এক বছরেও ঠিক হয়নি অক্সিজেন সরবরাহ
করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ব্যাপকহারে বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা অনুযায়ী অক্সিজেন সংকট দেখা দিয়েছে। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত থাকলে সামনে অক্সিজেন সংকট ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। এখনই রোগীদের অক্সিজেনের জন্য এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে হচ্ছে। অনেকের ৬ হাসপাতাল ঘুরেও মিলছে না অক্সিজেন। এনেসথেসিওলজিস্টরা জানান, রবিবার একটি হাসপাতালে একদিনে অক্সিজেনের অভাবে ৫ জন মারা গেছেন। ওই হাসপাতালে ১০ জন রোগীর অক্সিজেনের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু অক্সিজেন ছিল ৫টি। কোভিডের কারণে সারা পৃথিবীতে একই অবস্থা হলেও বেশকিছু দেশ এই সময়ের মধ্যে চিকিত্সা ব্যবস্থা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, শ্রীলংকা, ভূটানসহ বিভিন্ন দেশ করোনা চিকিত্সার ক্ষেত্রে সব ব্যবস্থাপনা করে ফেলেছে। তবে এক বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও দেশে এখনো ঠিক করা যায়নি অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঠিক মনিটরিং ও কার্যকরী পদক্ষেপের কারণে দেশে করোনার প্রথম ঢেউ ভালভাবে মোকাবেলা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ওই সময় সারাদেশে সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিজস্ব উদ্যোগে অক্সিজেন উত্পাদন ও সরবরাহের ব্যবস্থাসহ জনবল বৃদ্ধি দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। সেই অনুযায়ী কাজও চলছিল। কিন্তু মাঝখানে করোনা কমে যাওয়ায় সেই উদ্যোগ স্থগিত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন যারা করবেন তাদের দূরদর্শিতার অভাব ছিল, এখনো আছে। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের এক শ্রেণির কর্মকর্তা ভাবেন তারাই সর্বময় কর্তা। তারা সঠিক কাজটি না করে কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কেউ কেউ ফাইল আটকে রাখেন। চেইন অব কমান্ড মানেন না। এতে কোভিড মোকাবেলা কার্যক্রম বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তার এমন আচরণে অনেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ক্ষুব্ধ।
বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, করোনা রোগিদের অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে শ্বাসকষ্ট অন্যতম। যেসব রোগির শ্বাসকষ্ট সহনীয় মাত্রায় থাকে, তাঁদের শ্বাস গ্রহণের জন্য অক্সিজেন নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যাঁদের শ্বাসকষ্টের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়, তাঁদের শ্বাসযন্ত্র সচল রাখতে বাইরে থেকে অক্সিজেন সরবরাহ করতে হয়। সাধারণ রোগিদের জন্য আইসিইউতে যে অক্সিজেন দিতে হয়, সেটি এক মিনিটে ৫/৬ লিটার লাগে। কিন্তু করোনা রোগির জন্য যে অক্সিজেন প্রয়োজন সেটি মিনিটে ৭০/৮০ লিটার লাগে। এটি হলো হাই ফ্লো নেজাল অক্সিজেন ক্যানোলা। বেসরকারি দুই থেকে তিনটি হাসপাতাল ছাড়া কোথাও এই অক্সিজেন নেই। বাতাসের মাধ্যমে এই অক্সিজেন তৈরি হয়। পিএসএ জেনারেটর স্থাপনের মাধ্যমে সরকারি হাসপাতালে এই অক্সিজেন উত্পাদন করা সম্ভব। কিন্তু সময়মতো তা করা হয়নি। কারণ এক শ্রেণির কর্মকর্তা উত্পাদন না করে বিদেশ থেকে কিনে এনে সাপ্লাই দিতে পছন্দ করেন। এতে নিজেদের পকেট ভারি হয়। তারা বলেন, বর্তমানে কোভিড যে হারে বেড়েছে, তাতে অক্সিজেন উত্পাদন করার আর সময় নেই। সংকট মেটাতে দ্রুত বিদেশ থেকে অক্সিজেন নিয়ে আসতে হবে। অধিকাংশ জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ নেই। দেশে করোনায় আক্রান্ত ১০ হাজারের বেশি রোগির আইসিইউ সহায়তা দরকার, কিন্তু শয্যা আছে মাত্র ৩৯৯টি। সেটা ম্যানেজ করতেও পর্যাপ্ত জনবল নেই। নতুন করে আইসিইউ বাড়িয়েও লাভ হবে না। দক্ষ জনবলের সংকট রয়েছে। যেভাবে করোনা রোগি বাড়ছে, তাতে বেকার সব ডাক্তারের স্পেশাল বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হলেও সামাল দেওয়া যাবে