করোনার সংক্রমণ ঠেকানোর কোনো বিকল্প নেই
দেশে গতকাল মঙ্গলবার এক দিনে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ২১৩ জন এবং মারা গেছেন ৬৬ জন। এক দিনে শনাক্ত রোগী ও মৃত্যুর এই সংখ্যা মহামারির এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
সংক্রমণ শনাক্তের সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর ভিড়। দেশের অন্যান্য স্থানেও বাড়ছে হাসপাতালে বেড না পাওয়ার হাহাকার। বর্তমানে সব হাসপাতাল রোগীতে সয়লাব। রাজধানীর কোনো হাসপাতালে আইসিইউ সিট খালি নেই।
তিন থেকে চার দিন ধরে অপেক্ষমাণ রোগীদের দায়িত্বরত ডাক্তাররা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘কেউ মারা গেলে সিট খালি হবে। তার আগে সিট পাওয়া যাবে না।’
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন, যে হারে রোগী বাড়ছে, তাতে করোনার সংক্রমণ ঠেকানোর কোনো বিকল্প নেই। জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করতে হবে। নইলে সামনে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে। দেশে করোনার সংক্রমণ গত ৯ দিনে ছয় বার রেকর্ড ভেঙেছে।
গত বছরের ২ জুলাই দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ শনাক্ত হয় এক দিনে ৪ হাজার ১৯ জন। গত ২৯ মার্চ সেই রেকর্ড ভেঙে করোনা শনাক্ত দাঁড়ায় ৫ হাজার ১৮১ জন। সেই রেকর্ড ভেঙে ফের ৩১ মার্চ শনাক্ত হয় ৫ হাজার ৩৮৫ জন। ১ এপ্রিল শনাক্তের রেকর্ড ভেঙে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪৬৯ জন। ২ এপ্রিল আবারও রেকর্ড ভেঙে শনাক্ত দাঁড়ায় ৬ হাজার ৮৩০ জন। এরপর ৪ এপ্রিল ৭ হাজার ছাড়িয়ে এক দিনে শনাক্ত দাঁড়ায় ৭ হাজার ৮৭ জন। এরপর গতকাল মঙ্গলবার দেশের ইতিহাসে করোনায় সর্বোচ্চ শনাক্ত ও মৃত্যু হয়েছে। গত এক দিনে সেই রেকর্ডও ভেঙেছে।
হাসপাতালে জায়গা দিতে না পেরে চোখের সামনে রোগীর করুণ মৃত্যু দেখে অনেক ডাক্তার চোখে পানি ধরে রাখতে পারছেন না। অনেক হাসপাতালে এ দৃশ্য দেখা গেছে। কোনো কোনো ডাক্তার বলেন, ‘এই রোগী যদি আমার বাবা, মা, ভাই, বোন হতো, তাহলে কী করতাম? একজন ডাক্তার হয়েও এই রোগীর সেবা দিতে পারলাম না!’ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ, মুগদা মেডিক্যাল কলেজ, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ তিনটি বেসরকারি হাসপাতালে এই প্রতিনিধি গিয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে করোনার চিকিৎসাসেবা বিষয়ে কথা বলতে গেলে ১০ জন চিকিৎসক তাদের এই প্রতিক্রিয়া জানান।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেন, সারা পৃথিবীতে করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। অনেক দেশ লকডাউন, কারফিউ পর্যন্ত দিয়েছে। তবে ঐ সব দেশ ব্যবসায়ীসহ সব পেশার মানুষ কিংবা বেকার ও অসচ্ছল লোকদের আর্থিক প্রণোদনা দিয়েছে। বাড়ি বাড়ি পর্যন্ত অর্থ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের দেশের চিত্র ভিন্ন। তবে যেসব দেশ স্বাস্থ্যবিধি মেনেছে, সেই সব দেশ করোনা নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, মানুষের বেপরোয়া আচরণের কারণে পরিস্থিতির এমন অবনতি ঘটেছে। স্বাস্থ্যবিধি কেউ মানে না। মিছিল-মিটিংয়ে মানুষের সমাগম হয়েছে। বিদেশ থেকে মানুষ দেশে এসে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে করোনার লন্ডন ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে কক্সবাজারসহ দেশের বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে মানুষের ব্যাপক ভিড় ছিল। এসব কারণে বর্তমানে সংক্রমণ ব্যাপক হারে বেড়েছে। দৈনিক ৫০০ থেকে এখন ৭ হাজারের বেশি মানুষ শনাক্ত হচ্ছে। আগে যেখানে দৈনিক পাঁচ জনের মৃত্যু হতো, এখন সেখানে ৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। রাজধানীর কোনো হাসপাতালে সিট খালি নেই। নতুন করে সিট দেওয়ার মতো কোনো জায়গাও নেই।
তিনি বলেন, মহাখালীর ডিএনসিসি মার্কেটে নতুন করে ২২৫ বেডের আইসিইউ হাসপাতাল স্থাপন করা হচ্ছে। এছাড়া সেখানে করোনা রোগীদের জন্য ১ হাজার বেডের হাসপাতাল করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, করোনার সংক্রমণ ঠেকাতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আর করোনার সংক্রমণ ঠেকানোর একমাত্র উপায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। এক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, মানাতে হবে। প্রশাসনকে কঠোর থেকে কঠোরতর ব্যবস্থা নিতে হবে। এখানে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না।
করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, করোনা চেপে ধরেছে। নিজেদের ভুলের কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি কেউ মানছে না। লকডাউন দেওয়া হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না।
এখন আবার গণপরিবহন চালু হচ্ছে। তাহলে লকডাউন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কীভাবে তা কার্যকর করা হবে, সেটি ঠিক করা উচিত ছিল। তিনি বলেন, যেসব এলাকায় করোনার বেশি রোগী পাওয়া যাচ্ছে, সেসব এলাকাকে রেড জোন ঘোষণা করে করোনা পরীক্ষা বাড়িয়ে দিতে হবে। ঐ সব এলাকায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে। অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম আরো বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করার দায়িত্ব যাদের, তারা ঠিকভাবে কাজ করছে না। অর্থাৎ আদেশ আছে কাগজ-কলমে, বাস্তবায়ন নেই।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ বলেন, হাসপাতাল, বেড, আইসিইউ বাড়িয়ে লাভ হবে না। কারণ লকডাউন দিয়েছে, কিন্তু কার্যকর হচ্ছে না। মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। গণপরিবহনে অর্ধেক সিট খালি রেখে চলার নির্দেশনাও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ কারণে সংক্রমণ বাড়ছে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মানতে কঠোর হতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানার মাধ্যমেই সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব।
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষার বিবেচনায় শনাক্তের হার আগের দিনের চেয়ে কিছুটা কমেছে। গতকাল মঙ্গলবার এ হার ছিল ২১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। আগের দিন সোমবার যা ২৩ দশমিক ৪০ শতাংশ ছিল। মহামারির শুরু থেকে এ পর্যন্ত পরীক্ষার তুলনায় মোট শনাক্তের হার দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ এবং মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ।