০-এর নিচে থাকলে ব্যবসার জন্য ‘কঠিন পরিবেশ’, ৪১-৬০-এর মধ্যে থাকলে ‘গুরুতর প্রতিবন্ধকতা’, ৬১-৮০-এর মধ্যে থাকলে ‘পরিস্থিতি উন্নয়নমূলক’ ও ৮১-১০০-এর মধ্যে থাকলে ‘ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ’ বোঝানো হয়েছে।
বিবিএক্স সূচক অনুযায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের বিবিএক্স মান দাঁড়িয়েছে ৫৯ দশমিক ৬৯। এর আগের অর্থবছরে এ মান ছিল ৫৮ দশমিক ৭৫। এক বছরে এ মান দশমিক ৯৪ পয়েন্ট বাড়লেও দেশের ব্যবসা পরিবেশের অবস্থা এখনো ‘গুরুতর প্রতিবন্ধকতা’ শ্রেণীতে রয়েছে। মূলত রাজনৈতিক অস্থিরতা, ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতির চাপ, উচ্চ সুদ হার ও বিনিয়োগের অনিশ্চয়তার কারণই বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ ২০২২ সাল থেকে ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রা সংকট ও ব্যাংক খাতের ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এসব খাতে কিছুটা স্থিতিশীলতা এলেও দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি, রাজস্ব আয় ও বিনিয়োগে উন্নতি হয়নি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩ দশমিক ৩ শতাংশ। ব্যাংক খাতের অস্বচ্ছতা, উচ্চ সুদহার ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় ব্যবসার প্রতি আস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তিনি বলেন, ‘ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার ব্যবসার জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। আশা করছি, আগামী বছর নাগাদ সুদহার কমে আসবে। দেশে নিরীক্ষা সমস্যা নয়, নিরীক্ষার পদ্ধতি সমস্যা। আমাদেরকে এ বিষয়ে কাজ করতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘পৃথিবীর সব জায়গায় দুর্নীতি আছে, এটা একেবারে বন্ধ করে ফেলা সম্ভব নয়। তবে আমরা দুর্নীতির পথকে কঠিন করে তুলতে পারি। আমি তিনটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছি। আমার আওতাধীন কোনো প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতির কোনো তথ্য পেলে জানাবেন, আমি সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেব।’ এ সময় সব ব্যবসায়ীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি বলেও জানান বাণিজ্য উপদেষ্টা।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পিইবির চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এম মাসরুর রিয়াজ। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ব্যবসা করতে গেলে বন্দরসহ প্রায় সব স্তরে হয়রানির শিকার হতে হয়। কিছু ক্ষেত্রে বিনিয়োগ হলেও সার্বিকভাবে দেশে গুণগত অর্থায়ন হচ্ছে না।’ বেসরকারি খাত সংস্কারে সরকারের মনোযোগ দেয়া দরকার বলেও মনে করেন পিইবির চেয়ারম্যান।
প্যানেল আলোচনায় বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, ‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া ব্যবসায়িক পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। ব্যবসায়ীদের মতামত না নিয়ে নীতি তৈরি করলে ব্যবসায়িক পরিস্থিতি আরো কঠিন হয়।
অনুষ্ঠানে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী হক চৌধুরী বলেন, ‘ব্যবসায়িক পরিস্থিতিতে আমাদের আর নিচে নামার মতো কিছু নেই। এখন একসঙ্গে সামনে চলতে হবে। আমলাতন্ত্রকে স্বয়ংক্রিয় করতে হবে।’
এমসিসিআইয়ের সভাপতি কামরান টি রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনারের ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কমিশনার বেন কারসন ও জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ কাজুইকি কাতাওকা প্রমুখ।