না। সেই সংখ্যক অনুযায়ী নার্সও লাগবে। এদিকে করোনায় আক্রান্ত কোনো রোগির জন্য চিকিত্সকরা আইসিইউয়ের পরামর্শ দিলেই আঁঁতকে ওঠে স্বজনরা। অসহায় হয়ে ছুটতে শুরু করে এখানে-সেখানে। ঢাকায় এখন কোথাও মিলছে না আইসিইউ। বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকরা বলেন, হাসপাতাল বাড়ালে এবং অক্সিজেন সরবরাহ বৃদ্ধি করলেও কোন লাভ হবে না। করোনা থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। বর্তমানে যে পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে, তাতে রাজধানীতে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ঢাকার বাইরে কিভাবে ম্যানেজ করা হবে তা কারোর বোধগম্য নয়। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে অনেক রোগি মারা যাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চিকিত্সক বলেন, ‘অন্যকে কী বলব, আমরা নিজেরই তো ঘুম হয় না এই ভেবে যে যদি আমরা এখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়ি আর যদি আমাদের জন্য আইসিইউ দরকার হয় তখন কী হবে? টাকায় থেকেও তো লাভ হচ্ছে না।’ অসহায়ভাবে এই চিকিত্সকরা আরো বলেন, ‘এত দিন আমরা পরিচিত অনেকের জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে আইসিইউয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছি, এখন আমাদেরই তো আইসিইউ জুটবে না। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা একদিন হাসপাতালে এসে চিত্র দেখে যান।’ অপরদিকে কোভিড ন্যাশনাল গাইডলাইন ম্যানমেন্ট কমিটি গতকাল বৈঠকে বসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। এ সময় এই কমিটি দ্রুত অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছে। এছাড়া দ্রুত চিকিত্সা সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে।
এব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, যত হাসপাতাল ও আইসিইউ বাড়ানো হোক না কেন কোন লাভ হবে না। করোনা রোগের জন্য সর্বোত্তম ব্যবস্থা হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, মাস্ক পরা। এক্ষেত্রে কেউ উদাসিনতার পরিচয় দিলে নিজে মরবে, পরিবার ও প্রতিবেশিদের মারবে।
মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, বর্তমানে অক্সিজেন সংকট প্রকট। দেশে অক্সিজেন উত্পাদন করা সম্ভব ছিল। পিএসএ জেনারেটর স্বল্প জায়গায় বসিয়ে দিলেই হতো। সময়মতো এটা করা উচিত ছিল। তবে এখন যেভাবে করোনা রোগী বাড়ছে, তাতে আর উত্পাদন করার সময় নেই। দ্রুত অক্সিজেন বিদেশ থেকে আনতে হবে। তিনি বলেন, জনগণকে বুঝতে হবে যে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এই রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এই মুহূর্তে করণীয় হলো ফিল্ড হাসপাতাল তৈরি করে মধ্যবৃত্ত ও নিম্নবৃত্তদের সেখানে সেবা দেওয়া। আইসিইউয়ের প্রয়োজন হলে সেখান থেকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া। তিনি বলেন, দেশে অক্সিজেন তৈরি করা যেত, সময়মতো এটা বাস্তবায়ন করা উচিত ছিল। কিন্তু করা হয়নি।
বিএমএ মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল বলেন, আমরা যথেষ্ট সময় পেয়েছি। কিন্তু সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। এক্ষেত্রে দূরদর্শিতার অভাব ছিল। যার যে কাজ তাকে সেখানে দেওয়া হয়নি। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কেউ কেউ নিজে বাদশা ভাবেন। এই কারণেই এই অবস্থা।
অক্সিজেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান লইনডে কোম্পানির ম্যানেজার (মানব সম্পদ) সাইকা মাজেদ বলেন, আমরা চাহিদা অনুযায়ী অক্সিজেন সরবরাহ করছি। দেশে আমাদের দুটি উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। একটি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে, অন্যটি চট্টগ্রামের শীতলপুরে। ভারতেও এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠান আছে। সেখান থেকেও এনে সরবরাহ করা হচ্ছে। এদিকে দেশে অক্সিজেনের চাহিদার ৮০ ভাগ সরবরাহ করে লইনডে। এছাড়া ছোটখাট আরো কয়েকটি কোম্পানি আছে, তারাও অক্সিজেন সরবরাহ করছে।